চলতি প্রজন্মের শিল্পীদের কাছে অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন বারী সিদ্দিকী

242

শুয়াচান পাখি, আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি? নিজের এই গানের মতো করেই চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে পড়েছেন খ্যাতিমান সংগীতশিল্পী, বংশীবাদক ও গীতিকার বারী সিদ্দিকী। শত ডাকাডাকি করলেও আর উঠবেন না তিনি। না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন এ সুরসাধক। নিজের গানের মাধ্যমে যিনি মানুষের অনুভূতিকে নাড়া দিয়ে যেতেন প্রতিনিয়তি আজ তার চলে যাওয়ায় অগণিত ভক্তের হৃদয়ে বিষাদ ছড়িয়ে গেলেন। তবে তিনি যে মহামূল্যবান সৃষ্টি রেখে গেছেন তার মাধ্যমে আজীবন বেঁচে থাকবেন, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে, পরিশ্রম করে নিজেকে একটি অন্যরকম জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন বারী সিদ্দিকী।
লোকগানের মহীরুহ হয়ে উঠেছিলেন। চলতি প্রজন্মের শিল্পীদের কাছে অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তবে তার যাত্রাটা খুব সহজ ছিল না। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে বারী সিদ্দিকীই ছিলেন সবার ছোট। তার বয়স যখন তিন কিংবা চার সেই বয়সেই মা’র কাছে তার প্রথম শোনা গান ছিল ‘শাশুড়িরেও কইয়ো গিয়া’। সেই গানের সুর বারীর মনে দাগ কেটে যায় তখনই। বারীর নানা শেখ সাবির সরদ বাজাতেন। আর তার নানীর কাছ থেকেই মা গান শিখেছিলেন। বারীর বয়স যখন পাঁচ তখন বড় ভাইয়ের বাঁশিতে ফু দেয়া তার মধ্যে অন্যরকম আগ্রহের সৃষ্টি করে বাঁশি শেখার প্রতি। বারী তার বাঁশি শেখা এবং গান শেখার দুটোরই উৎসাহ পেয়েছেন তার মায়ের কাছ থেকে। বারী ছোটবেলায় বাঁশি বাজাতেন মূলত বড় ভাইদের নকল করে। তখন পদ্ধতিগতভাবে নেত্রকোনায় বাঁশি শেখার উপায় ছিল না। তাই মাত্র সাত আট বছর বয়সেই মা জহুর-উন-নিসার কাছে গান শেখা শুরু করেন। মার কাছ থেকে জীবনে তিনি প্রথম যে গানটির সুর বাঁশিতে তুলে নিয়েছিলেন সেই সুরটিই তিনি পরবর্তীতে হুমায়ূন আহমেদের ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ চলচ্চিত্রে ব্যবহার করেছিলেন। সেটি ছিল শ্যাম বিচ্ছেদের একটি সুর। কলিটা ছিল এরকম ‘আষ্ট আঙুল বাঁশের বাঁশি/মধ্যে মধ্যে ছ্যাঁদা/ নাম ধরিয়া ডাকে বাঁশি/ কলংকিনী রাধা/। বারী সিদ্দিকী যখন হাইস্কুলে পড়তেন তখন থেকেই তিনি নেত্রকোনায় জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে পদ্ধতিগতভাবে সংগীত শেখা শুরু করেন। তার সংগীতের ওস্তাদ ছিলেন শ্রী গোপাল দত্ত। সে সময় বড় দুই ভাই এবং রফিক মাহমুদ, বিপুল চৌধুরী, দুলাল দত্তনবীশ, হযরত আলীর কাছ থেকেও গানে সহযোগিতা পেয়েছেন। ছোটবেলায় মূলত সংগীতশিল্পী হবারই স্বপ্ন ছিলো বারী সিদ্দিকীর। তার সংগীতে প্রথম ওস্তাদ গোপাল দত্ত হলেও পরবর্তীতে ১৯৮০ সালের দিকে ঢাকায় শুদ্ধ সংগীত প্রসারের একটি অনুষ্ঠানে পরিচয় হয় ওস্তাদ আমিনুর রহমানের কাছে। তিনি ভারত বর্ষের বিখ্যাত বংশীবাদক ওস্তাদ পান্না লাল ঘোষের শিষ্য ছিলেন।
সেই আমিনুর রহমানের বাড়িতে বারী সিদ্দিকী বাঁশিতে তালিম নিতে থাকেন দিনের পর দিন। সেখানে থেকেই তিনি ওস্তাদ তাগাল ব্রাদার্স, প-িত দেবেন্দ্র মুৎসুদ্দী, ওস্তাদ আয়েফ আলী খান মিনকারীর সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। পরবর্তীতে প-িত বিজি কারনাডের কাছে বাঁশি শিখতে তিনি পুনাতে গিয়েছিলেন। এভাবে একসময় বারী শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে বাংলাদেশ রেডিও টেলিভিশনসহ সম্মিলিত একটি যন্ত্রসংগীত প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। এরপর পরই তিনি দক্ষিণ এশীয় সার্ক ফেস্টিভ্যালে যান বাঁশি বাজাতে সরকারি সহযোগিতায়। এরপর ধীরে ধীরে তিনি আরো পরিচিত হয়ে উঠতে লাগলেন। বাঁশি বাজান উচ্চাঙ্গ সংগীত পরিবেশনের সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে। হুমায়ূন আহমেদের এক জন্মদিনের অনুষ্ঠানে তার বাসায় যান বাঁশি বাজাতে। সেখানে বাঁশি বাজানোর পাশাপাশি গানও করেন তিনি। হুমায়ূন আহমেদ তার গান শুনে মুগ্ধ হন। ১৯৯৫ সালে বিটিভির ‘রং-এর বারৈ’ অনুষ্ঠানে প্রথম গান করেন বারী সিদ্দিকী। এরপর পরই হুমায়ূন আহমেদ তাকে ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ চলচ্চিত্রে গান গাইতে বলেন। এ ছবিতে তার গাওয়া গানগুলো ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বারী বলেছিলেন, তার সংগীত জীবনে হুমায়ূন আহমেদের অবদান ও উৎসাহ অনেক। চলচ্চিত্রের গানে আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা পাবার পর পরই বাজারে তার দুটি একক অ্যালবাম আসে। একটি ‘দুঃখ রইলো মনে’ এবং অন্যটি ‘অপরাধী হইলেও আমি তোর’। দুটি অ্যালবামই লুফে নেন শ্রোতারা। বারী সিদ্দিকী সবসময়ই নিজেকে একজন বংশীবাদক হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। ১৯৮০ সালে বারী সিদ্দিকী পেশাগতভাবে বাঁশি বাজানো শুরু করেন। ১৯৮৬ সালে প্রথম বিটিভিতে ‘সৃজন’ অনুষ্ঠানে বাঁশি বাজান। ১৯৯৯ সালে ফ্রান্সে ওয়ার্ল্ড ফ্লুট সম্মেলনে এই উপমহাদেশ থেকে তিনিই প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। এটা ছিল বাংলাদেশের জন্য এক বিরাট অর্জন। একজন গায়ক হিসেবে জনপ্রিয়তা পাবার আগে বারী সিদ্দিকী একজন বংশীবাদক হিসেবে বাঁশি বাজিয়েছেন দু’দশক ধরে। কিন্তু গায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবার পর দেশের বাইরে বংশীবাদক হিসেবে তার সফর কমে যায়। কণ্ঠশিল্পী হিসেবেই তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গিয়েছেন। ব্যক্তিগত জীবনে বারী সিদ্দিকী ১৯৮৬ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ফরিদা ইয়াসমিনের সঙ্গে। এদিকে বারী সিদ্দিকী ‘মাটির পিঞ্জিরা’ নামের একটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি ফেরারি অমিতের নির্দেশনায় ‘পাগলা ঘোড়া’ নাটকেও অভিনয় করেছিলেন। তবে অভিনয় করতেন নিতান্তই অনুরোধে এবং শখের বশে।
দেলোয়ার আরজুদা শরফের কথায় তার সর্বশেষ একক অ্যালবাম ‘নিষিদ্ধ মানুষ’ প্রকাশ হয়েছিল চলতি বছর। এরপর অসুস্থ অবস্থায়ও বেশ কয়েকটি টিভি অনুষ্ঠানেও গেয়েছেন তিনি। তবে অসুস্থতার জন্য এবারের ঢাকা ফোক ফেস্টিভ্যালে অংশ নিতে পারেননি তিনি।