আধুনিক বিশ্বে আরামদায়ক ভ্রমণের জন্য, ঘোড়ায় টানা রেলগাড়ি!

62

আধুনিক বিশ্বে আরামদায়ক ভ্রমণের জন্য রেলগাড়ির বিকল্প নেই। বিশ্বে উচ্চগতির বুলেট ট্রেনসহ মেট্রোরেল এবং আন্তঃনগর ট্রেন রয়েছে। এর মধ্যে কিছু ট্রেন চলে বিদ্যুতে, আবার কিছু চলে ডিজেলচালিত ইঞ্জিনের মাধ্যমে। তবে পাকিস্তানে এমন এক ট্রেনের দেখা মেলে যা একেবারেই ব্যতিক্রম। এই রেলগাড়ি চালিত হয় ঘোড়ার মাধ্যমে। কথাটি হয়তো পুরোপুরি সঠিক হলো না। কারণ রেললাইনের ওপর দিয়ে ঘোড়া গাড়িটি টেনে নিয়ে গেলেও গাড়িতে কোনো কামড়া নেই। নেই রেলের ছন্দময় কু ঝিক্‌ঝিক্‌ শব্দ। স্থানীয়দের ভাষায় এটি ‘ঘোড়ার ট্রেন’।

পাকিস্তানের ফয়সালাবাদ জেলার জড়ানওয়ালা এলাকার গঙ্গাপুরে এই ঘোড়ার ট্রেন দেখা যায়। রেল লাইনের উপর কাঠের তৈরি টেবিলের মতো আসন পাতা থাকে। সেখানে ১৬-১৮ জন যাত্রী বসতে পারেন। আসনের নিচে চাকা হিসেবে ব্যবহার করা হয় সেনাবাহিনীর ট্যাঙ্কের পরিত্যক্ত চাকা।
গঙ্গাপুর থেকে বুচিয়ানা ৩ কিলোমিটার রাস্তায় এ ধরনের যান দেখা যায়। রাস্তার দুই প্রান্তে দুই গ্রাম। দুই গ্রামেই যাত্রী ওঠা-নামার জন্য রয়েছে নির্দিষ্ট স্থান। মূলত দুইদিক থেকে আসা ঘোড়ার ট্রেনে যাত্রী পরিবহন করা হয়। এখানে নেই কোনো ক্রসিং সিস্টেম। মাঝপথে একটি আরেকটির সঙ্গে দেখা হলে যাত্রীরা গাড়ি বদল করেন। চালকও বদল করে নেন ঘোড়ার যাত্রাপথ। রেলপথের ওপর মধ্যম গতিতে ঘোড়া এই গাড়ি টেনে নিয়ে যায়।

জানা যায়, এই গাড়ি চালু করেন গঙ্গারাম রায়বাহাদুর। পুরো নাম স্যার গঙ্গারাম আগরওয়াল। পাঞ্জাবে জন্ম নেওয়া গঙ্গারাম চাকরিসূত্রে আসেন কলকাতা। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার পর কাজ করতেন ব্রিটিশ সরকারের গণপূর্ত বিভাগে। দারুণ সব চমকপ্রদ স্থাপনা করে সারা ফেলেন তিনি। লাহোরে নানান স্থাপত্য, হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ নির্মাণের কারিগর তিনি। ১৯০৩ সালে রাজা সপ্তম এডওয়ার্ডের ভারত যাত্রার সময় গঙ্গারাম দিল্লির রাজদরবার দেখাশোনার দায়িত্ব পান। নানান নান্দনিক কাজের জন্য তার নামের পাশে সম্মানসূচক যোগ করা হয় রায়বাহাদুর খেতাব। তিনি অবসরে যাওয়ার পর নিজ এলাকার প্রতি নজর দেন। চাষাবাদ করেই বাকি সময় কাটাবেন স্থির করেন। ব্রিটিশ সরকারের প্রিয়পাত্র হওয়ায় ৫০ হাজার একর জমিও পেয়েছিলেন। ৩-৪ বছরের প্রচেষ্টায় তিনি জমিতে সবুজ সবজি ফলাতে সক্ষম হন। চাষের জন্য খাল, পানির জন্য পাম্প এসবের ব্যবস্থা তিনি নিজেই করেন।

এরপর গঙ্গারামকে অনুদান দেওয়া হলো আরো ৫০০ একর জমি। সেখানেই তিনি নিজের নামে গড়ে তুললেন নতুন গ্রাম। চাষাবাদের উন্নত জিনিসপত্র না এলে কীভাবে বেশি ফসল হবে? এই চিন্তা থেকেই ইঞ্জিনিয়ার গঙ্গারামের মাথায় এলো বুদ্ধি। গঙ্গাপুর থেকে বুচিয়ানা পর্যন্ত তিন কিলোমিটার রাস্তায় নিজেই বিছিয়ে দিলেন রেলপথ। সবাই যখন বললো রেল আর ইঞ্জিন পাবেন কোথায়? তখনই তিনি বের করলেন সমাধান। বললেন, এই ট্রেন চালাবে ঘোড়া। তবে শোনা যায়, গঙ্গারাম এই গাড়ি চালু করেন তার মেয়ের জামাইয়ের পরামর্শে। জামাইকে এই রেলগাড়ি তিনি উপহার দিয়েছিলেন কারণ বুচিয়ানা থেকে তার গ্রামে আসতে জামাইকে যেন কষ্ট পোহাতে না হয়।

১৯০৩ সাল থেকে ঘোড়ার ট্রেন চালু হয়। ইতিহাস থেকে জানা যায়, এর নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৮৯৮ সালে। শুরুতে এই ঘোড়ায় টানা ট্রেনে ১৫ জন মানুষ চড়তে পারতো। তখন বেশ ভালোই চলছিল এই ব্যবসা। কিন্তু ১৯৯৩ সালে এটি একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। কারণ দুর্বৃত্তরা চুরি করে নিয়ে যেত রেল লাইনের ইস্পাত। ২০০৬ সালে স্থানীয় কাউন্সিলর মুনাওয়ার খান এটি আবার চালু করার উদ্যোগ নেন। ফয়সালাবাদ জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় ২০০৭ সালে আবার চালু হয় ঘোড়ায় চালিত ট্রেন। কিন্তু ২০২১ সালের পর এই ট্রেন জৌলুস হারিয়ে ফেলে। এক সময় অনেক পর্যটক এই গাড়ি দেখতে এলেও এখন আর কেউ তেমন আসে না। ফলে আগের মতো প্রতিদিন এই গাড়ি চলে না।