না ফেরার দেশে চলে গেলেন গোলাপি এখন ট্রেনের মিলন ফারুক

92

দীর্ঘদিন রোগে ভুগছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা, ঢাকা-১৭ আসনের সংসদ সদস্য ও চিত্রনায়ক আকবর হোসেন পাঠান ওরফে ফারুক। মাসের পর মাস সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসা চলছিল তাঁর। দেশে ফেরার জন্য উদ্‌গ্রীব ছিলেন তিনি। কিন্তু আর ফেরা হলো না তাঁর। আজ সোমবার সকালে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। রেখে গেছেন স্ত্রী ও দুই সন্তান।

পাঁচ দশকের বেশি সময়ের ক্যারিয়ারে অভিনয় করেন বহু দর্শকপ্রিয় চলচ্চিত্রে। ফারুকের অভিনীত ‘মিয়াভাই’ চলচ্চিত্রের সাফল্যের পর তিনি চলচ্চিত্রাঙ্গনে ‘মিয়াভাই’ হিসেবে খ্যাতি পান। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ নানা সম্মাননায় ভূষিত হন নন্দিত এই চিত্রনায়ক। অভিনয় থেকে অবসর নেয়ার পর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-১৭ আসন থেকে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।

এইচ আকবর পরিচালিত ‘জলছবি’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে চলচ্চিত্রজগতে ফারুকের অভিষেক ঘটে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই তিনি চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তি পায় তাঁর অভিনীত প্রথম ছবি ‘জলছবি’। চলচ্চিত্র অঙ্গনে নায়ক ফারুক কিংবা মিয়াভাই নামে পরিচিত হলেও তাঁর আসল নাম আকবর হোসেন পাঠান দুলু। ‘ফারুক’ নামটি মূলত ছিল চলচ্চিত্র অঙ্গনের। অভিনেতা এ টি এম শামসুজ্জামান, পরিচালক এইচ আকবর ও ফারুক নামে এক বন্ধু মিলে তাঁকে এই নাম দিয়েছিলেন। সেই থেকে ‘ফারুক’ নামেই পরিচিতি পান।

চলচ্চিত্রের নায়কের নাম ছোট হয়, এটা ছিল নামবদলের একটি কারণ। তবে আসল কারণও ছিল অন্য। সেটা অভিনেতা নিজেই জানিয়েছিলেন ২০১৬ সালে বিবিসি বাংলায় দেওয়া এক অডিও সাক্ষাৎকারে। কারণটা শোনা যাক তাঁর ভাষ্যেই, ‘ছয় দফা আন্দোলনের পর আমি ওয়ান্টেড ছিলাম, যে কারণে নাম দিয়ে দিল ফারুক। ওরা বলল, এই নামে তোমাকে প্রথমে কেউ ধরবে না। দ্বিতীয়ত, চলচ্চিত্রের নামগুলো ছোট হলে ভালো হয়, সুন্দর হয়—যেমন রাজ্জাক, উজ্জল, ফারুক, আলমগীর, শাবানা; নাম ছোট হলে ক্যাচি হয়।’

ফারুকের জন্ম ১৯৪৮ সালের ১৮ আগস্ট, মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলায়। তবে বেড়ে উঠেছেন পুরান ঢাকাতে। বাবা আজগার হোসেন পাঠানের ছিল পাঁচ মেয়ে ও দুই ছেলে। ফারুক ছিলেন ভাইদের মধ্যে সবার ছোট। তাঁর প্রথম ছবিটি পরিচালনা করেন এইচ আকবর। প্রথম ছবিতে তাঁর বিপরীতে অভিনয় করেন কবরী। এই জুটিই করেছিলেন ‘সুজন সখী’ ছবিটি। কবরী ও ফারুক জুটি একসময় খুবই জনপ্রিয় ছিল।

ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন ফারুক। বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে ফারুক জানিয়েছেন, ১৯৬৬ সালে ছয় দফা আন্দোলনে যোগ দেন তিনি। উনসত্তরের গণ-আন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন ও একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। যুদ্ধ থেকে ফিরে চলচ্চিত্রে মনোযোগ দেন।

১৯৭৩ সালে মুক্তি পায় খান আতাউর রহমান পরিচালিত ফারুক অভিনীত ‘আবার তোরা মানুষ হ’। ১৯৭৫ সালে মুক্তি পায় নারায়ণ ঘোষ মিতার ‘লাঠিয়াল’। সে সময় থেকে গ্রামীণ পটভূমির চলচ্চিত্রে তাঁর আলাদা পরিচিতি পান তিনি। একই বছর মুক্তি পায় খান আতার আরেক সিনেমা ‘সুজন সখী’। গ্রামীণ পটভূমির গল্পে নির্মিত এ ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র গ্রামীণ তরুণ সুজনের ভূমিকায় ফারুকের নামডাক ছড়িয়ে পড়ে। পরের বছর ১৯৭৬ সালে মুক্তি পায় আমজাদ হোসেনের ‘নয়নমণি’। ১৯৭৮ সালে মুক্তি পায় শহীদুল্লা কায়সারের কালজয়ী উপন্যাস অবলম্বনে আবদুল্লাহ আল মামুনের সিনেমা ‘সারেং বৌ’। সিনেমায় ‘কদম সারেং’ চরিত্রে জীবনঘনিষ্ঠ অভিনয়ের জন্য ক্ল্যাসিক অভিনেতা হিসেবে গণ্য হন।

আমজাদ হোসেনের ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ ছবিতে মিলন চরিত্রে ফারুকের অভিনয় দর্শকমনে দাগ কাটে। অভিনয়গুণেই মানিকগঞ্জে জন্ম নেয়া দুলু নায়ক ফারুক আত্মপ্রকাশ করেন। এরপর তিনি সবার প্রিয় ‘মিয়াভাই’ হিসেবে পরিচিতি পান। চলচ্চিত্রের পাশাপাশি রাজনীতিতেও সমানভাবে সক্রিয় ছিলেন ফারুক।

নায়ক ফারুক প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান ১৯৭৫ সালে। নারায়ণ ঘোষ মিতা পরিচালিত বিখ্যাত ‘লাঠিয়াল’ সিনেমায় অভিনয় করার কারণে শ্রেষ্ঠ পার্শ্বচরিত্র ক্যাটাগরিতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। ২০১৮ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে আজীবন সম্মাননা অর্জন করেন তিনি।