ছন্নছাড়া জীবনযাপনের বিধান ইসলামের দৃষ্টিতে

44

ইসলাম মানুষকে সভ্য ও সামাজিক হওয়ার নির্দেশ দেয় এবং জনবিচ্ছিন্ন ছন্নছাড়া যাযাবর জীবনের ব্যাপারে নিরুৎসাহ করে। আরবি ভাষায় যাযাবর জীবন বোঝাতে ‘তাআররুব’ ও ‘আরাবিয়্যাতু’ শব্দ ব্যবহৃত হয়। যাযাবররা সাধারণ সমাজ-সভ্যতা ও দ্বিন-ধর্ম থেকে দূরে থাকে। অবশ্য আধুনিককালে যাযাবর সম্প্রদায়ের সংখ্যা যেমন কমছে, তেমনি তাদের ভেতর শিক্ষা ও সচেতনতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
যাযাবর জীবন নিন্দনীয় কেননা যাযাবর যেমন সংগ্রামী, তেমন মানব প্রকৃতির প্রতিকূল।

যাযাবর জীবনের অর্থ : যাযাবর এমন লোকদের বলে, যাদের সুনির্দিষ্ট কোনো বাসস্থান থাকে না। যারা জীবন-জীবিকার তাগিদে নিয়ত ভ্রমণ করতে থাকে। আবদুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি মরুভূমিতে বাস করে, সে কঠিন হয়ে যায় আর যে ব্যক্তি শিকারের পেছনে লেগে থাকে, সে অন্য সব কিছু ভুলে যায়, আর যে ব্যক্তি বাদশাহর সংস্রবে থাকে, সে (দ্বিনিভাবে) ফিতনায় পতিত হয়। (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ৪৩০৯)
অন্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, কবিরা গুনাহ সাতটি : (যার একটি হলো) হিজরতের পর যাযাবর জীবন গ্রহণ করা। (আদাবুল মুফরাদ : ৫৮০)

নিন্দনীয় হওয়া কারণ কোরআন ও হাদিসে জনবিচ্ছিন্ন যাযাবর জীবনের নিন্দনীয় কিছু বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। যেমন—১. দ্বিনি শিক্ষা থেকে দূরে : যাযাবর ও লোকালয় থেকে যারা বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন করে তারা দ্বিনি শিক্ষা থেকে দূরে থাকে। ফলে তাদের ভেতর কপটতা প্রবল থাকে। ইরশাদ হয়েছে, ‘কুফরি ও কপটতায় মরুবাসীরা কঠোরতর; এবং আল্লাহ তাঁর রাসুলের প্রতি যা অবতীর্ণ করেছেন, তার সীমারেখা সম্পর্কে অজ্ঞ থাকার যোগ্যতা এদের বেশি। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ৯৭)
২. বাস্তবতা থেকে দূরে : যাযাবররা জীবনের বাস্তবতা থেকে দূরে থাকে। ফলে তারা জীবন ও দ্বিনের ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘বেদুইনরা বলে, আমরা ঈমান আনলাম। বোলো, তোমরা ঈমান আনোনি, বরং তোমরা বোলো, আমরা আত্মসমর্পণ করেছি। কেননা ঈমান এখনো তোমাদের অন্তরে প্রবেশ করেনি।’ (সুরা : হুজরাত, আয়াত : ১৪)
৩. জীবন-জীবিকার কঠোর সংগ্রাম : যাযাবর ও বেদুইনদের জীবন হয় সংগ্রামী। জীবন-জীবিকার কঠোর সংগ্রামের কারণে তাদের অন্তর কঠোর হয়ে যায় এবং জীবনসংগ্রাম তাদের আল্লাহমুখী হতে দেয় না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি মরুভূমিতে বাস করে, সে কঠিন হয়ে যায় আর যে ব্যক্তি শিকারের পেছনে লেগে থাকে, সে অন্য সব কিছু ভুলে যায়। (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ৪৩০৯)
৪. বিপৎসংকুল জীবন : যাযাবররা সাধারণ নাগরিক সুযোগ-সুবিধা থেকে দূরে থাকে। ফলে তাদের জীবন হয় বিপৎসংকুল। রাসুলুল্লাহ (সা.) লোকালয় থেকে দূরে বসবাসকারীদের সতর্ক করে বলেন, নেকড়ে দলচ্যুত বকরিটিকেই খেয়ে থাকে। (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৫৪৭)
৫. শিক্ষা-সংস্কৃতি থেকে দূরে : যাযাবর জীবনের প্রতি নিরুৎসাহিত করার আরেকটি কারণ হলো, যাযাবররা শিক্ষা-সংস্কৃতি থেকে দূরে থাকে। কাজি ইয়াজ (রহ.) বলেন, লোকালয় থেকে দূরে বসবাসকারীদের অন্তর কঠোর হয় এবং তাদের দয়ামায়া কম থাকে। কেননা মানুষের সঙ্গে মেলামেশা কম হয় এবং জ্ঞান ও জ্ঞানীদের সংস্পর্শ থেকে তারা দূরে থাকে। (মিরকাতুল মাফাতিহ : ৭/২৭৯)

যখন নিন্দনীয় নয় : যে ব্যক্তি বিশেষ অপারগতার কারণে যাযাবরের জীবন বেছে নেয় এবং লোকালয় থেকে দূরে থাকলেও যাদের দ্বিন পালনে কোনো সমস্যা হয় না, তাদের জন্য যাযাবর জীবন নিন্দনীয় নয়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘মরুবাসীদের কেউ কেউ আল্লাহ ও পরকালে ঈমান রাখে এবং যা ব্যয় করে তাকে আল্লাহর সান্নিধ্য ও রাসুলের দোয়া লাভের উপায় মনে করে। বাস্তবেই তা তাদের জন্য আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের উপায়; আল্লাহ তাদের নিজ রহমতে দাখিল করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ৯৯)

মর্যাদা লাভের সুযোগ : দ্বিন পালন তথা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্যের মাধ্যমে যাযাবররাও ইহকাল ও পরকালে মর্যাদা লাভ করতে পারে। মহান আল্লাহ বলেন, যদি তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করো, তবে তোমাদের কর্মফল সামান্য পরিমাণও লাঘব করা হবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা : হুজরাত, আয়াত : ১৪) আল্লাহ সবার জীবনকে সুন্দর করুন। আমিন।