বাকরুদ্ধ বেদনায় বাঙালির শোকের শাশ্বত প্রহর ১৫ আগস্ট

146

স্বার্থ ও ক্ষমতার লাগামহীন লিপ্সা, প্রতিহিংসা এবং জিঘাংসা ‘আশরাফুল মখলুকাত’ মানুষকে কখনো পশুর চেয়েও বেশি পাশবিক করে তোলে, তাই বিশ্বের ইতিহাস বারবার রঞ্জিত হয়েছে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের রক্তে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সমগ্র পৃথিবীর মেহনতি এবং শোষিত মানুষকে করেছিল বাকরুদ্ধ। বিশ্বের নিপীড়িত এবং নির্যাতিত মানুষের কণ্ঠস্বরের প্রতীক হিসেবে বঙ্গবন্ধু নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, নিজ মেধা ও যোগ্যতায়- বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন তার বক্তব্যের মর্মার্থ। তিনি অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিলেন, শোষিত মানুষের জন্য আজীবন সংগ্রাম করে যাবেন। আমৃত্যু অসহায় মানুষের আশা ও স্বপ্নের প্রতিধ্বনি হয়ে স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল ছিলেন তিনি। অথচ সেই ক্ষণজন্মা মানুষটিকেই নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে তারই প্রতিষ্ঠিত বাংলায়। নিষ্ঠুর থেকে নিষ্ঠুরতম ছিল পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম সেই নির্মম হত্যাকাণ্ডটি। তাই বেদনায় বাকরুদ্ধ বাঙালির শোকের শাশ্বত প্রহর ১৫ আগস্ট।

২১ ডিসেম্বর ১৯৭৩, সাংবাদিক মাইকেল বার্নস ঘবি ‘New Statesman’ সাময়িকীতে বাংলাদেশের ওপর একটি প্রতিবেদন লিখেছিলেন। প্রতিবেদনটি তার নিজস্ব ধারণামূলক ছিল না; প্রতিবেদনটির বিষয়বস্তু সরেজমিনে সংগৃহীত তথ্যভিত্তিক। কারণ, তিনি বাংলাদেশে এসে সব দেখে-শুনে এবং জেনে-বুঝে, নিজের উপলব্ধি থেকে সত্যভিত্তিক প্রতিবেদনটি রচনা করেছিলেন। যেখানে লেখা হয়েছিল, “আগামী বিপজ্জনক ও জটিল বছরগুলোতে অনেকদিন বাংলাদেশের প্রয়োজন হবে মুজিব-ধরনের নেতৃত্ব” (With a dangerous and difficult few years ahead, Bangladesh is going to need Mujib’s brand of leadership more than ever.)। কিন্তু মাইকেল বার্নস এর প্রত্যাশার বিপরীতে চলছিল খুনিদের ষড়যন্ত্র। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট ঘটানো হয়েছিল ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকান্ড। সেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ ১৭ জনের প্রাণ হরণ করা হয়েছিল।

১৬ আগস্ট, লন্ডন টাইমস-এ সম্পাদকীয় মন্তব্য ছিল, “শেখ মুজিবকে যদি এমন হৃদয়-বিদারকভাবে হত্যা করা হয়, তাহলে স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের প্রয়োজন ছিল না” (If Sheikh Mujib is killed so tragically, There was no need to emerge Bangladesh as a free country)। রাজনৈতিক ব্যক্তিকে হত্যা নজিরবিহীন নয়; কিন্তু স্বজন-পরিজনসহ, এমনকি ১০ বছরের ছোট শিশু রাসেলকে হত্যা, দৃষ্টান্তরহিত। শুধু বঙ্গবন্ধু হত্যা নয়, খুনিদের লক্ষ্য ছিল, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের কোনো চিহ্ন অবশিষ্ট না রাখা। তবে দৈবাৎ বেঁচে গিয়েছিলেন দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।

রাজপথে অনেক আন্দোলন, সংগ্রাম, ত্যাগ এবং শ্রমের বিনিময়ে বারবার মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসে জননেত্রী শেখ হাসিনা এখন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। আর সে কারণে খুনিদের বিচার হয়েছে। খুনিরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের গতিমুখ ফিরিয়ে দেশটাকে ‘ইসলামিক রিপাবলিক’ বানাতে চেয়েছিল। হত্যা পরবর্তী সময়ে বেতারে খুনি ডালিমের ঘোষণাও তা-ই ছিল। মোদ্দা কথা, বাংলাদেশকে তারা পাকিস্তান বানাতে চেয়েছিল; যা সময়ের আবর্তনে সম্ভব হয়নি।

১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের কাছাকাছি একটি দৃষ্টান্ত আছে। ১৮৫৭-এর সেপ্টেম্বর মাসে ইংরেজ কর্নেল হডসন শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহের চার রাজপুত্রকে একসঙ্গে গুলি করে হত্যা করেছিল। বেশ কিছুদিন পর ইংরেজ ইতিহাসবিদ ম্যালেসন ভারতে ইংরেজদের গৌরবগাথা নিয়ে ইতিহাস রচনা করার সময়ে হডসনের হত্যাকান্ড নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন যে, “এটা অপ্রয়োজনীয়, পাশাপাশি অপরাধ” (Unnecessary as well as a crime)। খোদ ইংরেজ ইতিহাসবিদ তার স্বজাতির একজনের অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করেছিলেন এভাবে। চারজনকে হত্যা করার জন্য যদি এমন মন্তব্য হয়, তাহলে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে কেমন মন্তব্য হওয়া উচিত?

কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেন এমন হত্যাকান্ড? প্রশ্নের উত্তরের জন্য তথ্য-দলিল এতদিনে অপ্রতুল নয়। বিশদ কোনো আলোচনায় না গিয়ে চুম্বক কিছু বলা যেতে পারে।

প্রথমত, আত্মস্বীকৃত খুনিরা হিমশৈলর শীর্ষভাগ ছিল; তারা ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করেছিল মাত্র। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারী ছিল, যাদের মধ্যে যোগাযোগ ও সমন্বয় ছিল। দ্বিতীয়ত, বঙ্গবন্ধুর বড় অপরাধ ছিল বাংলাদেশ সৃষ্টির অনুঘটক হওয়া এবং ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি মূল্যবোধে দেশটিকে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা শুরু করা। ৭১ এ মোশতাক, তাহেরউদ্দীন ঠাকুর এবং মাহবুবুল আলম চাষী (গোঁড়া দক্ষিণপন্থি) মার্কিন যোগসাজশে মুক্তিযুদ্ধ বানচাল করতে চেয়েছিল। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমেদের সুদৃঢ় ভূমিকার কারণে উদ্যোগটি ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭২ থেকে শুরু হওয়া ষড়যন্ত্রে যুক্ত করা হয় সেনাবাহিনীর কর্নেল ফারুক ও রশিদকে (যারা মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে পাকিস্তানি অনুচর হিসেবে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিল)। এই ষড়যন্ত্র যে ১৯৭২ থেকে শুরু হয়েছিল তার প্রমাণ ২০০৫-এ অবমুক্ত করা মার্কিন দলিল। দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র চলমান ছিল বঙ্গবন্ধুর হত্যা পর্যন্ত। একই দলিলে ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জিয়াউর রহমানের সম্পৃক্ততার কথাও উল্লেখ রয়েছে ।

বঙ্গবন্ধু কৃষক, শ্রমিক এবং মেহনতি মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার কন্টকাকীর্ণ পথেই অগ্রসর হচ্ছিলেন।
বঙ্গবন্ধু আলজিয়ার্স জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে (৬-৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৩) যা বলেছিলেন, তাতে বিশ্বমোড়লদের হৃৎকম্প শুরু হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, “বিশ্ব আজ দু’ভাগে বিভক্ত, শোষক আর শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে”। এমন বক্তব্যের জন্য ফিদেল ক্যাস্ত্রো বঙ্গবন্ধুকে অভিনন্দিত করে সর্তক করেছিলেন, ‘‘আজ থেকে তোমাকে একটি বুলেট অনুসরণ করবে।’’ অভিজ্ঞ সমাজতন্ত্রী নেতা ক্যাস্ত্রোর কথা মিথ্যা হয়নি।

দেশে ফিরে ১১ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু খবর পেলেন, চিলির আলেন্দেকে হত্যা করা হয়েছে। তিনি তখন বিড়বিড় করে বলেছিলেন, “আমাকে হয়তো আলেন্দের ভাগ্য বরণ করতে হবে।” হয়তো নয়, তাই হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র সম্পর্কে দেশে-বিদেশে অনেকেই তাকে সতর্ক করেছেন; কিন্তু বঙ্গবন্ধুর এক উত্তর- “কোনো বাঙালি আমাকে মারবে না। কোনো বাঙালি আমার দিকে বন্দুক তাক করলে তার হাত কেঁপে যাবে”। উল্লেখ্য, ট্রিগার টিপতে গিয়ে খুনিদের হাত কাঁপেনি। কারণ তারা জন্মসূত্রে বাঙালি হলেও, মন-মানসিকতায় পাকিস্তানি। কোনো বাঙালি বঙ্গবন্ধুকে মারেনি।

উপর্যুক্ত আলোচনায় দেখা যাচ্ছে যে, বঙ্গবন্ধু দেশের কুচক্রী মহল এবং বিশ্বের পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী মোড়লদের কাছে পরিণত হয়েছিলেন সাক্ষাৎ বিভীষিকায়। তাই হয়তো তার দিন ফুরিয়ে এসেছিল। তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র অনিবার্য ছিল। ষড়যন্ত্রই তার মাত্র ৫৫ বছর ৪ মাস ২৯ দিনের অসমাপ্ত জীবন অবসানের কারণ।

১৫ আগস্ট বাংলাদেশে এক অশ্রুময় দিন। ১৯৭৫ সালের এই দিনে বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর এদেশে আদিগন্ত শোক-স্তব্ধতার অমানিশার অন্ধকার নেমে এসেছিল। অশ্রু হয়ে সেই শোক বহুদিন ধরে জ্বলছে। এখন বঙ্গবন্ধুর স্বঘোষিত খুনি আর এই হত্যাকাণ্ডের উসকানিদাতারা কর্পূরের মত হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। পথে-ঘাটে, রাজনীতির মঞ্চে কিংবা টেলিভিশনের পর্দায় ঘাতক এবং তাদের সমর্থকদের রক্তচক্ষু ইদানীং আর দেখতে হয় না। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ৭৫ এর অন্ধকূপ থেকে দেশ ক্রমাগত বেরিয়ে আসছে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছে এটি নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক এবং প্রশান্তির। বাস্তবতার এই পরিবর্তন অবশ্য ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক পালনের প্রাসঙ্গিকতা কোনোক্রমেই সংকুচিত করে না। অবশ্য যে কোনো যুক্তির ভেতরে এ্যাগোনিজম (Agonism) বা প্রতি-তর্কের পরিসর থেকেই যায়।

বাংলাদেশে এখন তিন ধরনের লোক দেখা যাচ্ছে। এক বর্গের লোক বিশ্বাস করে ‘বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশ- বঙ্গবন্ধুই বাঙালি জাতি।’ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অস্তিত্বের সাথে, এর অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের সাথে বঙ্গবন্ধুর সত্তা অবিচ্ছেদ্য। সংবেদনের গভীরতম স্তরে বঙ্গবন্ধু এদের কাছে সেই আর্কিটাইপ (Archetype) বা মূল আদর্শ, যা পিতা বা লৌকিক ঈশ্বরের প্রতীক হিসেবে হাজির হয়।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সাথে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আর মূল্যবোধ, তার সাহস, সংগ্রাম আর অর্জনের সম্পর্ক কোন দিকে মোড় নিচ্ছে সে ব্যাপারে তারা উদ্বিগ্ন থাকে। দ্বিতীয় বর্গের লোকজন দৃশ্যত: বঙ্গবন্ধুর অনুসারী, মুখে বলে বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা, তিনি বাংলাদেশের সমগ্রতার প্রতীক, তার সোনার বাংলা গড়ার ক্ষেত্রে অগ্রসৈনিক হিসেবে কাজ করতে চাই, ইত্যাদি। অন্তর্গতভাবে তারা ভয়ানক এবং ধুরন্ধর। বঙ্গবন্ধুকে এরা ক্ষমতা ও আধিপত্যের উৎস হিসেবে ব্যবহার করে। রাজনীতিতে মূল্যবোধের ধ্বংস প্যাট্রন-ক্লায়েন্ট (Patron-client) মডেলের জনপ্রিয়তা, সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক সচেতনতার অভাব প্রভৃতি কারণে এ ধরনের লোকের সংখ্যা দৃশ্যমানভাবে বেড়ে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর প্রতি এদের সংবেদনশীলতা, আনুগত্য, বঙ্গবন্ধু সংশ্লিষ্ট কাজে এদের সক্রিয়তা এবং অংশগ্রহণ এক ধরনের বিনিয়োগ। এক্ষেত্রে সাম্প্রতিক সময়ে ২টি নতুন প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, যেমন অর্থ বিনিয়োগ এবং ধর্মীয় অনুভূতির বিনিয়োগ। শেষোক্ত ব্যাপারটি যদিও এখনো সংজ্ঞায়নযোগ্যভাবে দৃশ্যমান হয়ে ওঠেনি। তৃতীয় বর্গের লোকজন বঙ্গবন্ধুবিরোধী। বঙ্গবন্ধু এদের কাছে পাকিস্তানের অখণ্ডতা বিনষ্টকারী আর সম্প্রসারণবাদী ভারতের দালাল। প্রধানত এই বর্গের লোকজন স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত, আলবদর, রাজাকার কিংবা ঐসব পরিবারের পরবর্তী প্রজন্ম- বিএনপি, ছাত্রশিবির কিংবা বিভিন্ন ইসলামী জঙ্গি সংগঠনের সদস্য। অতিবাম এবং অতিসাম্প্রতিক সময়ের উগ্র মৌলবাদী ইসলামী নাস্তিকদের অনেকেই এই বর্গভুক্ত। চেতনার মৌলকেন্দ্রে এরা বঙ্গবন্ধু এবং তার রাজনৈতিক মতাদর্শকে ইসলামের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে। এরা বঙ্গবন্ধুর গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশের ধারণা এবং এর ভিত্তি সংশ্লিষ্ট নীতিগুলো জনস্তরে বিস্তার প্রতিরোধ করতে চায়। তাদের মূল সক্রিয়তা বাংলাদেশে দ্বিজাতিতত্ত্ব ভিত্তিক পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করা। এই বর্গীকরণের বাইরেও বাংলাদেশে আরো দুজন মানুষ আছেন, যারা বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের বিশ্বময় সম্প্রসারণে নিয়োজিত এবং যারা বাংলাদেশের গণমানুষের প্রাণের স্পন্দন- শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।

বঙ্গবন্ধু নিজেই একটি প্রতিবেশ বা ইকো সিস্টেম (ecosystem)। তিনি নিজেই আকাশ, নিজেই সূর্য, মৃত্তিকা এবং নিসর্গ। তাঁর নানা ভাব-প্রতিমায় বা ইমেজ নিয়ে এসবের নির্মাণ ঘটেছে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এদেশের ইতিহাসের ভেতর এক দৃশ্য থেকে আরেক দৃশ্যের জন্ম হচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সাথে সাথে এই প্রতিবেশের আবহাওয়া বদলে গেছে। তাঁর জন্ম, তাঁর মৃত্যু, তাঁর অনির্বাণ সংগ্রাম, তার জীবনের প্রতি ঘটনার নিজস্ব স্বর আছে। বাংলাদেশের মানুষ যারা তাকে চৈতন্যের আশ্রয় মনে করে, যারা তাকে নিয়ে আধিপত্যের ব্যবসা করতে চায় কিংবা যারা তার বিরোধিতা করে এই সব স্বর তাদেরও আপন করে নেয়। তিনি যে পিতা, বাংলাদেশের সমগ্রতার প্রতিবিম্ব। দুঃখ শুধু একটাই, বঙ্গবন্ধু সত্তা-বিশ্বের সব অহংকার আর ঐশ্বর্য নিয়েও তাঁর দুটি কন্যার অশ্রু-প্রতীকে রূপান্তরিত হয়। শেখ হাসিনা আর শেখ রেহানা বাংলাদেশের মর্মরিত ইতিহাসের দুটি অশ্রুকণার নাম।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরে যেভাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতিকে হত্যা করা হলো তা কোনো সামরিক অভ্যুত্থান ছিল না। ঘাতকেরা প্রায় সবাই পাকিস্তান ফেরত সামরিক বাহিনীর সদস্য। তাদের কারো হয়তো বঙ্গবন্ধুর প্রতি ব্যক্তিগত ক্ষোভ ছিল। কিন্তু শুধু এর কারণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক, দেশের রাষ্ট্রপতি, সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ককে খুন করা হবে একথা সহজে বিশ্বাস করা যায় না।

গত ৪৮ বছরে জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের কারণ বিশ্লেষণ করেছেন দেশী, বিদেশি সাংবাদিক, লেখক, গবেষক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাতে দেখা যাচ্ছে পাকিস্তান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন- মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী এই তিন অশুভশক্তির বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুবিরোধী আঁতাত। স্থানীয় অপশক্তিগুলোকে কাজে লাগিয়ে নেপথ্যের কুশীলবরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। এসবের ভেতরে সম্ভবত বড় কারণটি অনুল্লেখিত থেকে যাচ্ছে। বাঙালির জাতীয় জাগরণে বৈশ্বিক ক্ষমতা কাঠামোর ভেতরে আধিপত্যের নিয়ামক কেন্দ্রটি আন্দোলিত হয়না । জাতীয় জাগরণ আর জাতীয়তাবোধের ভিত্তিতে রাষ্ট্রগঠন উপনিবেশবাদীরা পছন্দ করেনা। বাংলাদেশ ভূখণ্ডের এ পর্যন্ত ৪ রকমের প্রত্যক্ষ উপনিবেশের অভিজ্ঞতা ঘটেছে, আদিপর্বে হিন্দু উপনিবেশ, মধ্যপূর্বে মুসলিম উপনিবেশ, আধুনিক পর্বে ব্রিটিশ এবং সর্বশেষ পাকিস্তানি উপনিবেশ। এসব উপনিবেশ বাঙালির ঐশ্বর্য, জ্ঞান, বীরত্বের ইতিহাস, আত্মশক্তি আর আত্মসম্মানের বোধ লুণ্ঠন করেছে। বঙ্গবন্ধু উপনিবেশমুক্ত মডেল হাজির করেছিলেন। উপনিবেশের নখরাঘাতে ক্ষতবিক্ষত এদেশের মানুষসহ পৃথিবীর সব শোষিত মানুষের মুক্তির রূপরেখা হতে পারতো তাঁর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচী। তাকে হত্যা করে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিবলয় মুক্তিদায়ী আর আধিপত্যভেদী একটি কণ্ঠ স্তব্ধ করতে চেয়েছে। এর সঙ্গে আরো দুটি তথ্যের প্রতি নজর দেয়া যায়। ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীকেও আততায়ীর হাতে প্রাণ দিতে হয়েছিল। পৃথিবীতে, মহামতি গৌতম বুদ্ধ আর যীশুখ্রিস্টের পর গান্ধী ছিলেন অহিংস মতবাদের তৃতীয় অবতার। অসাম্প্রদায়িক চেতনার এই মহান মানুষটি ছিলেন ভারতের হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, দলিতসহ সকল জনগোষ্ঠীর আস্থার প্রতীক। অসাম্প্রদায়িক চেতনার কারণেই তাঁকে প্রাণ দিতে হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুও রাষ্ট্র আর সমাজের সাম্প্রদায়িকতার অবসান চেয়েছিলেন, ধর্মনিরপেক্ষতাকে একটি রাষ্ট্রীয় মৌলনীতি হিসেবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন।

পিতৃহারা, মাতৃহারা, ভাই আর স্বজনহারা শেখ হাসিনা যখন দেশে ফিরলেন তখন তিনি এক অশ্রুর প্রতিবিম্ব। এতো বাহির থেকে অবলোকন। ভেতরে তার জ্বলন্ত আগুনের চিতা। শোক, আর অন্যদেশে আত্মগোপনে থাকার ক্লান্তিতে বিমর্ষ। খুনিদের অপচ্ছায়া থেকে দেশকে মুক্ত করতে হবে, পিতৃ হত্যার বিচার করতে হবে, এসব প্রতিজ্ঞা ঢেউয়ের মতো বারবার তার কাছে ফিরে এসেছে। এদেশের সাধারণ মানুষকে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, বঞ্চনা থেকে মুক্ত করার জন্য বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ এগিয়ে নিতে হবে, এরকম ইচ্ছের চঞ্চলতাকে অনুপ্রাণিত করেছেন আত্মপ্রত্যয়ে। সাহস তার শরীরে প্রবাহিত বঙ্গবন্ধুর পবিত্র রক্তের উত্তরাধিকার। এই সবটা মিলিয়েই শেখ হাসিনার তখনকার মনোজাগতিক গঠন । পরিণত, দৃঢ়, প্রখর এবং সুদূর লক্ষ্যাভিসারি তার সুদৃঢ় অঙ্গীকার। বঙ্গবন্ধুর মতোই এদেশের আবহমান মনুষ্যত্বের এবং মানবিকতার মূল্যবোধে গঠিত তার বিশ্বাস চেতনা এবং জীবন দর্শন। এদেশের মাটির স্পর্শের মতো তার মমতা, সুজলা নদীর মতো মানুষের কাছ তার দায়বদ্ধতা।

বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে যাদের ভেতরে অসহায়ত্ব আর আত্মপরিচয়ের বিপন্নতাবোধ তৈরি হয়েছিল শেখ হাসিনাকে তারা নতুন আশ্রয় হিসেবে গ্রহণ করলেন। রাজনৈতিক জীবনের সেই ক্রান্তিকালে শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুতে নিবেদিত মানুষের মাঝে তার শক্তির ভিত্তি খুঁজে পেয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষের কাছে তিনি বঙ্গবন্ধুর বিকল্প নন; বঙ্গবন্ধুর সম্প্রসারণ। ১৯৮৩ সাল থেকেই বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী সত্তা অনুসন্ধান, নির্মাণ ও প্রতিষ্ঠার কাজ এগিয়ে নেয়ার শক্তি ও ডানা তিনি নিজেই।

বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশ আর বাঙালি জাতিকে হত্যা করার দুরভিসন্ধি- তাতে কোনো সন্দেহ নেই। জাতির পিতার রক্ত দিয়ে বাংলাদেশের ভিন্ন ইতিহাস লিখতে চেয়েছিল খুনিচক্র। সংবিধান থেকে রাষ্ট্রের ৪টি মৌলনীতির অপসারণ, ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম সরিয়ে রাখা, বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের মহানায়ককে ‘খলনায়ক’ হিসেবে বর্ণনা- ১৫ আগস্ট সম্পর্কে খুনিদের নিজস্ব ডিসকোর্স গড়ে তোলার অপচেষ্টা। পাঠ্যবই, ইতিহাস, গণমাধ্যম এবং ধর্মীয় যোগাযোগের কোনো কোনো প্রকরণ ব্যবহার করে জাতির পুঞ্জিত স্মৃতি (collective memory) তে খুনিরা তাদের বিকৃত রাষ্ট্র-স্বপ্নের অনুকৃতি লেপনে ১৫ আগস্টে বাংলাদেশকে পথভ্রষ্ট করে নতুন পথ পরিক্রমা তৈরি করতে চেয়েছে। কিন্তু ১৫ আগস্টের এই বিকৃত অর্থের স্বতঃস্ফূর্ত বাধাহীন ক্রমবিস্তার সম্ভব ছিল না; দিকবদল ছিল অনিবার্য।

বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ এর মধ্য দিয়ে ৭২-এর সংবিধানের মতো ছেঁড়া-বিব্রত বাংলাদেশ ক্রমান্বয়ে জোড়া লাগতে থাকে। খুনিদের সাজিয়ে তোলা প্রতীক, মিথ, মিথ্যে স্মৃতির সরণি এবং ইতিহাস-আয়োজন ভেঙে পড়ে। জাতির মনস্তাত্ত্বিক সমতলে এটি বঙ্গবন্ধু আর মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় বিজয়।

দেখা যাচ্ছে, স্মরণ আয়োজন থেকে ১৫ আগস্ট ক্রমশ একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে। ১৫ আগস্ট শোক দিবসের সাথে এদেশের মানুষের সংযুক্তির বিষয়টি স্থির কোনো প্যাটার্নের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। সময়ের সাথে সাথে এই সংযুক্তির ধরন বিবর্তিত হচ্ছে। মানুষের যে সমস্ত আচরণ ও অনুশীলন এই দিনটিকে ঘিরে পর্যবেক্ষণ যোগ্য তাতে বোঝা যাচ্ছে এটি একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হচ্ছে। সামাজিক প্রতিষ্ঠান সামাজিক মূল্যবোধের নির্যাস। ১৫ আগস্টকে ঘিরে এক বিশেষ রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছে। যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে এবং সেই ঘৃণিত হত্যাকাণ্ড সমর্থন করেছে তারা এই প্রতিষ্ঠানে এবং এর রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে অংশগ্রহণ করবে না। প্রতিষ্ঠান হিসেবে দিনটি বাংলাদেশের সমাজে একটি বিভাজক। কোন মহলের আপোষহীনতার চালচিত্র নিয়ে যতই কাহিনী তৈরি করা হোক না কেন নতুন প্রজন্মের অনুসন্ধানী মনে ১৫ আগস্ট নিয়ে আগ্রহ বাড়ছে। প্রতিষ্ঠানটিতে ক্রমাগত তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

১৫ আগস্ট কেবল মাত্র সামাজিক প্রতিষ্ঠান নয়, একটি স্মৃতি প্রতিষ্ঠানও (memory institution) বটে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রাক্তন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহে স্মৃতি প্রতিষ্ঠান খোলা হয়েছে। এ সমস্ত প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য হচ্ছে অতীত স্মৃতির সংরক্ষণ ও উজ্জীবন। স্মৃতি আখ্যান (narrative) সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং বুনন এসব প্রতিষ্ঠানের কাজ। আমরা বিশ্বাস করি ১৫ আগস্ট এদেশে স্মৃতি প্রতিষ্ঠান হিসেবেও কাজ করছে। স্মৃতির মধ্যে দুই রকমের শক্তি থাকে। এ দুটো শক্তি দ্বান্দ্বিকভাবে সংস্থিত। একটি শক্তি পুনরাবৃত্তির আরেকটি শক্তি যৌক্তিকতা প্রতিপন্ন করার।

১৫ আগস্ট স্মৃতি প্রতিষ্ঠান আবার স্মৃতি আখ্যানও বটে। এই স্মৃতি আখ্যানের ভেতর দিয়ে ঘটনার অর্থ উৎপাদিত এবং পুনরুৎপাদিত হচ্ছে। বহু মাধ্যম বাহিত হয়ে সমাজের এই বর্গের মানুষের মাঝে এই আখ্যানের সম্প্রসারণ ঘটছে, তৈরি হচ্ছে যৌথ স্মৃতি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর বঙ্গবন্ধুর মূল্যবোধের আলোয় জনস্তরে আদর্শিক সংহতি তৈরি করার জন্য যৌথ চৈতন্য সহায়ক হতে পারে। এ প্রসঙ্গে আরো একটি বিষয়ের প্রতি নজর দেয়া যেতে পারে, ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু তথা বাঙালি জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন হিসেবে আজ নতুন প্রজন্ম এবং বিশ্ববাসীর সঙ্গে কথা বলছে। এই দিনের নানা রকম অনুষঙ্গ, কালো ব্যাজ, পাঞ্জাবি, দেশাত্মাবোধক গান, মুক্তিযুদ্ধের গান, অবশ্যই বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, প্রবন্ধ পাঠ, আলোচনা এইগুলো এখন ১৫ আগস্টের নিজস্ব ভাষা। এভাবে দেখলে বলা যায় ১৫ আগস্ট সমাজের সাথে এক ধরনের সংলাপে অংশগ্রহণ করা বা ইন্টারলোকিউটর (interlocutor)।

১৫ আগস্ট বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর সত্তা-বিশ্বাসকে নিঃশেষে ধ্বংস করার পরিকল্পনা ছিল। এগুলো মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল- বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিজনদের হত্যা, তার প্রধান অনুসারীদের হত্যা, বাংলাদেশের ইতিহাসকে হত্যা, বাংলাদেশের সংবিধান ও রাষ্ট্র চরিত্র হত্যা এবং বাকশাল উৎখাত। এসব হত্যার অভিঘাতে বাংলাদেশ কী হারিয়েছিল তা নির্ণয় করা জরুরি। সবচেয়ে বড় অভিঘাতটি হলো বঙ্গবন্ধুর শূন্যতা। এই শূন্যতার সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভেতরে চেপে বসলো ধর্মান্ধ রাজনীতি, সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ। দেশের মানবিক মূল্যবোধ, নৈতিকতা আর শ্রেয়বোধ বঙ্গবন্ধুর রক্তের স্রোতে ভেসে গেল। বঙ্গবন্ধুর হত্যার মধ্য দিয়ে মনস্তাত্ত্বিক সমতলে দেশটা দু’ভাবে বিভক্ত হলো। আবারো প্রকাশ্যে এলো স্বাধীনতার পক্ষ আর বিপক্ষ শক্তির লড়াই। বাঙালির আত্মপ্রতিষ্ঠার আর অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম ব্যাহত হলো। শুধু তাই নয়, এসব প্রতিষ্ঠানের গোটা চরিত্রেই বদলে গেল।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর চিন্তায় মানুষ, রাষ্ট্রকাঠামো এবং মানুষের সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে স্থান পেয়েছে। তিনি তার ঘোষিত দ্বিতীয় বিপ্লবে কার্যকরী সম্পর্ক তৈরি করেছিলেন। প্রতিনিধিত্বশীল শোষণমূলক গণতন্ত্রের বিপরীতে তার দ্বিতীয় বিপ্লবের কাঠামোগত রূপরেখা মুক্তিদায়ী গণতন্ত্রের মডেল হতে পারতো। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে এসব সম্ভাবনাকেও গলাটিপে হত্যা করা হলো। মানুষ হওয়ার পরিবর্তে ধর্মীয় পরিচয়ে পরিচিত হবার প্রতিযোগিতা বেড়ে গেল। গ্রামে-নগরে যেখানে শুরু হতে যাচ্ছিল সত্যিকারের আত্মনির্ভরশীল হওয়ার উন্নয়নযাত্রা, সেখানে এনজিওদের ভিড় জমে উঠলো, রাষ্ট্রকাঠামো চলে গেল বৈশ্বিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের নিয়ন্ত্রণে।

৭৫ এর পট পরিবর্তনের পর এদেশে মুক্তিযোদ্ধা আর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন নেমে আসে। সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি বাদ যাওয়ায় ধর্মীয় সংখ্যালঘু প্রত্যয়টি সামাজিক ব্যবহারে আবার ফিরে আসে। নিরাপত্তার অভাবে বহু সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী পালাতে থাকে। এই পলায়ন গণতান্ত্রিক সংগ্রামের শক্তিকে দুর্বল করেছে।

বঙ্গবন্ধু হত্যার নেপথ্যের কুশীলব জিয়াউর রহমান নিজের ভাবপ্রতিমাকে বঙ্গবন্ধুর প্রতিদ্বন্দ্বী করে গড়ে তোলার অপচেষ্টা করেছিলেন। তার আস্ফালন ছিল, ” I will make politics difficult.”। তিনি সত্যিই বাংলাদেশের রাজনীতিকে কঠিন করে গেছেন। চাপ ও প্রলোভন দিয়ে নীতিচ্যুত বাম রাজনীতিবিদদের তিনি তার দলে ভিড়িয়েছিলেন, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী ৭১ এর ঘাতক দালালদের রাষ্ট্র ক্ষমতার অংশীদার করেছিলেন। কর্নেল তাহেরসহ বহু দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধাকে ফাঁসি দিয়েছিলেন। এভাবে মহান মুক্তিযুদ্ধের অহংকার, আদর্শ আর সম্ভাবনা প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। স্বাধীন বিবেক আর উদার চিত্ত নিয়ে বাঙালির বিকশিত হবার পথ সংকুচিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাস। এক কথায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ ছিনতাই করা হয়েছিল। কিন্তু আমাদের সবচেয়ে বড় সান্ত্বনা হচ্ছে, ১৫ আগস্টের অনেক সুপ্ত প্রভাব আমরা এখন সময়ের আবর্তনে নতুন করে অনুভব করছি, এগুলোর সম্মিলিত সক্রিয়তার ফলে রাষ্ট্রে, সমাজে, অর্থনীতিতে এবং সংস্কৃতিতে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও স্বরের ছায়া পড়তে শুরু করেছে। বঙ্গবন্ধুর আয়নায় বাংলাদেশ তার সম্পূর্ণ মুখ দেখার স্তরে এখনো পৌঁছায়নি। অন্যদিকে সহায়তা, বন্ধুত্ব এবং আনুগত্যের ছদ্মবেশে নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের কাজ করে যাচ্ছে একাত্তরের পরাজিত পুরনো শত্রুরা। দেশের শিক্ষা আর সংস্কৃতির ক্ষেত্রে মৌলবাদীদের চাপ ক্রমশ বাড়ছে। আমলারা নিয়ন্ত্রণ করতে চাচ্ছে দেশের সকল রকম নীতিকাঠামো।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রায় অর্ধ শতাব্দী অতিক্রান্ত হয়েছে, দীর্ঘ ২০ বছরের সামরিক শাসন আর রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থা, রাজনীতি এবং সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে, মেধা ও মননে, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির বিস্তার এবং মুক্তিযুদ্ধের নামে তার বিপরীত মূল্যবোধের কার্যকলাপের সমারোহ গণতন্ত্রের অভিযাত্রাকে করেছিল পথ হারা, ঘূর্ণিপাকে বিপর্যস্ত। বঙ্গবন্ধুকে যারা হত্যা করেছিল তারা প্রকারান্তরে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকেই হত্যা করতে চেয়েছিল। হত্যা করতে চেয়েছিল এদেশের মানুষের গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষাকেই। আজ শঙ্কা জাগে যখন দেখি যাদের চেতনা বাংলাদেশের স্বরূপ সন্ধানে শাণিত নয় বঙ্গবন্ধুর আদর্শ যাদের কাছে মূলত স্বার্থসিদ্ধির মূলমন্ত্র, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় “চতুর্দিকে তারাই আজকে এসেছে ভক্ত সাজি”। ১৫ আগস্ট এর বেদনার সঙ্গে এই বেদনার বিউগলও বুকে বাজে। দেশে, সারা বিশ্বে, এখন যে বঙ্গবন্ধু – নান্দীপাঠ চলমান, তখন বঙ্গবন্ধু বিহীন বাংলাদেশে স্মরণ করতে হয় মহাত্মা গান্ধীর ৭০তম জন্মবার্ষিকীতে আইনস্টাইনের উক্তির শেষ বাক্যটি, “আগামী প্রজন্মগুলো সম্ভবত এটা বিশ্বাসই করতে চাইবে না যে, এমন একজন মানুষ এ ধরণীতে বিচরণ করেছিল” (Generations to come, it may be, will scarcely believe that such a one as this ever walked upon this earth.)।

কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি, আগামী প্রজন্মও শ্রদ্ধাভরে বিশ্বাস ও স্মরণ করবে যে, বঙ্গবন্ধুর মতো একজন প্রবাদ প্রতিম মানুষ সবুজ-শ্যামল বাংলাদেশের মাটিতে একদিন বিচরণ করেছিলেন।

ড. আব্দুল ওয়াদুদ