কোটি টাকা দুর্নীতির পরও চাকরি যাবে না
সরকারি চাকরি আইন নিয়ে নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে। আইনটি বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় প্রায় ১০ বছর ঘষামাজার পর চূড়ান্ত হয়। সে সময় টিআইবি (ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ) এবং গণমাধ্যমের সমালোচনা উপেক্ষা করে আইনটি প্রণয়ন করা হয়। এতে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের নানাভাবে দুর্নীতির সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিশেষ করে আইনের ৪১ এবং ৪২ ধারা নিয়ে বিশেষ বিতর্ক রয়েছে। এক বছরের কম শাস্তি হলে কিংবা হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি করলেও সরকারি কর্মচারীকে চাকরিচুত করা যাবে না এমন বিধান এতে রাখা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইনটি ফের সংশোধন করতে হবে। কারণ এটি দুর্নীতি রোধের চেয়ে বেশি উৎসাহিত করবে। যা একটি কুলুষমুক্ত প্রশাসন গঠনে বড় বাধা। সরকারি চাকরি আইন ২০১৮ প্রণয়ন করে ১৯৮৫ সালের সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা বাতিল করা হয়। জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমান কোনো মন্তব্য করেননি। তবে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া বলেন, সরকারি চাকরি আইন প্রণয়ন করা হয় অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা বন্ধের জন্য। অথচ এই আইনে বেশকিছু দুর্বলতা রয়েছে। এসব দুর্বলতা এখনি সংশোধন করা সময়ের দাবি। অন্যথায় আইনটি প্রণয়নের উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে আগামী দিনেও অতীতের মতো কর্মচারীরা হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি করবে। তাতে তাদের চাকরি যাবে না। ধারা দুটি দুর্নীতি সহায়ক বলে মন্তব্য করেন তিনি। সরকারি চাকরি আইনের ৪১ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো কর্মচারীর দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সম্পর্কিত অভিযোগে দায়ের করা ফৌজদারি মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র গৃহীত হওয়ার পূর্বে তাকে গ্রেফতার করতে হলে সরকারের পূর্বানুমতি নিতে হবে। এই ধারার দুর্বলতা প্রসঙ্গে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া যুগান্তরকে বলেন, দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়ে কর্মচারীদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো অভিযোগ আসেই না। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, পুলিশ সদস্যরা আসামি ধরতে গিয়ে অনেক সময় বাড়াবাড়ি করেন অথবা চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে ভুল চিকিৎসার অভিযোগ থাকে, এছাড়া সরকারি জমি, বাড়ি, স্থাপনা থেকে উচ্ছেদের সময় কিছু ঘটনা ঘটে, যা দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ তিনটি ক্ষেত্র ছাড়া দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সম্পৃক্ত অভিযোগ খুব একটা আসে না। এসব ক্ষেত্রে ফৌজদারি আইনে বলা আছে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা করতে হলে সরকারের পূর্বানুমতি নিতে হবে। তিনি বলেন, দেশে কর্মচারীরা কর্মরত অবস্থায় ঘুস নিচ্ছেন, অনেক কর্মচারী কর্মরত অবস্থায় সেবাপ্রত্যাশীর সঙ্গে মারামারি করছেন। অথচ আইনে বলা হয়েছে এ ধরনের অপরাধ ও দুর্নীতির ক্ষেত্রে তাদের গ্রেফতারের আগে সরকারের পূর্বানুমতি নিতে হবে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অসাধু কর্মচারীদের অনেকেই ঘুসের টাকাসহ ধরা পড়েছে। অথচ সরকারি চাকরি আইনে বলা আছে তাকে গ্রেফতার করতে সরকারের পূর্বানুমতি নিতে হবে। সরকারি চাকরি আইনের ৪২ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো সরকারি কর্মচারী ফৌজদারি মামলায় আদালতের রায়ে মৃত্যুদণ্ড বা এক বছর মেয়াদের অধিক কারাদণ্ড হলে, ওই দণ্ড আরোপের রায় বা আদেশ প্রদানের তারিখ থেকে চাকরি থেকে তাৎক্ষণিক বরখাস্ত হবে। আইনের ৪২(২) ধারায় বলা হয়েছে, কোনো কর্মচারীর ফৌজদারি মামলায় আদালতের রায়ে অনূর্ধ্ব এক বছরের কারাদণ্ড কিংবা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড হলে তাকে তিরস্কার, নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য পদোন্নতি ও বেতন বৃদ্ধি স্থগিত, নিম্ন পদ বা নিম্নতর বেতন স্কেলে অবনমিতকরণ এবং ক্ষতিপূরণ আদায়ের দণ্ড আরোপ করা যাবে। তার চাকরি থাকবে। এই ধারার দুর্বলতাগুলোর বিষয়ে ফিরোজ মিয়া বলেন, আইনের এই বিধান থাকায় এক বছর পর্যন্ত শাস্তি হলে সাজা শেষে সে জেল থেকে বেরিয়ে ফের চাকরিতে যোগদান করতে পারবে। তিরস্কার দণ্ড দেওয়া হলো কিন্তু তার চাকরি বহাল থাকল, পদোন্নতি স্থগিত হলো অথচ তার চাকরি বহাল থাকল, নিম্নতর স্কেলে নামিয়ে দিল কিন্তু তার চাকরি বহাল থাকল এবং তার কাছ থেকে জরিমানা আদায় করল অথচ তার চাকরি থাকল-এটা আইনের শাসনের পরিপন্থি। তিনি আরও বলেন, সরকার একজন ঘুসখোরকে চাকরিতে রাখবে কেন? তিনি আরও বলেন, ১৯৮৫ সালের সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিতে বলা ছিল, মৃত্যুদণ্ড, এক বছরের অধিক কারাদণ্ড, দশ হাজার টাকার অধিক জরিমানাসহ আইনের বিধানের মধ্যে যে কোনো অপরাধ সংঘটন করুক না কেন সেই ক্ষেত্রে কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করা যাবে। সরকারি চাকরি আইন ২০১৮ প্রণয়ন করে ১৯৮৫ সালের সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা বাতিল করা হয়। ফিরোজ মিয়া আরও বলেন, ধরুন কেউ ৫০০ টাকা ঘুস নেওয়ার দায়ে অভিযুক্ত হলো, বর্তমান আইনে তার কিছুই হবে না। ১৯৮৫ সালের শৃঙ্খলা ও আপিল বিধির বিধানের আলোকে তার চাকরি থাকার কথা নয়।ফিরোজ মিয়া উদাহরণ দিয়ে বলেন, নেশাগ্রস্ত ব্যক্তিকে এক বছরের বেশি শাস্তি দেওয়া হয় না। বর্তমান আইন অনুসারে এক বছর জেল খাটার পরও তার চাকরি বহাল থাকবে। কোনো স্কুল, কলেজ কিংবা মাদ্রাসার শিক্ষক মেয়েদের কিংবা মহিলা সহকর্মীকে উত্ত্যক্ত করল এবং তার ৬ মাসের জেল হলো। সেই ক্ষেত্রে তার চাকরি যাবে না। কারণ চাকরি আইনে বলা আছে এক বছরের অধিক জেল না হলে তার চাকরি যাবে না। মেয়েদের শ্লীলতাহানির অপরাধে জেল খেটে এসে যদি ওই শিক্ষক আবার শিক্ষকতা করতে আসেন তাহলে পরিবেশটা কেমন হয়। ফিরোজ মিয়া বলেন, ঘুস নেওয়ার মামলায় কোনো কর্মকর্তা অভিযুক্ত হয়ে এক বছর জেল খাটার পর আবার এসে কি সে দায়িত্বপালনের নৈতিক যোগ্যতা রাখেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো কর্মকর্তা ঘুসের মামলায় এক বছর জেল খেটে এসে কি আবার কোনো মামলার তদন্ত কাজ করতে পারবেন? কিন্তু আইনে বলা হয়েছে এক বছর পর্যন্ত শাস্তি হলে তাকে চাকরিচ্যুত করা যাবে না। ফিরোজ মিয়া বলেন, দুদক আইনে একজন কর্মচারীর তিন বছর জেল এবং পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। পরে সে অপিল দায়ের করে এবং আপিল আদালত তাকে ৬ মাসের কারাদণ্ড এবং ৪০ লাখ টাকা জরিমানা করেন। এ অবস্থায় সে সরকারি চাকরি ফিরে পেয়েছে। কারণ সরকারি চাকরি আইনে বলা আছে, এক বছরের কম সময় জেল হলে তার চাকরি যাবে না। ফিরোজ মিয়া আরও বলেন সরকারি চাকরি আইনের ৪২-এর দুই ধারায় অর্থদণ্ড হাজার কোটি টাকা হলেও তার চাকরি যাবে না। সরকার শুধু জরিমানা আদায় করতে পারবে। কিন্তু চাকরি বহাল থাকবে।