হরমোনজাতীয় কেমিকেলের ব্যবহার রোধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে মাহফুজুল হক

111

‘জীবন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নিরাপদ খাদ্য’- এ সেøাগান সামনে রেখে চাঁপাইনবাবগঞ্জে নিরাপদ আম উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষে বুধবার কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়েছে। জেলা প্রশাসক এ জেড এম নূরুল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কর্মশালায় প্রধান অতিথি ছিলেন নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মাহফুজুল হক।
কর্মশালায় মোহাম্মদ মাহফুজুল হক বলেছেন, আম হচ্ছে আমাদের এই এলাকার বিরাট অর্থকরী ফসল। দিন দিন এর চাহিদা বাড়ছে। এ বিষয়ে আমাদের জনমনে বিভিন্ন ধরনের শঙ্কা কাজ করছে, উৎপাদন পর্যায়ে এবং বিপণন ও বাজারজাতকরণে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিচ্ছে। সম্প্রতি হাইকোর্ট থেকেও একটা নির্দেশনা এসেছে। সেই নির্দেশনার আলোকেই আজকের এই কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, ‘আজকের কর্মশালায় আলোচনার মাধ্যমে যে সুপারিশগুলো উঠে এসেছে সেগুলো ভবিষ্যতে আমরা নিশ্চয়ই আমাদের কর্মপরিকল্পনায় অনুসরণ করার চেষ্টা করব। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, নিরাপদ উপায়ে আম উৎপাদন করতে হবে। নিরাপদ আম উৎপাদন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বা কৃষি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। আমরা শুধু সহযোগী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছি। এখানে কৃষি মন্ত্রণালয়কে আরো বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। বিশেষ করে যে কর্মপরিকল্পনা করা হয়েছে তা মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়নের জন্য বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। কৃষকদেরকে সচেতন করতে হবে। প্রয়োজনে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। বিশেষ করে গ্যাপ বাস্তবায়নে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান বলেন- বাজারজাত করার চেয়েও এখন প্রধান সমস্যা নিরাপদ উপায়ে আম উৎপাদন করা। এ বিষয়টির দিকে লক্ষ রাখতে হবে। আমরা এরই মধ্যে জেনেছি, কোনো কোনো সময়ে আম উৎপাদনে মুকূল ধরার পর থেকে শুরু করে একেবারে আম হারভেস্টিং পর্যন্ত প্রায় ১৫-২০ বার এমনকি কোনো কোনো সময় তারও বেশি বিভিন্ন কীটনাশক স্প্রে করা হয়। চাষিরা না বুঝে অননুমোদিত কীটনাশক স্প্রে করে থাকেন। এগুলো ব্যবহার থেকে আমাদেরকে বিরত থাকতে হবে। তিনি বলেন- আমরা জেনেছি, পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে অননুমোদিত হরমোনজাতীয় কেমিকেল এনে ব্যবহার করছে। যারা এটা করছে তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনকে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তিনি বলেন, কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও ব্যাগিং পদ্ধতির ব্যবহার শুরু করতে হবে। এরই মধ্যে অনেকেই এটা ব্যবহার করতে শুরু করেছেন। এই পদ্ধতির মাধ্যমেও আমের স্বাদ বজায় থাকে এবং ভালো থাকে।
আমগাছের চারপাশে জৈব সারের ব্যবহারের বিষয়টির দিকে লক্ষ রাখার আহব্বান জানিয়ে প্রধান অতিথি আরো বলেন- আমরা আমাদের অর্থকরী ফসলকে টিকিয়ে রাখতে এবং এর গুণগত মান ঠিক রাখতে আমচাষী ও ব্যবসায়ীদের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। আমরা সঠিক নিয়মে, সঠিকভাবে আম উৎপাদন করবো এবং সকলকে উদ্বুদ্ধ করব। পরিপক্ব নিরাপদ আম ভোক্তাদের কাছে পৌঁছে দেয়ার আহŸ্ান জানিয়ে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান আবারো বলেন- নিরাপদ আম উৎপাদনের ক্ষেত্রে সচেতনতায় একমাত্র পথ। আমরা যদি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারি তাহলে আমচাষী, ব্যবসায়ী সবাই নিরাপদভাবে আম উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বাজারজাত করতে বাধ্য হবে। আমচাষী, ব্যবসায়ী, সাধারণ মানুষসহ আমরা যারা প্রশাসনে রয়েছি তারা অর্থাৎ সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমে সচেতনতার কাজটি করলে সফলতা আসবে এবং নিরাপদ আম ভোক্তাদের কাছে আমরা পৌঁছে দিতে পারব। নাচোল উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল কাদেরের প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে প্রধান অতিথি বলেন- যেহেতু চাঁপাইনবাবগঞ্জের খিরসাপাত আম জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেছে সেহেতু আপনারা এটিকে প্যাটেন্ট করতে পারেন, তাহলে শুধু দেশেই নয় সারা বিশ্বে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম হিসেবেই পরিচিতি পাবে। সভাপতির বক্তব্যে জেলা প্রশাসক এ জেড এম নূরুল হক নিরাপদ আম চাষের আহŸান জানিয়ে আমচাষীদের উদ্দেশে বলেন, আমি এ জেলার প্রতিটি আমচাষীর স্বার্থরক্ষায় কাজ করছি। পাশাপাশি আমরা যেহেতু সবাই ভোক্তা তাই ভোক্তাদের স্বার্থরক্ষা করাও আমার কর্তব্য। তিনি বলেন- এরই মধ্যে নিরাপদ আম উৎপাদন, সংক্ষণ ও বাজারজাতকরণ বিষয়ে দুটি সভা হয়েছে। আমরা প্রথম সভায় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম কৃত্রিম উপায়ে কেমিকেল ব্যবহার করে আম বড় করার জন্য হরমোন-কীটনাশক কিংবা বালাইনাশক ব্যবহার করা যাবে না, মাননীয় হাইকোর্টের আদেশ অনুযায়ী আম পাকানোর জন্য কোনো ধরনের কেমিকেল ব্যবহার করা যাবে না। তবে মুকূল ঝরে পড়া রোধ কিংবা আমে পোকার আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য পরিমিত মাত্রায় কীটনাশক ব্যবহার করা যাবে। এটা করতে হলে কৃষি কর্মকর্তা, আম বিজ্ঞানী, হর্টিকালচার সেন্টারের কর্মকর্তাদের অর্থাৎ বিশেষজ্ঞদের প্রেসক্রিপশন নিয়ে করতে হবে। এছাড়াও প্রতিটি আমবাগানে লগবই থাকতে হবে এবং সেই বইয়ে লিপিবদ্ধ রাখতে হবে, কখন কোন বিশেষজ্ঞের প্রেসক্রিপশনে কী কেমিকেল বা বালাইনাশক কবে ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়াও কেমিকেল ও কীটনাশক বিক্রেতাদেরও কঠোর মনিটরিংয়ের আওতায় আনা হবে।
কর্মশালায় বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন পুলিশ সুপার টি.এম. মোজাহিদুল ইসলাম, সিভিল সার্জন ডা. এসএফএম খায়রুল আতাতুর্ক। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত¡ গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শফিকুল ইসলাম।
অন্যদের মধ্যে আলোচনায় অংশ নেন, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য মো. রেজাউল করিম ও মো. মঞ্জুর মুরশেদ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত¡ গবেষণা কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ড. জমির উদ্দিন, ইউনিসেফের কর্মকর্তা মাসুদ আলম ও ইমরুল হাসান। কর্মশালায় জেলার আমচাষী ও ব্যবসায়ী, আড়তদার, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষ অংশগ্রহণ করেন। কর্মশালার আগে জেলা প্রশাসনের কার্যালয়ের সামনে থেকে একটি র‌্যালি বের হয়। র‌্যালিটি বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে এসে কর্মশালায় মিলিত হয়। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসন এসব কর্মসূচির আয়োজন করে।