গল্প : শিউলিমালা-পদ্ম-গোখরো

20

কবি : কাজী নজরুল ইসলাম
একদিন প্রত্যুষে সহসা আরিফের পিতা জোহরাকে ডাকিয়া বলিলেন, ‘মা, বহুদিন বাপের বাড়ি যাওনি, তোমার বাবাকে দু-তিনবার ফিরিয়ে দিয়ে অন্যায় করেছি, আজ আরিফ নিয়ে যাবে, তুমি কিছুদিন সেখানে কাটিয়ে এসো।’জোহরা সব বুঝিল, বুঝিয়াও প্রতিবাদ করিল না। নীরবে অশ্রু মোচন করিয়া চলিয়া গেল। যাইবার সময় কিন্তু সাপ দুইটিকে কোথাও দেখিতে পাইল না। আরিফ বধূকে তাহার পিত্রালয়ে রাখিয়া ব্যবসা দেখিতে কলিকাতায় চলিয়া গেল। জোহরার পিতা-মাতা কন্যার নিরাভরণ রূপই দেখিয়া আসিয়াছেন, আজ সে যখন সালংকারা বেশে স্বর্ণকান্তি স্বর্ণভূষণে ঢাকিয়া গৃহে পদার্পণ করিল, দরিদ্র পিতা-মাতা তখন যেন নিজের চক্ষুকে বিশ্বাস করিতে পারিলেন না। কন্যা-জামাতাকে যে কোথায় রাখিবেন ভাবিয়া পাইলেন না। দু-একদিন যাইতে না যাইতে পিতা-মাতা দেখিলেন, কন্যার মুখের হাসি শুকাইয়া গিয়াছে। সে সর্বদা যেন কাহার চিন্তা করে। সকল কথায় কাজে তাহার অন্যমনস্কতা ধরা পড়ে। মাতা একদিন কন্যাকে আড়ালে ডাকিয়া বলিলেন, ‘হাঁরে আরিফকে চিঠি লিখব আসতে? কন্যা লজ্জায় মরিয়া গিয়া বলিল, ‘না মা, উনি তো শনিবারেই আসবেন!’ জামাই আসিল, তবু কন্যার চোখে মুখে পূর্বের মতো সে দীপ্তি দেখা গেল না।
মাতা কন্যাকে বলিলেন, ‘সত্যি বল তো জোহরা, তোর কি জামাইয়ের সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে?’ জোহরা ম্লান হাসি হসিয়া বলিল, ‘না মা! উনি তো আগের মতোই আমায় ভালোবাসেন! বাড়িতে আমার দুটি খোকাকে ফেলে এসেছি, তাই মন কেমন করে।’জোহরার মাতা আরিফের এই হঠাৎ অর্থ প্রাপ্তির রহস্য কিছু জানতেন না। কন্যার যমজ সন্তান হইয়া মারা গিয়াছে এবং ওই বাড়ির প্রথা মতো সেই সন্তান দুইটিকে বাড়িরই সম্মুখের মাঠে গোর দেওয়া হইয়াছে জানিতেন। মনে করিলেন, কন্যা তাহাদেরই স্মরণ করিয়া একথা বলিল। গোপনে অশ্রু মুছিয়া তিনি কার্যান্তরে চলিয়া গেলেন।
দেখিতে দেখিতে ছয় মাস চলিয়া গেল। জোহরাকে লইয়া যাইবার জন্যকেহ কোনো কথা বলে না। জোহরার পিতা-মাতা অপেক্ষাও জোহরা বেশি ক্রুদ্ধ হইল। কী তাহার অপরাধ খুঁজিয়া পাইল না। স্বামী প্রতি শনিবার আসে, কিন্তু অভিমান করিয়াই সে কোনো কথা জিজ্ঞাসা করে না। মাতা কিন্তু থাকিতে পারিলেন না। একদিন জামাতাকে বলিলেন, ‘বাবা! জোহরা তো একরকম খাওয়া-দাওয়াই ছেড়ে দিয়েছে। ওর কি কোনো রোগ বেরামই হল, তাও তো বুঝতে পারছিনে – দিন দিন শুকিয়ে মেয়ে যে কাঠ হয়ে যাচ্ছে।’আরিফের অন্তর কাঁপিয়া উঠিল। বিষাক্ত সাপকে যে-মানুষ এমন করিয়া ভালোবাসিতে পারে, ইহা সে কল্পনাও করিতে পারে নাই। সে ভাবিতে লাগিল জোহরা কি উন্মাদিনী? হঠাৎ তাহার মনে হইল, জোহরার মাতামহ বিখ্যাত সর্প-তত্ত্ববিদ ছিলেন। ইহার মাঝে হয়তো সে সাধনাই পুনর্জীবন লাভ করিয়াছে! ইহার মধ্যে সে বহুবার রসুলপুর গিয়াছে, কিন্তু সাপ দুটিকে জোহরা চলিয়া যাইবার পর দুই একদিন ছাড়া আর দেখিতে পায় নাই। কিন্তু সেই দুই এক দিনই তাহারা কী উৎপাতই না করিয়াছে! তাহা দেখিয়া বাড়ির কাহারও বুঝিতে কষ্ট হয় নাই যে, উহারা জোহরাকেই খুঁজিয়া ফিরিতেছে! উদ্যত-ফণা আশীবিষ! তবু সে কী তাহাদের কাতরতা মিনতি! একবার আরিফ, একবার তাহার পিতা – একবার তাহার মাতার পায়ে লুটাইয়া পড়িতে চায়, আর তাহারা প্রাণভয়ে ছুটিয়া পলায়! আরিফ একথা বধূর কাছে প্রকাশ করে নাই, জোহরাও অভিমানভরে তাহাদের কোনো কথাই জিজ্ঞাসা করে নাই। জামাতা কন্যাকে লইয়া যাইবার জন্য কোনোরূপ ঔৎসুক্য প্রকাশ করিতেছেন না দেখিয়া জোহরার পিতা একদিন আরিফকে বলিলেন, ‘বাবা, জান তো আমরা কত গরিব! মেয়ে তো শয্যা নিয়েছে! দেশে যা দুর্দিন পড়েছে, তাতে আমরা খেতেই পাচ্ছিনে, মেয়ের চিকিৎসা তো দূরের কথা! মেয়েটা এখানে থেকে বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে, তার চেয়ে তুমি কিছুদিনের জন্য ওকে কলকাতার বাড়িতে নিয়ে যাও। তার পর ভালো হলে ওকে আবার রেখে যেয়ো!’ বলিতে বলিতে চক্ষু সজল হইয়া উঠিল।স্থির হইল, আগামীকাল্য সে প্রথমে জোহরাকে কলিকাতায় লইয়া যাইবে, সেখানে ডাক্তার দেখাইয়া একটু সুস্থ হইলে তাহাকে রসুলপুরে লইয়া যাইবে। চলবে …..