ওরা দুজন কোথায় গেল?

68

ইংরেজি ক্লাসের সময় রিয়াদ আর অন্তর ফিসফিস করে কথা বলছিল। তাদের গলায় গলায় ভাবের কথা সবাই জানে। একে অন্যকে সব কিছুই শেয়ার করে তারা। সব সময় রেলগাড়ির বগির মতো একসঙ্গে থাকে দুজন। একসঙ্গে ক্লাসে বসে। অন্যদের সঙ্গে তেমন মিশতে দেখা যায় না।

ক্লাসে তাদের ফিসফিসানি স্যার লক্ষ না করলেও বাবু, আজহারুল ও রাসেলের চোখ ফাঁকি দিতে পারেনি। ক্লাস শেষ হলেই রিয়াদ ও অন্তরকে ঘিরে ধরল তারা।

বাবু বলল, কী রে! কী নিয়ে এত ফিসফিস করছিলি?এতই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে ক্লাসেও তোরা কথা বলিস? রাসেল চোখ রাঙিয়ে বলল।

মুখ চাওয়াচাওয়ি করে রিয়াদ আর অন্তর। কিছুটা ইতস্তত দেখায় তাদের। বোঝা যাচ্ছে কিছু লুকাতে চায়।

রিয়াদের বুঝে নিতে একটু সময় লাগল। তারপর অন্তরের কথাটা জোরালো করতে বলল, ‘হ্যাঁ, তা-ই তো। প্রাইভেট নিয়েই তো কথা বলছিলাম।’

তারপর দুজন চলে গেল ক্যান্টিনের দিকে।

বাবু নিচের ঠোঁট কামড়ে বলল, ‘ইংরেজি ক্লাসের সময় কেউ অঙ্কের কথা ভাবে না। ওরা নির্ঘাত মিথ্যা বলছে। যদি ইংরেজি প্রাইভেটের কথা বলত, তা-ও না হয় বিশ্বাস করা যেত। ওরা নিশ্চয়ই কিছু আড়াল করতে চাচ্ছে আমাদের থেকে।’

আজহারুল চুপ করে ছিল এতক্ষণ। সে বিজ্ঞের মতো বলল, ‘ওদের দিকে নজর রাখতে হবে দেখছি। দেখ, ওরা গেছে ক্যান্টিনে। অথচ এই সময় কেউ ক্যান্টিনে খেতে যায় না। সন্দেহ তো তীক্ষ করছে ওরা।’

টিফিন পিরিয়ডে রাসেল, বাবু ও আজহারুল একসঙ্গে খেল। তাদের সঙ্গে যোগ দিল নাঈম। নাঈমকেও খুলে বলল বিষয়টা। অন্তর ও রিয়াদের সম্পর্কে বেশি জানে নাঈম। কাছাকাছি বাড়ি, সে জন্যই কিনা! নাঈম বলল, ‘আমি থাকতে ওরা কিছু লুকাতে পারবে না। চল, কথা বলি ওদের সঙ্গে।’

কিন্তু এরপর সারা স্কুল তন্নতন্ন করে খুঁজেও অন্তর ও রিয়াদকে পাওয়া গেল না। গেল কই ওরা? সন্দেহ তো আরো বাড়ল। পরে জানা গেল, ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে গেছে ওরা।

পরদিন।

টিফিন পিরিয়ড এখন। অন্তর ও রিয়াদ স্কুলের গেট পেরিয়ে রাস্তায় উঠল। তাদের লক্ষ করে পেছন পেছন চুপিচুপি আসছে বাবুরা। আজ একটা বিহিত হবে। অন্তর ও রিয়াদ ঢুকে পড়ল পাশের জঙ্গলটায়। ওরা জঙ্গলে ঢুকল কেন? বাবুরা ভেবে পায় না। জঙ্গলে সচরাচর কেউ যায় না। হেড স্যার কড়া নিষেধ করেছেন। আজ তাহলে হেড স্যারের নিষেধ অমান্য করে ওরা কী করবে জঙ্গলে? বাবুরাও ঢুকে পড়ে সাতপাঁচ না ভেবে।

অন্তর ও রিয়াদ অনেক দূর এগিয়ে যায়। ওরা যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। ওদের গন্তব্য কোথায় কে জানে! জঙ্গলের ভেতর একটা ছোট বাড়ি দেখে থমকে ওঠে বাবুরা। আজহারুল বলে, ‘বাড়ি কিসের এটা? কখনো তো এত দূর পর্যন্ত আসিনি।’

নাঈম বলল, ‘দেখ, দেখ, অন্তর আর রিয়াদ বাড়িটার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। মনে হচ্ছে যা করার এখানেই করবে ওরা।’

রাসেল বলল, ‘শুনেছিলাম জঙ্গলের ভেতর একটা বাড়ি আছে। বহু বছর আগে শমসের ডাকাতের আস্তানা ছিল এটা। ডাকাতি করে সব কিছু এখানে জমা করত। কে জানে হয়তো তেমনই কোনো গুপ্তধনের আশায় ওরা এসেছে আজ।’

ভাঙা জানালার ভেতর দিয়ে অন্তর ও রিয়াদ ঘরে ঢোকে। জানালা দিয়েই দেখা যায় ওরা পায়চারি করছে ঘরের ভেতর। খুঁজছে হয়তো কিছু। হন্যে হয়ে ঘরের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় ছুটছে।

বাবুরা এগিয়ে যায় খানিকটা। তারপর শোনে অন্তর ও রিয়াদের চেঁচামেচি। ভয়ে চিৎকার করে উঠছে ওরা। ব্যাপারটা গুরুতর ভেবে বাবুরা আর নিজেদের আড়ালে রাখেনি। জানালার কাছে গিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখে রিয়াদ ও অন্তর ঘরের এক কোণে ভয়ে জড়সড়। আর যে ভাঙা জানালা দিয়ে ওরা ঘরে ঢোকে, সেখানকার মেঝেতে দুটি সাপ কিলবিল করছে। এখন জানালা দিয়ে বেরোনোর দ্বিতীয় কোনো পথ নেই। সাপ দুটি বিষধর, তাতে সন্দেহ নেই। ইয়া বড় বড়।

বাবুদের দেখে অন্তর ও রিয়াদ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। কিন্তু বেরোনোর উপায়? তাদের উদ্ধারের আশ্বাস দিয়ে বাবুরা গেল দরজার কাছে। দরজায় তালা লাগানো। শক্ত কাঠের দরজা রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ে যেন আরো শক্ত হয়ে গেছে। ভাঙার চেষ্টা করে লাভ নেই জেনেও রাসেল হাত লাগায়।

একটু পর নাঈম গাছের ডাল দিয়ে চাড়ি মেরে তালাটা ভেঙে ফেলে। তারপর অন্তর ও রিয়াদ বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। ভয়ে নীল বর্ণ হয়ে গেছে যেন।

একা একা বুদ্ধি করে কোথাও যাওয়া ঠিক নয়, আজহারুল বলল।

‘এমন একটা ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় তোরা দুজন এলি। আমরা না থাকলে আজ কী হতো ভাবতে পারিস?’ বাবু শাসিয়ে বলে। রিয়াদ বলল, ‘এসেছিলাম গুপ্তধনের সন্ধানে। ভেবেছিলাম পরিত্যক্ত বাড়িতে হয়তো মূল্যবান কিছু পাওয়া যাবে।’

জঙ্গলের ভেতর এমন পরিত্যক্ত বাড়িতে সাপই প্রধান গুপ্তধন। হেসে রাসেল বলল।

অন্তর কাঁচুমাচু করে বলল, ‘গল্পের বইয়ে তো প্রায়ই পড়ি এমন গুপ্তধনের কথা। তাই আজকে সাহস করে…।’

একা একা থেকে ভালো কিছু করতে পারবি না। এখনো সময় আছে সবার সঙ্গে মিশতে শিখ। সবার সঙ্গে সব শেয়ার কর। বন্ধুত্বের গণ্ডি বাড়া। এই বলে নাঈম হনহন করে হাঁটতে শুরু করল। তাকে অনুসরণ করে চলল বাবু, আজহারুল ও রাসেল। রিয়াদ ও অন্তর তাকিয়ে থাকল তাদের দিকে।