আমনুরা হরিজন পল্লী মানসম্মত জীবনযাপন কবে গড়ে উঠবে?

142

সাজিদ তৌহিদ

আমনুরা হরিজন পল্লী; গড়ে উঠেছে পাকিস্তান আমলে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার ঝিলিম ইউনিয়নে আমনুরা রেলস্টেশনের পরিচ্ছন্নতা কাজের সুবাদে এখানকার কোয়ার্টারেই গড়ে উঠে এই হরিজন পল্লী। পল্লীর পূর্ব পাশেই ঝিলিম বাজার মোড়। বাজারটি সবসময় সরগরম থাকে। এখান থেকে গাড়ি চলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর ও নাচোল এবং রাজশাহীর তানোর ও গোদাগাড়ী উপজেলা অভিমুখে। পশ্চিমে আমনুরা রেলস্টেশন। উত্তরে ‘চাঁপাইনবাবগঞ্জ ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র’। হরিজন পল্লীবাসীর দুর্ভোগের জীবনে আরো দুর্ভোগ বাড়িয়েছে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি। আর দক্ষিণে অন্য ধর্মের ৩০ থেকে ৩৫টি পরিবারের বসবাস, রেলের জায়গাতেই। পল্লীর ভেতর দিয়ে যাওয়া রাস্তাগুলো চওড়ায় হাত তিনেক হবে। একটি রাস্তা স্টেশন পর্যন্ত চলে গেছে।
কালের পরিক্রমায় সময় গড়িয়েছে বহুদূর, তবু জীবনমানের উন্নতি হয়নি আমনুরা হরিজন পল্লীর মানুষদের। ঘিঞ্জি পরিবেশে গাদাগাদি করে এখনো বাস করতে হয় তাদের, লাইন ধরতে হয় গণশৌচাগারে যেতে। ড্রেনেজ ব্যবস্থাও অপ্রতুল। চিরাচরিত এই দৃশ্য তাদের জীবনের সঙ্গী হয়ে সামনে এগিয়ে চলেছে। আছে বঞ্চনার ক্ষোভও। পরিচয় ‘মানুষ’ হলেও, এখনো নিজ এলাকায় রেস্তোরাঁয় বসে খাবার খাওয়া, সে তো অলীক স্বপ্ন।
আমনুরা হরিজন পল্লীর মানুষদের জীবনযাপন দেখার জন্য সরেজমিন যাওয়া হয় সেখানে। সঙ্গী হয়েছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার একমাত্র কমিউনিটি রেডিও ‘রেডিও মহানন্দা’র সহকারী প্রযোজক মৌটুসী চৌধুরী। পরে যোগ দেন আরেক সহকারী প্রযোজক আয়েশা সিদ্দিকা ও প্রয়াস ফোক থিয়েটার ইনস্টিটিউটের শ্যামল কুমার। তিন ঘণ্টা অবস্থানকালে কথা হয় কয়েকজনের সঙ্গে। চেষ্টা ছিল, তাদের কষ্টগুলো জানার।
বর্তমানে আমনুরা হরিজন পল্লীতে ১৫ থেকে ১৬টি পরিবারের বসবাস। সবমিলিয়ে সদস্য সংখ্যা ৬০ থেকে ৭০ জন হবে। রেলের কোয়ার্টারে হরিজন সদস্যদের বসতি গড়ে উঠলেও সময়ের ব্যবধানে পরিবার বড় হওয়ায় আশপাশেও ঘরবাড়ি গড়ে তোলা হয়েছে। কোয়ার্টারের মতোই ঘরগুলোও খুব ছোট। এক বাড়ির গা ঘেঁষে বানানো হয়েছে আরেকটি বাড়ি। নিজেরা ‘এক’ থাকার কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে। কিছু কোয়ার্টার পরিত্যক্ত হয়ে গেছে। বাস করেন না কেউই। অন্য কোয়ার্টারগুলো পরিত্যক্ত হওয়ার পথে। বিপদ জেনেও বাস করছেন কিছু পরিবার। বর্ষার সময় ঘরে পানি পড়লেও, সে কষ্ট মেনে নিয়ে জীবন অতিবাহিত করতে হয় তাদের। রেলে চাকরি না করলেও কোয়ার্টার ছাড়তে হয়নি তাদের। কখনো উঠে যেতেও বলা হয়নি। তবে ৫/৬ বছর আগে বিদ্যুৎ সংযোগ তুলে দিতে চেয়েছিল রেল কর্তৃপক্ষ। হরিজনদের বাধার মুখে সেটি আর হয়নি।
রেলের পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে এখানে বসবাস শুরু হলেও বর্তমানে রেলে চাকরি করছেন এমন সংখ্যা ৪-৫ জন হবেন। বাকিদের মধ্যে কেউ কেউ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে চাকরি করছেন। অন্য পেশাতেও আছেন বেশ কয়েকজন। জানা গেল, কয়েকজন নারী মাটি কাটা কাজে জড়িত আছেন। কিছু দিনমজুরও রয়েছেন। বড় কোনো পদে নেই কেউই। পূর্বে রেলের পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে চাকরি করেছেন ২০-২৫ জন। তাদের মধ্যে অবসরের পর কয়েকজন অন্যত্র গিয়ে বসতি গড়েছেন।
আগে লেখাপড়ার ঝোঁক না থাকলেও এখন হরিজন পল্লীর ১০-১১টি পরিবারের ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে। তবে চল্লিশোর্ধ শ্রী শিবরাজের কাছে জানা গেল, তার সমবয়সী কেউই লেখাপড়া করেননি। তিনি ও আরেকজন দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন। অবশ্য এসএসসি পরীক্ষা দেয়া হয়নি কারোরই। শিবরাজের ছেলে নবম শ্রেণিতে পড়ে, মেয়ে দ্বিতীয়তে। এখানকার স্কুলপড়–য়ারা ভাতা পাচ্ছে সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে। এছাড়া বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতাও পাচ্ছেন হরিজন পল্লীর বাসিন্দারা।
আমনুরা হরিজন পল্লীতে পনের-ষোলটি পরিবার বাস করলেও একটি বাড়িতে চোখে পড়ল নিজস্ব শৌচাগার। তবে গোসলঘরের পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় রিংপাটে পানি ফেলা হচ্ছে। সেটি ভরে গেলে বালতি করে পানি ফেলে আসতে হয়। বাকি পরিবারগুলো ব্যবহার করে থাকে দুটি গণশৌচাগার। দুটিই পরিত্যক্ত হওয়ার পথে। যে কোনো সময় ছাদ ধসে পড়তে পারে। মল নিষ্কাশনের সেপটিক ট্যাংক না থাকায়, তা জলাবদ্ধ পানিতে মিশে দূষিত করছে পরিবেশ। সকালবেলা দীর্ঘ লাইন পড়ে শৌচাগারে যাওয়ার জন্য। উন্নয়নের এই কালে এ দৃশ্য বড়ই বেমানান। এ দৃশ্য কল্পনা করাও কঠিন।
শৌচাগার ছাড়াও পরিবেশ দূষণ করছে পাশেই অবস্থিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্গত দূষিত পানিও। এমনিতেই জায়গা নিচু হওয়ায় বর্ষার সময় চরম ভোগান্তি পোহাতে হয় এখানকার সব সম্প্রদায়ের বাসিন্দাদের। পর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় বাড়ি থেকে বের হলেই গোড়ালি পানি ভাঙতে হয়। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালু হওয়ার পর বছরের বেশির ভাগ সময়ই এ দুর্ভোগ পোহাতে হয়। ড্রেনেজ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দূষিত ও হোটেলের আবর্জনাবেষ্টিত পানি হরিজন পল্লীর পাশের ফাঁকা জায়গাগুলোয় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করেছে। সেই পানি শিশুরা খেলার ছলে ঘেঁটে ফেলায় চর্মরোগেও আক্রান্ত হচ্ছে তারা। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ড্রেন থাকলেও তা ভেঙে পড়েছে; সংস্কার করা হয়নি দীর্ঘদিন। এই ড্রেনেই বিভিন্ন হোটেলের খাবার ও আবর্জনা এবং বিভিন্ন দোকানের ময়লা ফেলার কারণে ড্রেনটি বন্ধ হয়ে গেছে। তাছাড়া ড্রেনের জায়গা দখল করে অনেকে দোকানপাট তৈরির ফলে ড্রেনের পুরো পানি পল্লীতে ঢুকে পড়ছে। সরেজমিন সে দৃশ্য চোখেও পড়েছে। জনপ্রতিনিধিদের এ বিষয়ে অনেকবার জানানো হলেও প্রতিকার এখনো মেলেনি। তারা জানান, জরুরি ভিত্তিতে নতুন ড্রেন নির্মাণ করা ছাড়া তাদের কষ্ট লাঘব হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
সমস্যা আছে খাবার বা ব্যবহারের পানি নিয়েও। সব সম্প্রদায়ের প্রায় ৫০টি পরিবারের খাবার পানির জন্য রয়েছে মাত্র একটি মটরচালিত মিনি ওয়াটার পাম্প। এই পাম্প থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে প্রত্যেকটি বাড়িতে পানি সরবরাহ করা হয়ে থাকে। এই পানি দিয়েই সব কাজ করতে হয় এখানকার বাসিন্দাদের। একসময় যে পুকুরের পানি দিয়ে প্রয়োজনীয় কাজ সারা হতো, এখন সেটি চলে গেছে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভেতরে। যে কারণে মিনি পাম্পের পানিতেই ভরসা তাদের। সরকারিভাবে পাওয়া মিনি পাম্পটি একবার নষ্ট হয়ে যাওয়ায় নিজেরা চাঁদা তুলে মেরামত করে চালাচ্ছে। এখানে পানির পাম্পের চাহিদা ন্যূনতম আরো দুটি। কেননা গ্রীষ্মকালে পানি সংকটে ভুগতে হয়। তাছাড়া জায়গা সমান্তরাল না হওয়ায় কিছু কিছু বাড়িতে পানি যেতেও সমস্যা হয় চাপ না থাকার দরুন।
এতসব সমস্যা নিয়ে থাকার পরও অন্য একটি দুঃখ হরিজন পল্লীবাসীদের জীবনে দাগ কেটে থেকে গেছে, যা এখনো মুছে ফেলা যায়নি। তা হলো নিজ এলাকার রেস্তোরাঁয় বসে খাবার খাওয়ার অধিকার। যেন নিজভূমেই পরবাসী তারা। অথচ বাজারঘাট, স্কুল-কলেজ, খেলার মাঠ, পরিবহনÑ কোথাও বাধাপ্রাপ্ত না হলেও নিজ এলাকার রেস্তোরাঁয় বসে খাবার খাওয়া থেকে এখনো বঞ্চিত তারা। সহজ করে বলতে হয়, যেসব রেস্তোরাঁ হরিজন সদস্যদের চেনে সেসব জায়গায় তাদের প্রবেশাধিকার এখনো সংরক্ষিত। শ্রী শিবরাজের আক্ষেপ, নিজেরা যেতে পারছি না, সেটার জন্য খুব খারাপ লাগছে না। তবে ছেলেটা যখন বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা করে এবং খেলা শেষে তার বন্ধুরা রেস্তোরাঁয় খেতে যায়, তখন ছেলের মুখটি দেখে খুব কষ্ট লাগে। এ কষ্টের কথা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে তিনি বলেন, ‘আর কতদিন!’
এই অধিকারটুকু প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলেই যেন হরিজন পল্লীবাসীর মুক্তি। অন্য সমস্যাগুলোর সমাধান না হলেও ভাবান্তর নেই।
জানা গেল, এই হরিজন পল্লীর সদস্যদের স্থানীয় একটি রেস্তোরাঁয় একদিনের জন্য নাস্তা খাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। এ সুযোগ করে দিয়েছিল প্রয়াস মানবিক উন্নয়ন সোসাইটি, চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারি। তাদের সঙ্গে বসেই নাস্তা খেয়েছিলেন পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব জনাব ড. নমিতা হালদার ও প্রয়াসের নির্বাহী পরিচালক জনাব হাসিব হোসেন। এও জানা গেল, ড. নমিতা হালদার তাদের স্যানিটেশন ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য উদ্যোগী হয়েছেন এবং তারই চেষ্টায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ হরিজন পল্লী ঘুরেও গেছেন। এছাড়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দূষিত পানি নির্গমন সংক্রান্ত অভিযোগের প্রেক্ষিতে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে সরেজমিন ঘুরে গেছেন পরিবেশ অধিদপ্তরের রাজশাহী জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক জনাব মাহমুদা পারভীন। এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনও তিনি অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে প্রেরণ করেছেন বলে জানা গেছে।
শুধু রেস্তোরাঁই নয়, নিজ ধর্মেও ‘অচ্ছুত’ হরিজন পল্লীর সদস্যরা। আগে পূজা-অর্চনায় মন্দিরে যাবার অধিকার না থাকলেও এখন সে অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে কোনো কিছু ছোঁয়াছুঁয়ি থেকে বিরতই থাকতে হয় তাদের। হরিজন পল্লীতে ৩০-৩৫ বছর আগে একটি মন্দির নির্মাণ করা হলেও এখন পর্যন্ত সেখানে তিনবার দুর্গাপূজার আয়োজন করা হয়েছে। অর্থাভাবে পূজার আয়োজন করা সম্ভব হয়ে ওঠে না তাদের পক্ষে।
হরিজন পল্লীর জীবনমান, বিশেষ করে স্যানিটেশন এবং ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নতিকরণে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বা হচ্ছে কিনা তা জানতে যোগাযোগ করা হয়েছিল ৩নং ঝিলিম ইউনিয়ন পরিষদের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান জনাব লুৎফুল হাসানের সঙ্গে। তিনি হরিজন পল্লীর গণশৌচাগার এবং পয়ঃনিষ্কাশন সমস্যার কথা মেনে নিয়েই জানিয়েছেন, ওখানে কাজ করার জন্য কোনো সুযোগ-সুবিধা তিনি এখনো পাননি। তবে তিনি এও স্বীকার করেন যে, এই বিষয়ে যে প্রসিডিউর মেইনটেইন করা দরকার তা এখনো করা হয়নি। জনাব লুৎফুল হাসান বলেছেন, কিছুদিন আগে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের এক ব্যক্তি এসে হরিজন পল্লী ঘুরে গেছেন। তাকে দেখে মনে হয়েছিল দ্রুতই হয়তো তারা সেখানকার সমস্যার সমাধান করবেন। কিন্তু পরে আর তাদের কার্যক্রম চোখে পড়েনি, জানান তিনি।
নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান লুৎফুল হাসান কথোপকথনে এও জানান, তিনি সবেমাত্র চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েছেন। তাই এখনো হরিজন পল্লীতে স্যানিটেশন ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নতির জন্য বরাদ্দ চেয়ে কোনো চাহিদাপত্র দেয়া হয়নি। তবে শিগগিরই দেয়া হবে।

সাজিদ তৌহিদ : সাংবাদিক ও লেখক