বৈদেশিক কর্মসংস্থান বাড়লেও বাড়ছে না রেমিট্যান্স

295

বিদেশে প্রতিবছরই বাংলাদেশী কর্মীর কর্মসংস্থান বাড়ছে। কিন্তু তার বিপরীতে বাড়ছে না রেমিট্যান্স আয়। বরং কমে যাচ্ছে। সদ্য শেষ হওয়া অর্থবছরে প্রবাসীরা যে অর্থ পাঠিয়েছেন তা আগের অর্থবছরের চেয়ে সাড়ে ১৪ শতাংশ কম। বিগত ২০১৬ সালে দেশ থেকে জনশক্তি রপ্তানি হয়েছে ৭ লাখ ৫৭ হাজার ৭৩১ জন। আর তার আগের বছরে ছিল ৫ লাখ ৫৫ হাজার ৮৮১ জন। অর্থাৎ ২০১৬ সালে আগের বছরের তুলনায় জনশক্তি রপ্তানি বেড়েছে ৩৬ শতাংশ। কিন্তু সদ্য শেষ হওয়া ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রবাসীরা এক হাজার ২৭৬ কোটি ৯৪ লাখ ডলার পাঠিয়েছেন। যা গত ৫ অর্থবছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। আগের অর্থবছরে প্রবাসীরা এক হাজার ৪৯৩ কোটি ১১ লাখ ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন। এক বছরের ব্যবধানে রেমিট্যান্স প্রবাহ ১৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ বা ২১৬ কোটি ১৭ লাখ ডলার কমেছে। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, চলতি বছরের প্রথম সাড়ে ৬ মাসে সাড়ে ৫ লাখের বেশি কর্মী বিদেশ গেছে। এই ধারা অব্যহত থাকলে এ বছরই ১০ লাখ শ্রমিক পাঠানো সম্ভব হতে পারে। ২০১৬ সালে উচ্চ দক্ষতা সম্পন্ন কর্মী গিয়েছে ৪ হাজার ৬৩৮ জন, দক্ষতাসম্পন্ন ৩ লাখ ১৮ হাজার ৮৫১ জন, মধ্যম দক্ষতা সম্পন্ন এক লাখ ১৯ হাজার ৯৪৬ জন, কম দক্ষতা সম্পন্ন ৩ লাখ তিন হাজার ৭০৬ জন এবং অন্যান্য ১০ হাজার ৫৯০ জন। প্রত্যেক শ্রেণতেই আগের বছরের তুলনায় জনশক্তি রপ্তানি বেড়েছে। হিসাবে দেখা গেছে ২০০৯ সালে জনশক্তি রপ্তানি হয়েছিল ৪ লাখ ৭৫ হাজার ২৭৮ জন। এর পরের বছরগুলোতে ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে জনশক্তি রপ্তানি। কিন্তু সে তুলনায় রেমিট্যান্স না বেড়ে বরং কমে গেছে। কারণ সম্প্রতি সব দেশে এন্টি মানি লন্ডারিং বিষয়ে ব্যাপক কড়াকড়ি বেড়ে গেছে। তা নিয়ে বিশ্বব্যাপীই হইচই হচ্ছে। ফলে বিদেশের এক্সচেঞ্জ হাউজগুলোর নিয়ম আগের চেয়ে অনেক কড়াকড়ি হয়েছে। আগে যেখানে খুব সহজেই রেমিট্যান্স পাঠানো যেতো। কিন্তু এখন সেখানে নানা ধরনের প্রশ্ন করা হয়। রেমিট্যান্স কমার ক্ষেত্রে এমন অবস্থাকে অনেকেই মূল কারণ হিসাবে দেখছেন।
সূত্র জানায়, সৌদি আরবে কর্মরত কোনো প্রবাসীর আকামা (কাজের অনুমতি) অনুযায়ী বেতন ২ হাজার রিয়াল। ওভারটাইম বা আকামার নির্ধারিত প্রতিষ্ঠানের বাইরে কাজ করে আরো দুই হাজার রিয়াল আয় করা যায়। কিন্তু এখন ওই প্রবাসীকে দেশে অর্থ পাঠাতে হলে তার আকামায় নির্ধারিত বেতনের বাইরে অর্থ ব্যাংকিং চ্যানেলে (ফরমাল ওয়ে) পাঠাতে গেলে সে এন্টি মানিলন্ডারিংয়ে আটকে যাচ্ছে। সেজন্য মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যম বা অন্য কোনো মাধ্যমে দেশে টাকায় পাঠাচ্ছে। আগে এত কড়াকড়ি ছিল না। ফলে রেমিট্যান্স কমছে। তাছাড়া বিশ্বব্যাপী তেলের দাম কমে যাওয়ায় মধ্যপ্রাচ্যে সঙ্কট দেখা দিয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে ওসব দেশ মন্দার মধ্যে পড়েছে। বাংলাদেশের কর্মীরা ওসব দেশে বেশি আছে তাই কমে গেছে প্রবাসীদের উপার্জন। অন্যদিকে পশ্চিমা বিশ্বের নানা সংকটে ইউরো ও পাউন্ডের দাম পড়ে যাওয়ায় প্রবাসীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আর ওসব কারণে একটু বাড়তি লাভের জন্য ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ না পাঠিয়ে হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাঠাচ্ছে তারা। ফলে তা হিসাবে আসছে না।
সূত্র আরো জানায়, প্রবাসীদের কাছ থেকে রেমিট্যান্স কমার জন্য ব্যাংকের মাসুল ও চার্জও একটি অন্যতম কারণ। ব্যাংকিং চ্যানেলের চার্জ কমানোর জন্য অতিসম্প্রতি রেমিট্যান্স আহরণকারী শীর্ষ ২০ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগ। তাতে ব্যাংকাররা বলেন, রেমিট্যান্স নেয়ায় ব্যাংক কোনো খরচ নেয় না। যে খরচ হয় তা উৎস দেশের এক্সচেঞ্জ হাউস বা ব্যাংকগুলোর খরচ। তাই খরচ কমানোর ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর কিছু করার নেই। বরং রেমিট্যান্স আহরণের জন্য প্রয়োজনীয় প্রচার-প্রচারণা এবং বিদেশে গিয়ে কাজ করা অনেক কঠিন হয়ে গেছে। রেমিট্যান্স সংগ্রহ বৃদ্ধির জন্য ব্যাংকগুলো কর্মী প্রেরণ করতে চাইলেও সংশ্লিষ্ট দেশগুলো সহজে ভিসা দিচ্ছে না। তার সমাধান সরকার না করলে রেমিট্যান্সে আরো ধস নামবে।
এদিকে বিদেশে উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীরা বেশি আয় করে। আর কম দক্ষ বা অদক্ষ কর্মীরা স্বাভাবিকভাবে কম আয় করে। কিন্তু উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীরা তাদের আয়ের বড় অংশই দেশে পাঠায় না। যে দেশে তারা থাকে সেখানেই সম্পদ গড়ার চেষ্টা করে। তাদের উদ্দেশ্য থাকে ওই দেশে থেকে যাওয়া। অন্যদিকে কম দক্ষ বা অদক্ষরা তাদের আয়ের পুরো অংশ দেশে পাঠিয়ে দেয়। তবে তাদের আয় কম হওয়ায় তারা পাঠাতেও পারে কম। চলতি বছরে এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্সের পরিমাণ দিন দিন কমছে। ২০১৬ সালে ব্যাংকিং চ্যানেলে এসেছে ৫০ দশমিক ৭২ শতাংশ। যা ২০১৩ সালে ছিল ৬৭ দশমিক ৩২ শতাংশ। এছাড়া ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন বা মানিগ্রামের মাধ্যমে ২০১৬ সালে এসেছে ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশ আর মোবাইল ব্যাংকিং বা বিকাশের মাধ্যমে ১৪ দশমিক ৩১ শতাংশ এসেছে। ২০১৩ সালে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে কোনো অর্থ আসেনি। তাছাড়া ডাকঘর, বন্ধু-বান্ধব বা আত্মীয়-স্বজন, হুন্ডি, পরিচিত ব্যক্তির মাধ্যমে এবং অন্যান্যভাবে বাকি অর্থ বিদেশ থেকে দেশে আসে।