বাবা দিবসে ‘‘বাবা-কথিকা’’
বাবা দিবসে ‘‘বাবা-কথিকা’’ ড. আকন্দ মো. রফিকুল ইসলাম প্রাক কথনঃ মায়েদের ত্যাগের কথা সর্বজনবিদিত। বাবাদের ত্যাগ অনেক সময় অবহেলিত। সকলের নালিশ বাবার কাছে, বাবার নালিশের জায়গা নেই। বিশেষত: মধ্যবিত্তের বাবাদের সংসার চালাতে গিয়ে কত পেরেশান-কত হয়রানির সম্মুখিন হওয়া, অনেক ক্ষেত্রে ঋণ করে সংসার চালানো, পয়সা বাঁচাতে বাজারে দর কষাকষি করতে গিয়ে অপ্রিয়ভাজন হওয়া, ইত্যাকার বহুবিধ গঞ্জনা সহ্য সংবলিত চরম ত্যাগের উদাহরণের অভাব নেই। সংসারের শান্তি রক্ষার্থে এ গুলো বেশীর ভাগই গোপন রেখে বাবারা হন নীলকন্ঠ। মুখ বুঝে সংসারের ঘানি টেনে যাওয়াই হচ্ছে বাংলার মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবাদের আদর্শ। অতি সজ্জন, সৎ, মধ্যবিত্ত বাবা হলে তো আরও ত্রাহি অবস্থা। আমার বাবা ছিলেন সে রকম মধ্যবিত্ত পরিবারের সৎপথে চলা একজন সাদাসিধে সুফি মানুষ। বাবার বেঁচে-বর্তে যাওয়া সর্ব কনিষ্ঠ সন্তান হওয়ায় আমি বাবার অতি আদরের ছিলাম। অপরদিকে বাবার অবসর জীবনে সন্তানদের মধ্যে আমিই বেশী সময় কাছে ছিলাম (তাঁর অন্য কোন সন্তান তাঁর কাছে এতটা বেশী সময় সরাসরি থাকতে পারেন নি)। গ্রামের স্কুলের ছাত্র হওয়ায় ১৪/১৫ বছর যাবৎ বাবার সরাসরি সঙ্গ পেয়েছিলাম। তাই বাবা তাঁর জীবনের কষ্ট মিশ্রিত সততার সুন্দর গল্পগুলো আমার সাথেই বেশী করতেন বলেই আমার মনে হয়। আমার ধারণা আমাকে তাঁর ধাঁচে মানুষ করার মানসে নৈতিক শিক্ষার অংশ হিসেবে এ গল্পগুলো আমার সাথে করতেন। তার সুফলও আমি পেয়েছি। আমার ভিতরে বাবার নৈতিকতা বলা যায় আমার হয়ে আমার সন্তান পযর্ন্ত পৌঁছেছে। যা হোক, আমরা প্রায় সবকটা ভাইবোন বাবার সাদাসিধে-সৎ চরিত্র কিছুটা হলেও পেয়েছি, তবে বাবার মত অতটা ভাল মানুষ বোধ করি কেউই হতে পারি নি। এক্ষণে বাবা দিবসে বাবার স্মরণে ‘‘বাবা-কথিকা’’ তুলে ধরছি। বাবাকে নিয়ে আমার একমাত্র লেখা। তাই বাবার সাথের সব স্মৃতি তুলে ধরার চেষ্টা করা যাক্। আমার বাবা পৃথিবির সেরা বাবাঃ ‘‘আমার বাবা পৃথিবির সেরা বাবা’’-এ শিরোনামটি বেশ সন্দিগ্ধ। তার কারণ প্রায় সবাই এ আপ্ত বাক্যটি ব্যবহার করেন। তবে এটির সবচেয়ে ভাল দিক হচ্ছে-বাবার মত মুরুব্বীদেরকে উচ্চ আসনে আসীন রাখার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা, যা আমাদের ধর্ম ও দেশের সংস্কৃতিরও অংশ বটে। ‘‘প্রত্যেকের বাবাই প্রত্যেকের কাছে শ্রেষ্ঠ”-এর চেয়ে ভাল খবর আর কি হতে পারে? যা হোক, আমার বাবার ক্ষেত্রে এ টুকু নিশ্চিত করে বলা যায যে, আমার বাবার অবস্থান সেরাদের কাতারের উচ্চ পর্যায়েই রয়েছে। আমার বাবার মত ব্যক্তিদের ম্মৃতিচারণ আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের নৈতিক শিক্ষার জন্যও জরুরী বলে এ লেখার প্রয়াস। আমার বাবাকে গ্রামের লোকজন ভালোবেসে শ্রদ্ধার সাথে নাম দিয়েছেন আকনজী (আগের দিনে শ্রদ্ধাভরে নামের সাথে ‘জী’ লাগানো হতো, গ্রামের মানুষ সেটাই অনুসরণ করেছেন)। বাবা গ্রামের সকলের নিকট সমাদৃত ছিলেন। অদ্যবধি বাবার পরিচয়ে পরিচিত (বাবাকে ছাড়িয়ে যাওয়া কখনও সম্ভব নয়): অনেকে বাবাকে ছাড়িয়ে যান। আমাদের পক্ষে আমাদের বাবাকে ছাড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। বিষয়টি খোলসা করার জন্য একটি উদাহরণ দেয়া যাক। এক দিন সরকারের উচ্চ পদে আসীন আমার এক বন্ধু (স্কুল জীবনের সতীর্থ, একই গ্রামের বাসিন্দা ও আত্মীয়ও বটে)-এর দপ্তরে গিয়েছিলাম। তখন সে তার সহকর্মীদের নিকট আমার পরিচয় এভাবে তুলে ধরলেন যে, রফিক হলো আমার অন্যতম দোস্ত, ওর নিজের পরিচয় যাই থাকুক, সেটা বড় কথা নয়, ওর বড় পরিচয় হলো ওর বাবা আমাদের গ্রামের সবচেয়ে সৎ ও শ্রেষ্ঠ মানুষ ছিলেন। তখন আমার বোধদোয় হলো এবং গর্বে বুকটা ভরে গেল যে, আল্লাহ্র কত বড় নেয়ামত যে আমাকে আল্লাহ্ এমন এক বিরল-সৎ-বাবার সন্তানরুপে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন যে, তাঁর মৃত্যুর আটাশ বছর পরেও প্রজন্মান্তরে দেশের সর্ব্বোচ্চ পর্যায়ের পদস্ত বিজ্ঞ লোকের মুখেও তাঁর সুনাম শোনা যাচ্ছে। এর চেয়ে সৌভাগ্য আর কি হতে পারে? অপর দিকে চোখে পানি এসে গেল এই ভেবে যে, আমাদের ৭ ভাই-বোনকে মানুষ করতে বাবা তাঁর সহযোদ্ধা-সহধমির্নী-কে নিয়ে কত কষ্টই না করেছেন। হে আল্লাহ্, বাবা-মা’র সদকায়ে জারিয়া হিসেবে আমাদেরকে তুমি কবুল করে নাও। আল্লাহ্ তুমি আমার মা-বাবাকে বেহেস্ত নসীব করো। “রব্বির হাম হুমা কামা রব্বা ইয়ানি সগীরা’’(হে আমাদের পালনকর্তা! তাঁদের উভয়ের প্রতি রহম করুন; যেমনিভাবে তাঁরা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন)। আমার বাবা ছিলেন মূলত মসজিদের ইমাম ও মাদ্রাসার শিক্ষকঃ আল্লাহ্ তা’আলা ‘‘সুরা সিজদা”র ২৪ নং আয়াতে যা ইরশাদ করেন তার অর্থ-‘‘ওরা যেহেতু ধৈর্যশীল ছিল তার জন্য আমি ওদের মধ্য হতে নেতা (ইমাম) মনোনীত করেছিলাম, যারা আমার নির্দেশ অনুসারে মানুষকে পথপ্রদর্শন করত। ওরা ছিল আমার নিদর্শনাবলীতে দৃঢ় বিশ্বাসী”। স্কুলের ইসলামিয়াত বইতে পড়েছিলাম- ‘‘ইমাম হয় আল্লাহ্র ইচ্ছায়”। আমাদের প্রিয় নবীজী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.) নিজে ইমামতি করেছেন। রাসুল (সা.) বলেছেন, তিন ব্যক্তি কিয়ামতের দিন মিশকের কস্তুরির স্তূপের ওপর থাকবেন-তার মধ্যে এক ব্যক্তি হলো যে কোনো কওমের ইমামতি করে আর তাঁরা তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট” (তিরমিজি)। যেহেতু ইমাম সাহেবকে সকলে আদর্শ মানুষ হিসেবে গ্রহণ করেন। তাই ইমাম সাহেবকে ইমামতির যোগ্য হওয়ার জন্য ধর্মের মৌলিক নীতিমালা জানা ও এর অনুসারী হওয়ার পাশাপাশি আরো কিছু মহৎ গুণের অধিকারী হতে হয়। যেমন- সত্যবাদি, ন্যায়পরায়ণ, আমানতদার ও বিশ্বস্ত/আস্থাভাজন হওয়া ইত্যাদি। এ গুণগুলো আমার বাবার মধ্যে ছিল। তাই তাঁর প্রতি তাঁর কওমও সন্তুষ্ট ছিল। কয়েক বছর আগে আমার চাচাত ভাই জনাব গোলাম মোর্শেদ পলাশ ফোন করে জানান যে, আমাদের মসজিদ কমিটির আয়োজনে বার্ষিক মাহফিলে দাওকাঠি সিনিয়র মাদ্রসার প্রিন্সিপাল মাওলানা নাসির উদ্দিন সাহেব তাঁর বক্তব্যে বলেন যে, আকনজী হুযুর (আমার বাবা)-এর মত এত ভাল মানুষ এ তল্লাটে আর দেখি নাই বা আর জীবনে দেখবো বলেও মনে হয় না। বাবার সুনাম এভাবে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা থেকে শুনতে কার না ভাল লাগে, বলুন। সেচ্ছাসেবক আর কাকে বলেঃ একজন ইমাম শুধু মসজিদের ইমাম নন বরং তিনি তাঁর কওমেরও ইমাম। বাবা ছিলেন তাই। ধর্মীয় বিষয়ে মাসালা-মাসায়েল জানার জন্য অনেকেই বাবার কাছে আসতেন। মৃত্যু পথযাত্রিকে তওবা পড়ানো, জানাজার নামাজ পড়ানো, শিশুদের হাতে-খড়ি, ব্যবসা/শুভ কাজের উদ্বোধনে মিলাদ পড়ানো, বিয়ে-পড়ানো, ধর্মীয়-সামাজিক কাজ ছিল বাবার রুটিন কাজ। রোজার মাসে বাবা প্রতি দিন অসংখ্য মিলাদের দাওয়াত পেতেন (বাবার সাথে মিলাদের দাওয়াতে আমরা সব ভাই-ই গিয়েছি)। কি সুন্দর কিয়াম, কি সুন্দর মোনাজাত, যা শুনে চোখে পানি এসে যেত। বাবার বেশীর ভাগ সময় যেহেতু ম্বেচ্ছাসেবী কাজে ব্যয় হতো, সেহেতু স্বল্প আয়ে সংসার চালাতে গিয়ে ইমামতি-শিক্ষকতার পাশাপাশি ফসল উৎপাদনের কাজও তাঁকে করতে হতো। বাবার শতভাগ হালাল রুজি-রোজগারে আমরা মানুষ হয়েছি, এটা প্রণিধানযোগ্য। অভাবের মধ্যেও বোয়ালিয়া হাট (বরিশাল হতে বাকেরগঞ্জ যাওয়ার পথে এ হাটটি অবস্থিত) নির্মাণের জন্য প্রায় ৭৫ শতাংশ জমি সামাজিক কাজে বাবা বিনামূল্যে ত্যাগ করেছিলেন। What a voluntary work? বাবা সবার আস্থাভাজন ছিলেন (সততার পরাকাষ্ঠার উদাহরণ রয়েছেঃ আমার বাবার প্রতি মানুষের আস্থাভাজনের একটি উদাহরণ তুলে ধরছি। আমাদের একজন ঘনিষ্ঠ আত্মীয় গ্রামের এক জনের নিকট হতে এক খন্ড জমি ক্রয় করেছিলেন। বিক্রেতার মৌখিক আবদার ছিল যে, যখনই তিনি বা তাঁর ওযারিশ অর্থ জোগাড় করতে পারবেন, তখনই যেন তাঁকে/তাঁর ওয়ারিশকে একই দামে জমিটা ফেরত দেয়া হয়। এ আলাপের সময় উপস্থিত ছিলেন আমার বাবা। বেশ কয়েক বছর পরে (মূল ক্রেতা জান্নাতবাসি হওয়ার পরে) ক্রেতার ছেলে (আমাদের আত্মীয়) জমি ফেরত দিতে