গল্প-শিউলিমালা-পদ্ম-গোখরো- কাজী নজরুল ইসলামের

21

আরিফের উদ্যত যষ্টি হাতেই রহিয়া গেল। জঙ্গলের মধ্যে পদ্ম-গোখরোরূপী বাস্তু সাপ অদৃশ্য হইয়া গেল। সকলে চলিয়া আসিতেছিল। জোহরা আরিফকে আড়ালে ডাকিয়া বলিল, ‘তোমরা যখন সাপটাকে খোঁচাচ্ছিলে, তখন কেমন একরকম শব্দ হচ্ছিল। ওখানে নিশ্চয়ই কাঁসা বা পিতলের কোনো কিছু আছে।’ আরিফের চক্ষু আনন্দে উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। সে আসিয়া তাহার পিতাকে বলিতে তিনি প্রথমে বিশ্বাস করিলেন না। বলিলেন, ‘কই রে, সেরকম কোনো শব্দ তো শুনিনি।’ আরিফ বলিল, ‘আমরা তো সাপের ভয়েই অস্থির, কাজেই শব্দটা হয়তো শুনতে পাইনি।’ পিতা-পুত্রে সন্তর্পণে দেওয়ালের দুই চারটি ইট সরাতেই দেখিতে পাইলেন, সত্যই ভিতরে কী চকচক করিতেছে। পিতা-পুত্র তখন পরম উৎসাহে ঘন্টা দুই পরিশ্রমের পর যাহা উদ্ধার করিলেন, তাহাকে যক্ষের ধন বলা চলে না, কিন্তু তাহা সামান্যও নয়। বিশেষ করিয়া তাহাদের বর্তমান অবস্থায়। একটি নাতিবৃহৎ পিতলের কলসি বাদশাহি আশরফিতে পূর্ণ। কিন্তু এই কলসি উদ্ধার করিতে তাহাদের জীবন প্রায় বিপন্ন হইয়া উঠিয়াছিল। কলসি উদ্ধার করিতে গিয়া আরিফ দেখিল, সেই কলসির কন্ঠ জড়াইয়া আর একটা পদ্ম-গোখরো। আরিফ ভয়ে দশ হাত পিছাইয়া গিয়া বলিয়া উঠিল, ‘ওরে বাপরে! সাপটা আবার এসেছে ওইখানে।’ জোহরা অনুচ্চ কন্ঠে বলিল, ‘না, ওটা আর একটা। ওটারই জোড়া হবে বোধ হয়। প্রথমটা ওই দিকে চলে গেছে, আমি দেখেছি।’ কিন্তু, এ সাপটা প্রথমই হোক বা অন্য একটা হোক, কিছুতেই কলসি ছাড়িয়া যাইতে চায় না। অথচ পদ্মা-গোখরো মারিতেও নাই। কলসির কন্ঠ জড়াইয়া থাকিয়াই পদ্ম-গোখরো তখন মাঝে মাঝে ফণা বিস্তার করিয়া ভয় প্রদর্শন করিবার চেষ্টা করিতেছে। জোহরার মাথায় কী খেয়াল চাপিল, সে তাড়াতাড়ি এক বাটি দুধ আনিয়া নির্ভয়ে কলসির একটু দূরে রাখিতেই সাপটা কলসি ত্যাগ করিয়া শান্তভাবে দুগ্ধ পান করিতে লাগিল। জোহরা সেই অবসরে পিতলের কলসি তুলিয়া লইল। সাপটা অনায়াসে তাহার হাতে ছোবল মারিতে পারিত, কিন্তু সে কিছু করিল না। এক মনে দুগ্ধ পান করিতে করিতে ঝিঁ ঝিঁ পোকার মতো এক প্রকার শব্দ করিতে লাগিল। একটু পরেই আর একটা পদ্ম-গোখরো আসিয়া সেই দুগ্ধ পান করিতে লাগিল। জোহরা বলিয়া উঠিল, ‘ওই আগের সাপটা! এখনও গায়ে খোঁচার দাগ রয়েছে! আহা, দেখেছ কী রকম নীল হয়ে গেছে!’ আরিফ ও তাহার পিতামাতা অপার বিস্ময়ে জোহরার কীর্তি দেখিতেছিল। ভয়ে বিস্ময়ে তাহাদেরও মনে ছিল না যে, তাহাকে এখনই সাপে কামড়াইতে পারে! এইবার তাহারা জোর করিয়া জোহরাকে টানিয়া সরাইয়া আনিল। কলসিতে সোনার মোহর দেখিয়া আনন্দে তাহারা জোহরাকে লইয়া যে কী করিবে, কোথায় রাখিবে – ভাবিয়া পাইল না। শ্বশুর শাশুড়ি অশ্রুসিক্ত চোখে বারে বারে বলিতে লাগিলেন, ‘সত্যিই মা, তোর সাথে মির-বাড়ির লক্ষ্মী আবার ফিরে এল!’ কিন্তু এই সংবাদ এই চারটি প্রাণী ছাড়া গ্রামের আর কেহ জানিতে পারিল না। সেই মোহর গোপনে কলিকাতায় গলাইয়া বিক্রয় করিয়া যে অর্থ পাওয়া গেল, তাহাতে বর্তমান ক্ষুদ্র মির-পরিবারের সহজ জীবনযাপন স্বচ্ছন্দে চলিতে পারিত। কিন্তু বধূর ‘পয়’ দেখিয়াই বোধ হয় – আরিফ তাহারই কিছু টাকা লইয়া কলিকাতায় আসিয়া কয়লার ব্যাবসা আরম্ভ করিয়া দিল। ব্যবসায় আশার অতিরিক্ত লাভ হইতে লাগিল। বৎসর দুয়েকের মধ্যে মির-বাড়ির পুরাতন প্রাসাদের পরিপূর্ণ রূপে সংস্কার হইল। বাড়ি-ঘর আবার চাকর-দাসীতে ভরিয়া উঠিল। পরে কর্পোরেশনের কনট্রাক্টরি হস্তগত করিয়া আরিফ বিপুল অর্থ উপার্জন করিতে লাগিল। কোনো কিছুরই অভাব থাকিল না, কিন্তু জোহরাকে লইয়া তাহারা অত্যন্ত বিপদে পড়িল। চলবে….