একদিন সিংহ সাম্রাজ্যে

51

৮ অক্টোবর ২০২৩, বেলা ১১টা। শ্রীলঙ্কার ডাম্বুলা শহরের পাশের গ্রাম সিগিরিয়াতে বাস থামতেই বিপত্তি৷ নিরাপত্তারক্ষীর কাছে জানা গেলো, বিদেশি নাগরিকদের পাসপোর্টের মূল কপি ছাড়া প্রবেশাধিকার নেই। ডিজিটাল ভার্সন দিয়েও কাজ হবে না। কিন্তু সাধের পাসপোর্টখানা যে ভুল করে ক্যান্ডির লজেই রেখে এসেছি। তাই মন খারাপ করে এক রোড সাইড সরাইখানায় বসে নুডলস আর ফ্রাইড রাইস খাচ্ছি। তখনই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। ঘণ্টাখানেক পর যখন বৃষ্টি থেমেছে, তখন পিদুরাঙ্গালার দিকে আগালাম অটোতে করে। একই ন্যাশনাল পার্কের মধ্যে অবস্থিত পিদুরাঙ্গালা রক উচ্চতায় সিগিরিয়ার চেয়ে কেবল ১ মিটার ছোট। এখান থেকেই লায়ন রকের সবচেয়ে সুন্দর ভিউ পাওয়া যায়। প্রবেশমূল্য ১০০০ শ্রীলঙ্কান রুপি, সিগিরিয়াতে যেটা সার্ক নাগরিকদের জন্য ১৫ ডলার (৪৮০০ লঙ্কান রুপি)। উঠতে নামতে সব মিলিয়ে ১ ঘণ্টার একটু বেশি লাগলেও বড় বড় পাথরের চাঁই আর উঁচু পাহাড়ি পথ বাইতে হয় বলে কিছুটা কষ্টকর। তবে মোটামুটি ফিটনেস থাকলে তেমন সমস্যা হবে না। যেই সিগিরিয়াকে দেখার জন্য এতো শব্দ খরচ করছি, সে গল্পে ফিরে আসি। পঞ্চম শতাব্দীর কথা। প্রাচীন অনুরাধাপুরা (অধুনা শ্রীলঙ্কা) রাজ্যের সিংহাসনে তখন রাজা ধাতুসেনা। দুই ছেলে আর এক মেয়ের মধ্যে বড় ছেলে কশ্যপের জন্ম রাজার রক্ষিতার গর্ভে।

তাই বয়সের বিচারে ছোট হলেও রাণীর গর্ভের সন্তান মোজ্ঞালানাকে যুবরাজ হিসেবে ঘোষণা করেন ধাতুসেনা। অন্যদিকে, বড় ছেলে কশ্যপকে রাজসভার গুরুত্বপূর্ণ নিযুক্ত করা হলো। মহা ধুমধাম করে সিংহলের রাজা ধাতুসেনার একমাত্র কন্যার বিয়ে হয় আপন বোনের ছেলে মিগারার সঙ্গে। যোগ্যতায় সে দুর্ধর্ষ যোদ্ধা ও রাজ্যের বীর সেনাপতি। ধাতুসেনা তাঁর মেয়েকে অন্ধের মত ভালোবাসতেন। ভালো মন্দ কোনো কিছু জিজ্ঞেস না করে ধাতুসেনা তাঁর বোনের শিরচ্ছেদের নির্দেশ দেন। জামাতা ও সেনাপতি মিগারার চোখের সামনে রাজার হুকুম তামিল করা হয়। প্রতিশোধের আগুনে জ্বলতে থাকা মিগারা শুরু করলেন তাঁর প্রাসাদ ষড়যন্ত্র। রক্ষিতা পুত্র কশ্যপের সঙ্গে বন্ধুত্বের সুবাদে মদিরা পান করিয়ে তাঁর মাথায় সিংহাসনের ভুত ঢুকিয়ে দিলেন। কশ্যপ তাঁর পিতাকে জ্যান্ত পুঁতে হত্যা করে রাজ সিংহাসন দখল করে নেন। প্রাণের ভয়ে ছোট ভাই মোজ্ঞালানা ভারতে পালিয়ে যান।
অন্যায়ভাবে রাজ্য দখল করার পর কশ্যপ সবসময়ই মোজ্ঞালানার ভয়ে থাকতেন। ৪৭৭ অব্দে নিজের সুরক্ষার জন্য নতুন রাজ প্রাসাদ গড়ে তোলার নির্দেশ জারি করেন। রাজ্যের সব প্রতিভাবান স্থপতি, শিল্পী ও রাজ কারিগরদের অভূতপূর্ব সন্নিবেশের পর তৈরি হল,‘সিগিরিয়া’- প্রাচীন স্থাপত্যকলার এক অদ্ভুত সুন্দর নিদর্শন। হাজার ফুট উঁচু বিশালকায় এক পাথর, এর উপরেই তৈরি হয়েছিল রাজা কশ্যপের নতুন প্রাসাদ ও দুর্গ। এই পাথরকে ঘিরে খনন করা হয়েছিল বিশাল সব পরিখা। পরিখা পেড়িয়ে পৌঁছানো যেত পাথরের গোড়ায়। পাথর খোদাই করে বানানো হাজার ফুটের সিঁড়ি আর সঙ্গে ছিল বিশাল এক সিংহ তোরণ। বাকি অংশ কালের পরিক্রমায় ধ্বংস হলেও সিংহের দু’খানা থাবা আজো টিকে আছে। রাজ পরিবারের মনোরম প্রাসাদ, প্রমোদোদ্যান, ফলের বাগান, দেয়ালে আঁকা অনিন্দ্য সুন্দর চিত্রকর্ম তো ছিলই, সঙ্গে পানির জন্য অত্যাধুনিক পুকুর ও ফোয়ারা। যেন পুরো স্বর্গীয় উদ্যান; ‘আ ইডেন অন দ্য রক’!

৪৯৫ খ্রিষ্টাব্দে ভারতে পালিয়ে যাওয়া মোজ্ঞালানা পিতৃভূমিতে ফিরে এসেই সৎ ভাই কশ্যপের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। সম্মুখ সমরে রণকৌশলের জন্য হাতির পিঠে বসে থাকা রাজা কশ্যপ একটু ঘুরে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু রাজার হাতি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে হঠাৎ সরে যাচ্ছে দেখে কশ্যপের সৈন্যবাহিনী ভেবে বসে রাজা বোধহয় যুদ্ধ থেকে পালাচ্ছেন। এমন ভুল বোঝাবুঝির মধ্যে সৈন্যবাহিনী রাজাকে রেখে আত্মসমর্পণ করে বসে। প্রচণ্ড রাগে-দুঃখে রাজা কশ্যপ নিজের ছোরা বের করে নিজের গলা কেটে আত্নহত্যা করেন। মোজ্ঞালানা সিংহাসনে বসে অনুরাধাপুরার রাজধানী আবার আগের জায়গায় নিয়ে যান ও সিগিরিয়াকে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের আশ্রমে পরিণত করেন। ইতিহাসের পরিক্রমায় একসময় সিগিরিয়া পরিত্যক্ত নগরীতে পরিণত হয়। বিশালকায় বন পুরো অঞ্চল ঢেকে ফেলে। বহু বছর পর ১৮৩১ সালে ব্রিটিশ আর্মির মেজর জোনাথান ফর্বেস পোল্লোনোরুয়ার সফর শেষে ঘোড়ায় চড়ে ফেরার পথে হঠাৎ সন্ধান পান লোক চক্ষুর আড়ালে থাকা প্রাচীন এই নগরীর। ১৯৮২ সালে ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পায় শ্রীলঙ্কার এই ‘অষ্টম আশ্চর্য’। পর্যটকদের কাছে এটি ‘লায়ন কিংডম’ নামেও পরিচিত। পিদুরাঙ্গালা থেকে নেমে আবার বাসে করে ফেরা, বৃষ্টির রাতে বাস নষ্ট, তারপর আরেক বাস ধরে ক্যান্ডি ফিরে দারুণ এক ঘুম। খুব সকালে উঠে ধরতে হবে এল্লার ট্রেন। তাই অ্যাডভেঞ্চারের সমাপ্তি আজকের মতো।