যেভাবে জানুয়ারি বছরের প্রথম মাস হলো

54

জানুয়ারি হচ্ছে বছরের প্রথম মাস। এই মাসের মধ্যদিয়ে পৃথিবীব্যাপী শুরু হয় নতুন একটি বছর। আর যে ক্যালেন্ডার বা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী এ বছর গণনা করা হয়, তাকে আমরা সাধারণত ইংরেজি ক্যালেন্ডার বলেই জানি। ইংরেজি বছর শুরু এখন ১ জানুয়ারি থেকে ধরা হলেও বিষয়টি সবসময় এরকম ছিল না। তাহলে কেমন ছিল? এই নিয়ে বিস্তারিত জানা যাক। চলতি বিশ্বের বেশিরভাগ অঞ্চলে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার ব্যবহার করা হয়। এই ক্যালেন্ডার অনুযায়ী জানুয়ারিকে প্রথম মাস ধরা হয়। অতীতে বিভিন্ন সময়ে বছর শুরু হতো। যেমন ২৫ মার্চ, ২৫ ডিসেম্বর। রোমানরা এই ধারায় পরিবর্তন আনেন।

তাদের ক্যালেন্ডারে মোট মাস ছিল ১০টি। আর সেখানে বছর শেষ হতো ৩০৪টি দিন দিয়ে। শীতকালকে তারা মাস বিবেচনা করতো না। রোমুলাসের উত্তরসূরি রাজা নুমা পম্পিলিয়াস প্রায় ৭১৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এতে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাস যোগ করেছিলেন বলে ইতিহাসে উল্লেখ আছে।  এর ফলে ক্যালেন্ডারটি একটি আদর্শ চন্দ্র বছর অর্থাৎ ৩৫৪ দিন পূর্ণ করে।

পুরনো রোমান ক্যালেন্ডারের হিসেব পাল্টে যায়। বছর শুরুর মাস মার্চ থেকে জানুয়ারিতে রূপান্তরিত হয়। ধারনা করা হয়, নুমা কিংবা মতান্তরে ডিসেমভিয়ারদের অধীনে ক্যালেন্ডারে বছরের প্রথম মাস হয়ে ওঠে জানুয়ারি।

জানুয়ারির নামকরণ করা হয়েছিল রোমান দেবতা জানুসের নামানুসারে। এর দেবতাকে সব কিছুর শুরুর দেবতা হিসেবে ধরা হয়। অন্যদিকে মার্চ এসেছে তাদের যুদ্ধের দেবতা মার্স-এর নামানুসারে।

জুলিয়ান ক্যালেন্ডার

তার ওপর ক্যালেন্ডারের তত্ত্বাবধান করতো পোন্টিফিস নামক একটি রোমান সংস্থা। তাদের বিরুদ্ধে প্রায়ই রাজনৈতিক ক্ষমতার সময় বাড়ানো কিংবা নির্বাচনে হস্তক্ষেপের জন্য দিন যোগ করে কর্তৃত্বের অপব্যবহারের অভিযোগ উঠতে শুরু করে। ৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে জুলিয়াস সিজার রোমান ক্যালেন্ডারে কিছু পরিবর্তন নিয়ে আসেন।  যা জুলিয়ান ক্যালেন্ডার হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি লাভ করে।

আলেকজান্দ্রিয়ান জ্যোতির্বিজ্ঞানী সোসিজেনেসের সহায়তায় এই ক্যালেন্ডার তৈরি হয়। তিনি সিজারকে মিশরীয়দের মতো চন্দ্র চক্র অনুসরণ সম্পূর্ণভাবে বাদ দিয়ে সৌর বছর অনুসরণের পরামর্শ দেন। তখন বছরকে মোট ৩৬৫ যোগ ১/৪ দিন হিসেবে গণনা করা হয়। এর সঙ্গে সিজার ৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দের সঙ্গে ৬৭ দিন যোগ করে তাকে ৪৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ করেন। তিনি সেখানে ১ জানুয়ারিকে বছরের শুরুর তারিখ হিসেবে চিহ্নিত করেন। রোমান সাম্রাজ্যের বিস্তার কালে এই ক্যালেন্ডার অধিক গ্রহণযোগ্যতা পায়। কিন্তু সেখানেও থেমে থাকে না ইতিহাস। ৫ম শতাব্দীতে রোমের পতন ঘটে। এরপরে খ্রিস্টান দেশ ক্যালেন্ডারে কিছু পরিবর্তন নিয়ে আসে। সেখানে খ্রিষ্ট ধর্মের প্রতিফলন অধিক দেখা দেয়। নববর্ষের প্রথম দিন হয়ে ওঠে ২৫ মার্চের দ্য ফিস্ট অফ দ্য অ্যানানসিয়েসনের তারিখ এবং ২৫ ডিসেম্বর।

গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার: বলা হয়, জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে কিছু ত্রুটি ছিল। এতে লিপ ইয়ার বা অধিবর্ষ সংক্রান্ত কিছু ভুল গণনা ছিল। সমস্যা সমাধানে কিছু পরিবর্তন অত্যাবশ্যক হয়ে উঠে। কেননা কয়েক শতাব্দী ধরে এই ত্রুটির ক্রমবর্ধমান প্রভাবের ফলে মৌসুম নির্ধারণে ভুল হয়। এবং নানাবিধ সমস্যা দেখা দেয়।

জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের পরিবর্তন এবং প্রতিস্থাপন করতে চালু করা হয় বর্তমানের গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারটি। এটি ১৫৮২ সালের অক্টোবরে পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি দ্বারা সংশোধিত এবং প্রবর্তিত হয়। অধিবর্ষের সমস্যা সমাধান হয়ে গেলে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার আবার ১ জানুয়ারিকে নতুন বছরের শুরু হিসেবে পুনরুদ্ধার করে।

ইতালি, ফ্রান্স এবং স্পেন সেই দেশগুলোতে নতুন ক্যালেন্ডারটি সমাদৃত হয়। কিন্তু প্রোটেস্ট্যান্ট এবং অর্থোডক্স প্রধান দেশগুলো এটি বেশ দেরিতে গ্রহণ করে। গ্রেট ব্রিটেন এবং এর আমেরিকান উপনিবেশগুলো ১৭৫২ সাল পর্যন্ত গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসরণ করা শুরু করেনি। এর আগ পর্যন্ত তারা ২৫ মার্চকেই নববর্ষের প্রথম দিন হিসেবে উদযাপন করতো।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খ্রিস্টান প্রধান নয় এমন দেশও গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার ব্যবহার করতে শুরু হয়। তবে এমন অনেক দেশ রয়েছে যেগুলো গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসরণ করার পাশাপাশি নিজস্ব ঐতিহ্যগত বা ধর্মীয় ক্যালেন্ডারও ব্যবহার করেন।

যেমন, বাংলাদেশের নিজস্ব বাংলা ক্যালেন্ডার রয়েছে। যা অনুযায়ী বৈশাখ হচ্ছে প্রথম মাস। ১৯১২ সাল থেকে চীন গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার গ্রহণ করলেও তাদের নিজস্ব চন্দ্র ক্যালেন্ডার অনুযায়ী তারা চীনা নববর্ষ উদযাপন অব্যাহত রেখেছে। এরকম আরও অসংখ্য উদাহরণ পাওয়া যায়।

তবে কিছু দেশ আছে যারা কখনোই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার গ্রহণ করেনি। তারা ১ জানুয়ারি ছাড়া অন্য তারিখেও বছর শুরু করে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, ইথিওপিয়া সেপ্টেম্বর মাসে নববর্ষ উদযাপন করে।

জানা যায়, ব্রিটিশরা এই ক্যালেন্ডার গ্রহণ করেছিল ১৭৫২ খ্রিস্টাব্দে। তখন গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের সঙ্গে আগেকার জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের ব্যবধান হয়ে গিয়েছিল ১১ দিন। তাই ১৭৫২ খ্রিস্টাব্দের ২ সেপ্টেম্বরের পরের দিন ইংরেজদের গণনা করতে হয়েছিল ১৪ সেপ্টেম্বর। আর ইংরেজরা ভারতীয় উপমহাদেশে এই ক্যালেন্ডার প্রচলন করেছিল।

তথ্যসূত্র: এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা, হিস্ট্রি টিভি, উইকিপিডিয়া