অর্থনীতিবিদরা সঞ্চয়পত্রে সুবিধাভোগীর সংখ্যা কমানোর পক্ষে

323

সরকারের সুদ ব্যয় কমাতে সঞ্চয়পত্রে সুদের হার কমানোর উদ্যোগকে যুক্তিযুক্ত বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদেরা। তবে সুদের হার না কমিয়ে সঞ্চয়পত্র বিক্রি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা গেলে ও বাজেটে স্থির করা লক্ষ্যের বাইরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করা না হলে সুদ ব্যয় আরও বেশি কমানো সম্ভব বলে মনে করেন তাঁরা। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গতকাল রোববার সচিবালয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মেলনকক্ষে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর কথা জানান। তিনি বলেন, সাধারণত ব্যাংক আমানতের সুদের হারের চেয়ে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ১ থেকে ২ শতাংশ বেশি হয়ে থাকে। বর্তমানে এই ব্যবধান ৪ শতাংশের বেশি। ব্যাংকসুদের হার কমার কারণে কয়েক বছর ধরে সঞ্চয়পত্রের দিকে বেশি ঝুঁকছেন সাধারণ মানুষ। এমন অবস্থায় সঞ্চয়পত্রে সুদের হার কমালে সাধারণভাবেই তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বলে মনে করা হয়। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, সঞ্চয়পত্রে উচ্চ সুদহারে সরকারের বড় অসুবিধা হচ্ছে, সুদের দায়ভার বেড়ে যাচ্ছে। বাজেট ব্যবস্থাপনা ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় অগ্রাধিকার প্রাপ্ত খাতে বরাদ্দ কমিয়ে দিতে হচ্ছে। তিনি বলেন, বিনিয়োগকারীদের কথা মাথায় রেখে সুদহার না কমানোর বিষয়টি আসে। তবে এখন সুদহার কমালেও খুব ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না তাঁরা। কারণ, মূল্যস্ফীতি বেশ কম, সুদ হার কমালেও সমন্বয় হয়ে যাবে। তাই এটি যুক্তিযুক্তই বলা যায়। মির্জ্জা আজিজুল ইসলামের মতে, সঞ্চয়পত্রে সরকারের সুদের ব্যয় কমানোর সবচেয়ে বড় রাস্তা হতে পারেÑবাজেটে যা বলা হয়, তার বাস্তবায়ন। তিনি বলেন, প্রতিবছর বাজেটে সঞ্চয়পত্রে বিক্রিতে যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়, সরকার তার বাইরেও বিক্রি করে। কিন্তু বাজেটে যা বলা হয়, সে অনুযায়ী বাস্তবায়ন করলে সরকারের সুদের হারের বোঝা কমবে। একই কথা বললেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তাঁর মতে, সুদের হার কমানোর চেয়ে সুবিধাভোগীর সংখ্যা কমালে ফলাফল আরও ভালো আসবে। তিনি বলেন, সরকারের সুদজনিত ব্যয় কমানোর দুটি রাস্তা আছে। এক. সুদের হার কমানো, দুই. সুবিধাভোগীর সংখ্যা কমানো। তিনি বলেন, পেনশনভোগী ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের কথা চিন্তা করে বেশ উচ্চ হারে সঞ্চয়পত্রে সুদহার নির্ণয় করা হয়েছে। তবে এ সুবিধার যথেষ্ট অপব্যবহার হচ্ছে। ন্যায়ত যারা এ সুবিধা পাওয়ার যোগ্য নয় তাদের বাদ দেওয়া গেলে সুদের হার না কমালেও চলে। খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘কিছুদিন আগেই একটি জরিপ দেখেছি যে সঞ্চয়পত্রধারী কোটিপতির সংখ্যা ৬৬ শতাংশ। কোটিপতিদের সঞ্চয়পত্রে এত সুদহার দেওয়ার প্রয়োজন নেই। এই অপব্যবহারকারীর সংখ্যা কমালে সরকারের সুদ ব্যয়ের ভার কমবে, যা সঞ্চয়পত্রে সুদের হার কমানোর চেয়ে বেশি লাভজনক হবে।’ অপব্যবহারকারী নির্ণয়ে বেশ কিছু বিষয়ে নজর দিতে হবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আয়কর ও ব্যাংকের তথ্যের সমন্বয় করতে হবে। এ ছাড়া সঞ্চয়পত্র কেনার প্রক্রিয়াটি আরও স্বচ্ছ ও ডিজিটালাইজ করা প্রয়োজন বলে মনে করেন খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। সরকার চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের ১২ মাসে সঞ্চয়পত্র থেকে ১৯ হাজার ৬১০ কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধরেছিল। কিন্তু জুলাই-মার্চ সময়েই ৩৭ হাজার ৬৪৮ কোটি ৪২ লাখ টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে বলে তথ্য দিয়েছে জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের একই সময়ে বিক্রির পরিমাণ ছিল ২৩ হাজার ১৮৮ কোটি টাকা। এ হিসাবে এই নয় মাসে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি বেড়েছে ৬৩ শতাংশের মতো। এমন অবস্থায় সুদের হার কমালেও সঞ্চয়পত্র কেনার হার কমবে না বলে মনে করেন গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, সাধারণ মানুষের বিকল্প বিনিয়োগের সুযোগ কম। তাঁরা ব্যাংকে টাকা রাখতে পারেন, তবে এতে সুদের হার অনেক কম, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। আর আছে সঞ্চয়পত্র। এ তিনটির মধ্যে সবচেয়ে লাভজনক সঞ্চয়পত্র। তাই সুদহার কমালেও সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমবে না। এর আগে ২০১৫ সালের ১০ মে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদের হার গড়ে ২ শতাংশ করে সরকার।