গল্প : জহুর ধোপার প্রার্থনা

45

জহুর ধোপার প্রার্থনা

প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ-র একটা গল্প আছে, জহুর ধোপার গল্প। ইংরেজ আমলের কথা। এখন যেমন নানারকম পদক দেয়া হয়, তখন সমাজে ধনীদের নানারকম খেতাব দেয়া হতো। এসব খেতাব ছিল প্রভাবশালী হওয়ার মাপকাঠি। আর খেতাবের বিনিময়ে এই সমাজপতিরা হয়ে যেতেন ইংরেজদের হুকুমের গোলাম।

এরকম এক খানসাহেব ‘খান বাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। টাইটেল নেয়ার জন্যে অনুষ্ঠানে যাবেন। তার কাপড়চোপড় ধুয়ে পরিষ্কার করতে পাঠিয়েছেন ধোপার কাছে। ধোপা তার বাড়ির পাশেই থাকে, অনেকদিনের পুরনো, জহুর ধোপা।

অনুষ্ঠানের দিন খানসাহেব বাড়ির চাকরকে পাঠালেন ধোপার কাছ থেকে তার কাপড় নিয়ে আসার জন্যে।

এদিকে কাপড় দেখে তো তিনি ভয়ংকর ক্ষেপে গেলেন জহুর ধোপার ওপর। কাপড়ের নানান জায়গায় টুটাফাটা, রঙচটা।

এমন সময় তিনি জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখেন জহুর ধোপা তার বাড়ির দিকেই আসছে। খান সাহেবের মাথায় আগুন ধরে গেল। রাগে কাঁপতে কাঁপতে বিরাট এক লাঠি নিয়ে তাড়া করলেন ধোপাকে।

চিৎকার করে বলতে লাগলেন, তুই আমার কাপড়ের বারোটা বাজিয়েছিস, আজকে আমি তোর বারোটা বাজাব।

খান সাহেবের উগ্রমূর্তি দেখে জহুর ধোপা তো হতভম্ব। সে-ও তখন জান বাঁচানোর জন্যে প্রাণপণে দৌড়াতে লাগল। খানসাহেব শেষমেশ তাকে আর ধরতে পারলেন না।

হাঁপাতে হাঁপাতে বসে পড়লেন। পুরনো যা কাপড় ছিল সেগুলো পরে অনুষ্ঠানে গেলেন।

আনুষ্ঠানিকভাবে ‘খান বাহাদুর’ হওয়ার পর যখন বাড়ি ফিরলেন, স্ত্রী তাকে বললেন, খামোখা তুমি এত চিৎকার-চেঁচামেচি করলে। জহুর ধোপা তো তোমার কাপড় নিয়েই এসেছিল।

খান বাহাদুর সাহেব বললেন, তাহলে ঐ রং-ওঠা কাপড়? স্ত্রী বললেন, ওটা ধোপাখানার টেবিলের ওপরে ছিল। তোমার গৃহকর্মী ভুলে ঐ প্যাকেট নিয়ে এসেছে।

স্বাভাবিকভাবে খান বাহাদুরের মনটা দুর্বল হলো।

জহুর ধোপাকে ডেকে বললেন, আমি সত্যিই খুব দুঃখিত, আমি তোমাকে অহেতুক কালকে লাঠি নিয়ে তাড়া করেছি, তুমি আমাকে মাফ করে দিও।

শুনে জহুর ধোপা খানসাহেবের পায়ে পড়ে বলল, হুজুর, আমাকে লজ্জা দেবেন না। মাফ তো আমি অনেক আগেই করে দিয়েছি।

আগেই করে দিয়েছ মানে?

সে বলল, আমার পীর সাহেব বলেন, জহুর, তুমি যদি কাউকে মাফ না করো, তো যখন মারা যাবে তখন তো এগুলো নিয়ে আল্লাহর সাথে দেন-দরবার করতে হবে যে, অমুককে শাস্তি দিতে হবে, অমুকে আমার এই করেছে, সেই করেছে। এই অভিযোগ শুনতে শুনতে তো দেরি হয়ে যাবে। তুমি যা ভালো কাজ করেছ এটার পুরস্কার আল্লাহতায়ালা কখন দেবেন তোমাকে?

তাই এসব বোঝামুক্ত হয়ে তারপরে আল্লাহর কাছে গিয়ে বলবে, হে আল্লাহ! আমার কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। তুমি আমাকে এবার সরাসরি পুরস্কার দিয়ে দাও।