মস্তকবিক্রয়

68

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

মহাবস্ত্ববদান
কোশলনৃপতির তুলনা নাই,

জগৎ জুড়ি যশোগাথা ;
ক্ষীণের তিনি সদা শরণ – ঠাঁই
দীনের তিনি পিতামাতা।

সে কথা কাশীরাজ শুনিতে পেয়ে
জ্বলিয়া মরে অভিমানে —
‘ আমার প্রজাগণ আমার চেয়ে
তাহারে বড়ো করি মানে!

আমার হতে যার আসন নীচে
তাহার দান হল বেশি!
ধর্ম দয়া মায়া সকলি মিছে,
এ শুধু তার রেষারেষি।

কহিলা, ‘ সেনাপতি, ধরো কৃপাণ,
সৈন্য করো সব জড়ো।

আমার চেয়ে হবে পূণ্যবান
স্পর্ধা বাড়িয়াছে বড়ো!

চলিলা কাশীরাজ যুদ্ধসাজে —
কোশলরাজ হারি রণে
রাজ্য ছাড়ি দিয়া ক্ষুব্ধ লাজে
পলায়ে গেল দূর বনে।

কাশীর রাজা হাসি কহে তখন
আপন সভাসদ্‌ – মাঝে
‘ ক্ষমতা আছে যার রাখিতে ধন
তারেই দাতা হওয়া সাজে।’

সকলে কাঁদি বলে, ‘ দারুণ রাহু
এমন চাঁদেরেও হানে!
লক্ষ্মী খোঁজে শুধু বলীর বাহু,
চাহে না ধর্মের পানে!’

‘ আমরা হইলাম পিতৃহারা’
কাঁদিয়া কহে দশ দিক —
‘ সকল জগতের বন্ধু যাঁরা
তাঁদের শত্রুরে ধিক্‌!’

শুনিয়া কাশীরাজ উঠিল রাগি —
‘ নগরে কেন এত শোক!
আমি তো আছি, তবু কাহার লাগি
কাঁদিয়া মরে যত লোক!

আমার বাহুবলে হারিয়া তবু
আমারে করিবে সে জয়!
অরির শেষ নাহি রাখিবে কভু
শাস্ত্রে এইমতো কয়।

মন্ত্রী, রটি দাও নগরমাঝে
ঘোষণা করো চারি ধারে —
যে ধরি আনি দিবে কোশলরাজে
কনক শত দিব তারে।’

ফিরিয়া রাজদূত সকল বাটী
রটনা করে দিনরাত ;
যে শোনে আঁখি মুদি রসনা কাটি
শিহরি কানে দেয় হাত।

রাজ্যহীন রাজা গহনে ফিরে
মলিনচীর দীনবেশে,
পথিক একজন অশ্রুনীরে
একদা শুধাইল এসে,
‘ কোথা গো বনবাসী, বনের শেষ,
কোশলে যাব কোন্‌ মুখে ?’

শুনিয়া রাজা কহে, ‘ অভাগা দেশ,
সেথায় যাবে কোন্‌ দুখে !’
পথিক কহে, ‘ আমি বণিকজাতি,
ডুবিয়া গেছে মোর তরী।

এখন দ্বারে দ্বারে হস্ত পাতি
কেমনে রব প্রাণ ধরি!
করুণাপারাবার কোশলপতি
শুনেছি নাম চারি ধারে ,
অনাথনাথ তিনি দীনের গতি,
চলেছে দীন তাঁরি দ্বারে।’

শুনিয়া নৃপসুত ঈষৎ হেসে
রুধিলা নয়নের বারি,
নীরবে ক্ষণকাল ভাবিয়া শেষে
কহিলা নিশ্বাস ছাড়ি,
‘ পান্থ, যেথা তব বাসনা পুরে
দেখায়ে দিব তারি পথ —
এসেছ বহু দুখে অনেক দূরে,
সিদ্ধ হবে মনোরথ।’

বসিয়া কাশীরাজ সভার মাঝে ;
দাঁড়ালো জটাধারী এসে।
‘ হেথায় আগমন কিসের কাজে’
নৃপতি শুধাইল হেসে।

‘ কোশলরাজ আমি বনভবন’
কহিলা বনবাসী ধীরে —
‘ আমার ধরা পেলে যা দিবে পণ
দেহো তা মোর সাথিটিরে।’

উঠিল চমকিয়া সভার লোকে,
নীরব হল গৃহতল ;
বর্ম – আবরিত দ্বারীর চোখে
অশ্রু করে ছলছল।

মৌন রহি রাজা ক্ষণেকতরে
হাসিয়া কহে, ‘ ওহে বন্দী,
মরিয়া হবে জয়ী আমার ’পরে
এমন করিয়াছ ফন্দি!

তোমার সে আশায় হানিব বাজ,
জিনিব আজিকার রণে —
রাজ্য ফিরি দিব হে মহারাজ,
হৃদয় দিব তারি সনে।’

জীর্ণ – চীর – পরা বনবাসীরে
বসালো নৃপ রাজাসনে,
মুকুট তুলি দিল মলিন শিরে —
ধন্য কহে পুরজনে।