ধূমপান থেকে মুসলিমকে বিরত থাকতে হবে

92

ধূমপান মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। বর্তমান সমাজে ধূমপানের সঙ্গে সম্পৃক্ত বহু মানুষের দেখা পাওয়া যায়। অথচ ‘ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর’ উক্তির সঙ্গে মানবসমাজ বেশ পরিচিত। তারপরও ধূমপানের প্রতি আসক্তির কমতি নেই। এর মাধ্যমে মানুষের সুন্দর শরীর যেমন দিনের পর দিন অসুস্থ শরীরে পরিণত হয়; তেমনই মৃত্যুর দিকে ঝুঁকে পড়ে। ধূমপান নামক এ বদ অভ্যাসের সঙ্গে অনেক মুসলিমও জড়িত আছে। ইসলামি শরিয়াহ বিশেষজ্ঞদের মতে, ধূমপান থেকে বিরত থাকা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য আবশ্যক। কেননা ধূমপানে সম্পৃক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির শারীরিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতি থেকে শুরু করে ব্যক্তিজীবনে নৈতিকতার অধঃপতন ঘটে।

শারীরিক ক্ষতি
ধূমপান মানব শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ও উপকারী নয় বরং অত্যন্ত ক্ষতিকর। ধূমপায়ীরা ব্যক্তিজীবনে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে পারেন না। বিশ্বে যত লোকের মৃত্যু ঘটে, তার মধ্যে দ্বিতীয় প্রধান কারণ হচ্ছে ধূমপান। গবেষকদের মতে, ‘সিগারেটের একটি টানে তিন হাজারেরও বেশি রাসায়নিক পদার্থ মানব শরীরে প্রবেশ করে।’ বিড়ি-সিগারেটের মধ্যে থাকা তামাক ও নিকোটিন অত্যন্ত ক্ষতিকর। কেননা এগুলো মানুষকে নেশাগ্রস্ত করে। অথচ ইসলামে নেশাজাতীয় দ্রব্য গ্রহণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, وَكُلُّ مُسْكِرٍ حَرَامٌ
অর্থাৎ আর যা নেশা উদ্রেক করে তা-ই নিষিদ্ধ। (সহিহ মুসলিম: ৫১১৪)

ধূমপানের কারণে সৃষ্ট সবচেয়ে ক্ষতিকর রোগ হলো ক্যানসার। ধূমপানের কারণে ফুসফুসে, জিহ্বায়, কিডনি ও মুখের ক্যানসারসহ সব রকমের ক্যানসার হওয়ার সম্ভবনা থাকে। গবেষণায় দেখা যায়, সিগারেট-বিড়িতে ৬৫ ধরনেরও বেশি ক্যানসার সৃষ্টিকারী পদার্থ থাকে। এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার মাধ্যমে মানুষ মৃত্যুর দিকে পতিত হয়। কেননা এটি জটিল রোগ। ফলে ধূমপানের মাধ্যমে মানুষ নিজেই নিজের জীবনকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অথচ এ ব্যাপারে সতর্ক করে আল্লাহ্ বলেন, وَلَا تُلۡقُوۡا بِاَیۡدِیۡکُمۡ اِلَی التَّهلُکة
অর্থাৎ তোমরা নিজ হাতে নিজেকে ধ্বংসের দিকে প্রসারিত করো না। (সুরা বাকারা: ১৯৬)

এছাড়া ধূমপানের কারণে মানব শরীরে নানাবিধ রোগ সৃষ্টি ও ক্ষতির সম্মুখীন হয়। কারণ ধূমপানের অনিষ্ট শরীরের এক স্থানে সীমাবদ্ধ থাকে না বরং পর্যায়ক্রমে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। যেমন-
১. সিগারেটে থাকা নিকোটিন দ্বারা শরীরের সব টিস্যু ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
২. হাঁপানি, মাথা ব্যথা ও লিভার সিরোসিস রোগ হয়ে থাকে।
৩. ব্রেন স্ট্রোক, নাকের অনুভূতি শক্তির দুর্বলতা ও কণ্ঠনালী ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
৪. ফুসফুসে যক্ষ্মা ও কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়।
৫. চোখ ও দাঁতের ক্ষতি হয়। কখনো কখনো ধূমপায়ীর চোখের পাতাগুলো জ্বলতে থাকে এবং দাঁতগুলো হলুদ বর্ণ ধারণ করে।

অর্থনৈতিক ক্ষতি
ধূমপানের কারণে ব্যক্তি যেমন শারীরিক ক্ষতির সম্মুখীন হন; তেমনই অর্থনৈতিক দিক দিয়েও দুর্বল হয়ে পড়েন। কারণ এর মাধ্যমে অর্থের অপচয় ঘটে। কেননা বিড়ি-সিগারেট কিনতে গিয়ে প্রতিনিয়ত প্রচুর অর্থ অপচয় হয়। ইসলাম অপচয় ও অপব্যয়কে সমর্থন করে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন, انه لا یحبّ الۡمسۡرفِیۡن
অর্থাৎ নিশ্চয়ই আল্লাহ অপব্যয়কারীদের ভালোবাসেন না। (সুরা আরাফ: ৩১)

এছাড়া বিড়ি-সিগারেটের পেছনে প্রতি বছর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কোটি কোটি টাকা ব্যয় করছে। যা সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয়। এমনকি ধূমপানের ফলে সৃষ্ট নানা রোগে যুবসমাজ আক্রান্ত হয়ে প্রতিনিয়ত চিকিৎসা খাতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করছে। অপরিণত বয়সে মৃত্যুবরণ করছে। যেমন ক্যানসার রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে গ্রামীণ পরিবেশে থাকা অনেকে নিজের সহায়-সম্বল বিক্রি করে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। অথচ ধূমপানে যদি সম্পৃক্ত না হতো, সুস্থ-সুন্দর জীবন উপভোগ করতো।

ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি
ইসলাম ধূমপান পরিত্যাগে উৎসাহ দিয়েছে। সর্বাবস্থায় ধূমপান পরিত্যাগ করা মুসলমানের জন্য আবশ্যকীয় কর্তব্য। যা একজন ব্যক্তির তাকওয়ার পরিচায়ক। প্রথম যুগের আলেমরা ধূমপানকে মাকরুহ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তবে সমসাময়িক যুগের অধিকাংশ আলেমের মতে, ধূমপান করা নাজায়েজ। অনুরূপ ধূমপানের ব্যবসাও মাদকদ্রব্যের মতো নাজায়েজ। যদিও কুরআন-হাদিসে এ ব্যাপারে সরাসরি নিষেধাজ্ঞা নেই। তবে ইসলামি শরিয়ার অন্যতম মূলনীতি হচ্ছে, “রাসূলুল্লাহ (সা,)-এর যুগে বিদ্যমান না থাকার কারণে যেসব বিষয়ে তাঁর সুস্পষ্ট নির্দেশনা পাওয়া যায় না, সে বিষয়ে তাঁর অন্য নির্দেশনার আলোকে ইজতিহাদ করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।” এজন্য শায়েখ বিন বায (রহ.)-সহ অনেকেই ইজতিহাদ করে ধূমপান হারাম হওয়ার মত পোষণ করেছেন। কেননা এর মধ্যে ক্ষতিকর পদার্থ আছে। অথচ ইসলাম সব ক্ষতিকর ও অপবিত্র বস্তু হারাম ঘোষণা করেছে। কারণ ধূমপান হচ্ছে নিকৃষ্ট কাজ এবং এর মাধ্যমে মানুষের ক্ষতিসাধন হয়। অথচ এ ব্যাপারে অনেকেই গুরুত্ব দেন না। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ویُحِلّ لَهمُ الطّیّبٰتِ ویُحَرّمُ عَلَیۡهمُ الۡخَبٰئِث
অর্থাৎ তিনি তাদের জন্য পবিত্র বস্তু হালাল করেন আর অপবিত্র বস্তু হারাম করেন। (সুরা আরাফ: ১৫৭)

আবার অনেকে মনে করেন, ধূমপানের মাধ্যমে ক্লান্তি ও টেনশন দূরীভূত হয় এবং মানসিক শান্তি পাওয়া যায়। অথচ ধূমপানের মাঝে এসব কিছুই নেই। বরং আল্লাহর জিকির তথা স্মরণের মাঝে আত্মিক প্রশান্তি নিহিত আছে। আল্লাহ্ তায়ালা বলেন, اَلَا بِذِکۡرِ اللّٰه تَطۡمَئِن الۡقلوبُ
অর্থাৎ জেনে রাখো, আল্লাহ্ তায়ালার স্মরণেই অন্তর প্রশান্তি পায়। (সুরা রা’দ: ২৮)

পাশাপাশি ধূমপানের মাধ্যমে আশেপাশে থাকা অপর মুসলিম ভাই কষ্ট পেয়ে থাকে। এমনকি ধূমপায়ীর মুখের দুর্গন্ধে মানুষ সহসাই বিরক্ত বোধ করে ও অন্যের শরীরে ধোঁয়া প্রবেশের মাধ্যমে ক্ষতি হয়ে থাকে। অথচ একজন মুসলিমের কর্তব্য সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, لا ضرر ولا ضرار
অর্থাৎ নিজের স্বার্থে অন্যের ক্ষতি করবে না, তদ্রুপ পরস্পর কারো ক্ষতি করবে না। (ইবনে মাজাহ: ২৩৪০)

মুসলিমের করণীয়
ধূমপান থেকে বিরত থাকা একজন মুসলিম ব্যক্তির জন্য অত্যাবশ্যক। ইসলামও এ ব্যাপারে নানাভাবে উৎসাহ জুগিয়েছে। এক্ষেত্রে বেশকিছু করণীয় আছে। যেমন-
১. ধূমপান পরিত্যাগে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা এবং এহেন কর্ম থেকে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা। কেননা আল্লাহ বলেন, وَتُوۡبُوۡۤا اِلَی اللّٰه جَمِیۡعًا اَیُّه الۡمُؤۡمِنُوۡنَ لَعَلَّکُمۡ تُفۡلِحُوۡنَ
অর্থাৎ হে মুমিনগণ! তোমরা সবাই আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার। (সুরা আন-নূর: ৩১)

২. বেশি বেশি নামাজ, রোজা ও কুরআন তেলাওয়াত করা। আল্লাহ্ তায়ালা বলেন, اِنَّ هذَا الۡقُرۡاٰنَ یَهدِیۡ لِلَّتِیۡ هیَ اَقۡوَمُ
অর্থাৎ নিশ্চয়ই এই কুরআন সর্বশ্রেষ্ঠ পথ প্রদর্শন করে। (সুরা বনি ইসরাইল: ৯)

৩. অসৎ বন্ধু পরিহার করে সৎ ব্যক্তিকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করা। এ ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করে আল্লাহ্ বলেন, وَاصۡبِرۡ نَفۡسَك مَعَ الَّذِیۡنَ یَدۡعُوۡنَ رَبَّهمۡ بِالۡغَدٰوۃِ وَالۡعَشِیِّ یُرِیۡدُوۡنَ وَجۡهه
অর্থাৎ তুমি সর্বদা নিজেকে ওদের সংস্রবেই রাখবে, যারা সকাল-সন্ধ্যায় নিজ প্রভুকে ডাকে একমাত্র তাঁরই সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে। (সুরা কাহাফ: ২৮)

৪. ধূমপানের কথা স্মরণ হওয়া মাত্রই আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করা ও জাহান্নামের শাস্তির কথা স্মরণ করা উচিত। আল্লাহ্ তায়ালা বলেন, وَاِمَّا یَنۡزَغَنَّك مِنَ الشَّیۡطٰنِ نَزۡغٌ فَاسۡتَعِذۡ بِاللّٰه ؕ اِنَّه سَمِیۡعٌ عَلِیۡمٌ
অর্থাৎ শয়তানের কুমন্ত্রণা যদি তোমাকে প্ররোচিত করে, তাহলে তুমি আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করো। তিনিই তো সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ। (সুরা আরাফ: ২০০)

৫. নৈতিক শিক্ষা প্রদান। বর্তমান সমাজব্যবস্থায় এর অভাব বেশ লক্ষ্যণীয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমান সমাজে উঠতি বয়সী তরুণরা ধূমপানের সঙ্গে বেশ সম্পৃক্ত। এর পেছনে যেসব কারণ আছে-
১. পিতা-মাতা কর্তৃক সন্তানের খেয়াল না রাখা।
২. বিড়ি-সিগারেটের বিজ্ঞাপনের ব্যাপক প্রচার।
৩. ধূমপায়ী বন্ধুত্বের প্রভাব।
৪. নৈতিক শিক্ষার অভাব।

এজন্য প্রত্যেক পিতা-মাতার উচিত সন্তানকে বাল্যকালেই ধর্মীয় মূল্যবোধ শিক্ষায় দীক্ষিত করা। কেননা ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া প্রত্যেক মুসলিমের ওপর ফরজ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ
অর্থাৎ জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিমের ওপর ফরজ। (ইবনে মাজাহ: ২২৪)

এ আলোচনা থেকে সহজেই প্রতীয়মান হয়, ধূমপান থেকে বিরত থাকা প্রতিটি মুসলিমের কর্তব্য। এমনকি সিগারেটের ব্যাপকতা, আধুনিককালে সুন্দর ও নৈতিকতাপূর্ণ সমাজ গঠনের অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই ক্ষতিকর ধূমপান নির্মূলে ও সুন্দর সমাজ গঠনে সবার ঐক্যবদ্ধ হওয়া উচিত। আল্লাহ্ সবাইকে তৌফিক দান করুন, আমিন।

লেখক: তরুণ গবেষক ও ইসলামি চিন্তাবিদ।