গঙ্গা থেকে পদ্মায় ফিরবে বিশ্বকাপ

73

শিরোনামটা মনে ধরে যাওয়ার মতো ছিল।
‘এক স্বপ্ন সত্যি, আরেক স্বপ্ন…’
লেখক শেষ করতে পারেননি। পারেননি বলেই হয়তো এতো বিষণ্নতা দীর্ঘশ্বাস!
হ্রস্ব দিন হয়েছে দীর্ঘ। দীর্ঘ রাত প্রায় অনন্ত। এতকাল বৈশ্বিক ক্রিকেট-সমরের সারমর্ম ছিল এমনই। বাংলাদেশের জন্য ওই দ্বৈরথ কেবলই ব্যর্থতার প্রতিশব্দ। নৈঃশব্দ্যের কালাহলে ডুবে আছে যা ২৪টি বছর! আসিব আসিব করেও স্বপ্ন-প্রজাপতির ডানায় ভর করে অপার্থিব সময় এলো না।

এবার কী আসবে?
প্রশ্নটা মিলিয়ন ডলারের। কিন্তু উত্তরটা স্রেফ বিশ্বাসে মোড়ানো। প্রতিদিন তাতে যোগ হয় নতুন সোনালি পাতা। লেখা হয় আধুনিক রূপকথা। সেই রূপকথায় অনেক আগেই নাবালকত্ব পেরিয়ে যৌবনে পায়চারি করেছে। শেষমেশ এখন পৌঢ়ত্বে সময় কাটানো সাকিব-মুশফিকদের কাছে অধরা বলতে একটিই স্বপ্ন, বৈশ্বিক শিরোপা।

যে শিরোপা ঘুরে গেছে দেশের সবচেয়ে বড় বাস্তবায়িত হওয়া স্বপ্নের দুয়ার পদ্মা ব্রিজ থেকে। মাথা উচুঁ করে থাকা সেই ব্রিজের সামনেই ১১ কিলোগ্রাম ওজনের সেই শিরোপার ফটোসেশন হয়েছে। তাইতো সেই শিরোনামটা বুকে গেঁথে আছে, ‘এক স্বপ্ন সত্যি, আরেক স্বপ্ন…।’

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) বাছাই করে নেয় স্বপ্নের, গৌরবের পদ্মা সেতু। ‘দেশের টাকায় দেশের সেতু’-র যে স্লোগান নিয়ে গড়ে উঠেছে পদ্মা সেতু তা এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে আইকনিক স্থাপনা। কেননা ১২ দশমিক ১১৭ কিলোমিটারের (সড়ক সহ) এই পুরো স্থাপনা প্রস্তুতে কত কাঠখড়ই না পোড়াতে হয়েছে বাংলাদেশকে।

কিন্তু মাঠে নেমেই দেখা দেয় বিপত্তি। বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ আনলে একে একে সব অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠান প্রতিশ্রুতি দেওয়া অর্থায়ন স্থগিত করে। পিছিয়ে যায় নির্মাণকাজ। কিন্তু রাষ্ট্রনায়কের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণায় সব হিসেবনিকেশ পাল্টে যায়। তাইতো এই সেতু শুধু একটি বড় অবকাঠামো নয়, স্বপ্নও নয়; এটি বিদেশি অর্থায়ন ছাড়া প্রথমবারের মতো বাস্তবায়িত বাংলাদেশের একটি ‘মেগা প্রকল্প’। প্রমত্ত পদ্মার বুকে এক টুকরো বাংলাদেশ।

৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই দেশের আরেক বিজ্ঞাপন ক্রিকেট। বাংলাদেশের গর্বের আরেক নাম সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম, তাসকিন আহমেদরা। যারা মাঠে নামলে গোটা বাংলাদেশ এক হয়ে যায়। কাঁধে কাধ মিলিয়ে গ্যালারি উন্মাতাল হয়। টিভির সামনে, রাস্তায় কিংবা চার রাস্তার মোড়ে জটলা পাকিয়ে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া।

ওয়ানডে বিশ্বকাপ যখন দুয়ারে তখন আবারো বড় আশায় বুক বাঁধা শুরু করেছে সমর্থকরা। কিন্তু এই বিশ্বকাপ বাংলাদেশের জন্য দীর্ঘশ্বাসই বটে। দুর্দান্ত ক্রিকেটে কখনো চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া, পরক্ষণেই শত আশায় গুড়ে বালি। ৯৯’তে প্রথম অংশগ্রহণ। উড়তে থাকা পাকিস্তানকে মাটিতে নামিয়ে স্তুতিতে ভেসে যায় গোটা দেশ। এরপর ২০০৩ কেবলই অংশগ্রহণের টুর্নামেন্ট। চার বছর পর ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে প্রথম ম্যাচেই ভারত বধ এবং পরে প্রোটিয়াদের হারিয়ে সমীহ আদায় করে নেয়া। এরপর ব্যর্থতার বৃত্তে ঘুরপাক। ২০১১, ২০১৫ ও ২০১৯ কেবলই ‘‘গো উইথ দ্য ফ্লো’’। বড় সাফল্যগুলো চাপা পড়ে যায় সামগ্রিক ব্যর্থতায়।

ইতিহাস পেছনে পড়ে, রূপকথা নতুন রূপ নেয়। এবার কি সেই রূপকথার জন্ম নেবে, যে গল্প লিখা হবে ইতিহাসের অক্ষয় কালিতে। মাঠের ক্রিকেটে, ২২ গজে নিজেদের শক্তি, সামর্থের সবটুকু ঢেলে দিয়ে একের পর এক পরাশক্তিকে হারিয়ে শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট জিততে পারাই হবে শেষ গন্তব্য। এমন না যে এই গন্তব্যে পৌঁছতে প্রয়োজন ঈশ্বরিক ক্ষমতা কিংবা আলাদীনের চেরাগ। পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেটে বাংলাদেশ হারিয়েছে সবগুলো দলকে। নিকট অতীতে কেবল অস্ট্রেলিয়া বাদে ধরাশয়ী হয়েছে সব দলই। তাই কেউই লাল-সবুজের প্রতিনিধিদের সামনে হুমকি নয়। বরং খেয়ালি ইতিহাস কখনো কখনো রোমান্টিক। অতীতের গর্ভ থেকে ফিরে এসে বাস্তব বর্তমানকে রাঙিয়ে দিতে পারে।

ওই পদ্মা সেতুর মতোই এই বিশ্বকাপ কেবল বাংলাদেশের জন্য একটি শিরোপা নয়। বাংলাদেশের আবেগের বড় অংশ নিয়ে হৃদয়ের মণিকোঠায় জায়গা পাওয়া না পাওয়া স্বপ্ন। অধরা অর্জন। যেখানে কোনো ভেদাভেদ নেই, নেই কোনো বৈষম্য। বরং এই শিরোপাটাই ৫৬ হাজার বর্গমাইলকে রংধনুর সাত রঙে রাঙিয়ে দিতে পারে পেছনের সব গ্লানি ভুলে।

প্রথম বৈশ্বিক শিরোপার জন্য অসহ্য অপেক্ষা। অমরত্বের অদৃশ্য পেয়ালা হাতে সাকিবের অন্তহীন প্রতীক্ষা। শুধু এই ট্রফিটা পেয়ে গেলেই হয়তো ইতিহাসে অযুত-নিযুত বছরের জন্য লেখা হয়ে যাবে সাকিব আল হাসানের নাম। বিশ্ব ক্রিকেটে বাংলাদেশের একমাত্র সুপারস্টার পেয়ে যাবেন অমরত্বের স্বীকৃতি। এই দিন ছাড়িয়ে চিরদিনের! সমকাল ছাড়িয়ে মহাকালের!

পদ্মার বুক চিড়ে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার পিচ ঢালাই (মূল সেতু) পথ তৈরি করতে যারা পেরেছে তারা কি পারে না সেই ১১ কিলোগ্রামের ট্রফিটি নিজেদের করে নিতে। অসম্ভব বলতে নিশ্চয়ই কোনো শব্দ বিজয়ীদের অভিধানে থাকার নয়। তাহলেই তো গঙ্গায় থাকা ট্রফি চলে আসে পদ্মায়। এবার শুধু ফটোসেশনই নয়, স্থায়ী হয়ে থাকবে এই বাংলায়। সেটি পারলেই ক্রিকেট কীর্তিতে স্বপ্নের উচ্চতায় পৌঁছে যাবে সময়ের সূর্যসন্তানরা।