মেসি কি প্রত্যাশার চাপেই ভেঙে পড়েছেন?

481

নিঝনি নোভগোরদে বাজছে আর্জেন্টিনার জাতীয় সঙ্গীত। ডানদিক থেকে একে একে ক্যামেরায় উঠে আসছে আর্জেন্টাইন খেলোয়াড়দের চেহারা। সবশেষে এলেন লিওনেল মেসি, তাকে দেখামাত্র কি আঁতকে উঠলেন অনেকে! মাথা একটু নিচু, চোখ বন্ধ, ডান হাত দিয়ে কপাল ঘষছেন। ক্যামেরার লেন্স সামনে বুঝতে পেরে নিজেকে হয়তো লুকাতে চাইলেন মেসি, কিন্তু দৃশ্যটা হয়ে থাকল একটি পুরো জাতির প্রত্যাশার ভারে কারও ‘ভেঙে পড়া’র প্রতীকি ছবি।
বৃহস্পতিবার ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের আগেই দেখা গেল বিধ্বস্ত চেহারার মেসিকে, যার ওপর ৪৪ মিলিয়ন মানুষের প্রত্যাশা। যিনি তাদের আশা পূরণ করতে পারেননি গত বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠেও। চার দশকে প্রথমবার যার হাত ধরে কোনও শিরোপা খরা কাটানোর খুব কাছে গিয়েছিল আর্জেন্টিনা, তিনি আরও দুটি কোপা আমেরিকার ফাইনাল খেলে হলেন ব্যর্থ। অবসর নিয়েছিলেন। কিন্তু আবারও ফেরেন দেশের টানে। আবারও আশা জাগান দলকে খাদের কিনারা থেকে বিশ্বকাপে তুলে। আবারও সেই প্রত্যাশার চাপ! কিন্তু রাশিয়ায় দুই ম্যাচ শেষেও দেখা মিলল না আস্থার প্রতীক মেসিকে।
পায়ে বলই লাগাতে পারলেন না মেসিকিন্তু এমনটা হওয়ার কথা ছিল না, যদি আইসল্যান্ডের বিপক্ষে পেনাল্টিটা মিস না করতেন মেসি। নবাগত দলটির বিপক্ষে আর্জেন্টিনার এই ড্র তার মনের ওপর কতটা যে প্রভাব ফেলেছিল, সেটা বোঝা গেছে একটি রিপোর্টে। গত শনিবার ১-১ গোলে ড্রর পরদিন দলের বারবিকিউ পার্টিতে যোগ দেননি, একাই হোটেল রুমে ছিলেন তিনি।
দ্বিতীয় ম্যাচের আগে টিম বাস যখন নোভগোরদ অ্যারেনায় পৌঁছাল, তখন সবার আগে নেমেছেন মেসি। চেহারায় ছিল না কোনও উচ্ছ্বলতা। সোজা চলে গেছেন ড্রেসিংরুমে। এই নিষ্প্রভ মেসি মাঠেও থাকলেন তেমনই। আইসল্যান্ডের বিপক্ষে ১১ শট নিয়েও গোলের দেখা না পাওয়া মেসিকে এদিন খুঁজেই পাওয়া গেল না।
ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে মেসি বল স্পর্শ করেছেন মাত্র ৪৯ বার, প্রতিপক্ষের বক্সে কেবল দুইবার। পুরো ম্যাচে মেসির শট কেবল একটি, তাও এসেছে ৬৪তম মিনিটে। প্রথম দুই ম্যাচে ১২টি শট নিয়েও গোল করতে পারেননি।
ক্রোয়েশিয়ার আরেকটি গোলে ভেঙে পড়লেন মেসিক্রোয়েশিয়া একেকটা গোল করেছে, আর যন্ত্রণায় কাতর হয়েছেন মেসি। ম্যাচ শেষের বাঁশি বাজার পর কারও সঙ্গে হাত মেলানো নয়, কোনও সৌজন্যতা নয়। সোজা চলে গেছেন টানেলের দিকে, তখন রাজ্যের হতাশায় বুঁদ হয়ে গেছেন তিনি।
এই দুঃসময়ে মেসি পাশে পেয়েছেন তার সাবেক সতীর্থ পাবলো জাবালেতাকে। গত বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলা এই ফুল ব্যাকের মতে, বেশিরভাগ সময় মেসি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন সতীর্থদের কাছ থেকে। তাকে বল দেওয়ার কোনও প্রয়োজন মনে করেননি অন্যরা। জাবালেতা বলেছেন, ‘মেসির জন্য আমার দুঃখ হচ্ছে। আর্জেন্টিনার সঙ্গে শিরোপা জেতার এটাই হয়তো শেষ সুযোগ ছিল তার। সে যদি আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে এখন অবসর নেয়, তাহলেও অবাক হব না।’
গোলপোস্টের সামনে মেসিকে আটকে দিলেন রাকিতিচইংল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক অ্যালান শিয়ারার বলেছেন, ‘আর্জেন্টিনার কোনও পরিকল্পনা ছিল না। মনে হচ্ছিল, তারা টলছে।’
মেসির সাবেক বার্সেলোনা সতীর্থ সেস ফ্যাব্রিগাস আর্জেন্টিনাকে ‘ভাঙা দল’ আখ্যা দিলেন। তাদের টিম স্পিরিট নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন স্পেনের বিশ্বকাপ জয়ী তারকা। তার মতে- ‘একে অন্যের জন্য নয়, আর্জেন্টিনা খেলেছে একে অন্যের বিরুদ্ধে।’ সবশেষে মেসির প্রতি সহানুভূতি জানালেন ফ্যাব্রিগাস, ‘এটা মেসির জন্য কঠিন। তার পেছনে ভালো মানের কেউ নেই। এভার বানেগা কিংবা জিওভানি লো সেলসোর মতো কারও অভাববোধ করেছে সে। তার এমন কাউকে দরকার ছিল, যে তাকে খেলা বানিয়ে দেবে। সবাই চাইবে তার সেরা খেলোয়াড়ের পায়েই যেন বল থাকে, যতটা সময় পারা যায়।’
৩-০ গোলে ক্রোয়েটদের কাছে হারের পর বিশ্বকাপে টিকে থাকতে এই ‘ভেঙে পড়া’ আর্জেন্টিনার সামনে এখন জটিল সমীকরণ। যেমনটা ছিল বিশ্বকাপ বাছাইয়ে। খাদের কিনারায় থাকা সেই দলকে কিন্তু টেনে তুলেছিলেন মেসি, ইকুয়েডরের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করে। প্রত্যাশার চাপে নুয়ে পড়া আর্জেন্টিনা অধিনায়ক প্রায় ৫০ লাখ আর্জেন্টাইন ও বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভক্ত সমর্থকদের আবারও তেমনই ‘নাটকীয়’ কিছু উপহার দেন কিনা সেটারই অপেক্ষা।