চাঁপাইনবাবগঞ্জে একদিনে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত রেকর্ড; দুর্ভোগে নিচু এলাকার মানুষ
স্মরণকালের ভয়াবহ বৃষ্টিতে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ। দুর্ভোগে পড়েছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার নিচু এলাকার মানুষ। শুক্রবার রাতভর বৃষ্টিতে ঘরে, দোকানে পানি ঢুকে পড়েছে। রাস্তায় পানি হাঁটু অবধি গড়িয়েছে। কোথাও কোমর ছুঁয়েছে। ভারী বৃষ্টিতে পুকুরের পানি উপচে পড়েছে। ভেসে গেছে পুকুরের মাছ, ক্ষতি হয়েছে ফসলের বিশেষ করে রোপা আমন ধানের, শিবগঞ্জের পুঁটিমারী বিলের সিংহভাগ ফসল নিমজ্জিত হয়েছে, রেললাইনে পানি উঠে পড়ায় ট্রেন চলাচল ব্যাহত হয়েছে।
এছাড়া সদর উপজেলার বারঘরিয়া দৃষ্টিনন্দন পার্কের একটি অংশ মহানন্দায় দেবে গেছে। শিবগঞ্জে একটি সেতুর ক্ষতি হয়েছে। অন্য উপজেলাগুলোতেও ভারী বৃষ্টিতে ফসলের ক্ষয়ক্ষতিসহ পুকুরের ক্ষতি হয়েছে।
গত শুক্রবার রাতভর জেলায় গড় বৃষ্টি হয়েছে ১৯১ মিলিমিটার। শুধু সদর উপজেলাতেই বৃষ্টি হয়েছে ২৬০ মিলিমিটার। জেলা কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৩ সাল থেকে একদিনে এত বৃষ্টি আগে কখনো রেকর্ড হয়নি।
গত শুক্রবার রাত ৮টার দিক থেকে শুরু হয় বৃষ্টি। রাত যত বেড়েছে, বৃষ্টির পরিমাণও বেড়েছে। ভারী বৃষ্টিতে জেলাশহরের অনেক এলাকা জলমগ্ন হয়ে যায়। সকাল হতে হতে অনেকের বাড়ির ভেতরে পানি ঢুকে পড়ে। যেসব এলাকার পানি নিষ্কাশনে সমস্যা আছে সেসব এলাকার রাস্তায় পানি জমে জনসাধারণের চলাচলে বিঘ্ন সুষ্টি হয়। ভারী বৃষ্টিতে অনেকের পুকুরের মাছ ভেসে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। কিছু কিছু জমির ফসল নষ্ট হয়েছে।

শনিবার সকালে দেখা যায়, জেলাশহরের শাহ নেয়ামতুল্লাহ কলেজের পেছনের বাসিন্দাদের অনেকের বাড়ির ভেতরে পানি ঢুকে পড়েছে। অক্ট্রয় মোড়ের সড়ক ও জনপথ বিভাগের শাপলা পুকুর উপচে জেলা মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের মহাসড়কে পানি উঠে পড়েছে। ডুবে গেছে অক্ট্রয় মোড়ের দোকানপাট। জেলা প্রশাসকের বাসভবন চত্বর ও পুলিশ সুপারের বাসভবনের রাস্তায় পানি জমে থাকতে দেখা গেছে। পানি জমে থাকতে দেখা গেছে কালেক্টরেট শিশু পার্কের রাস্তা ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয় চত্বর পুরাটাই জলমগ্ন হয়ে পড়ে। পানি জমে থাকতে দেখা যায় জেলা জজের বাসভবন চত্বর, সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) এর কার্যালয় চত্বর, সিভিল সার্জন কার্যালয়ের সামনের রাস্তা, নিমতলা, বাতেন খাঁর মোড়, নিউ মার্কেটসহ বিভিন্ন রাস্তায় পানি জমে থাকতে খো যায়। ক্লাব সুপার মার্কেটের ভেতরে পানি ঢুকে পড়ে। তবে নিউ মার্কেট এলাকায় নতুন ড্রেন নির্মাণ করায় জলবদ্ধতা দ্রুত নিরসন হতে দেখা যায়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার নগর পরিকল্পনাবিদ ইমরান হোসেন বলেন— মহান্দা সেতুর সংযোগ সড়ক শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার প্রধান প্রধান সড়কে বড় বড় ড্রেন নির্মাণ কার্যক্রম চলছে। মূল শহরের ভেতরে যেসব জায়গায় ড্রেন নির্মাণ করা হচ্ছে সেসব জায়গার কোথাও কোথাও জমি অধিগ্রহণ সমস্যা ও বৈদ্যুতিক পোল অপসারণ না হওয়ায় নতুন ড্রোনগুলোর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করা যাচ্ছে না। ফলে ড্রোনগুলো বন্ধ থাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। তবে সম্প্রতি নেসকো কর্তৃপক্ষ এলাকাগুলো পরিদর্শন করেছেন। পোলগুলো সরিয়ে নিলে এবং জমি অধিগ্রহণ সমস্যার সমাধান হয়ে গেলেই নতুন নির্মাণাধীন ড্রেনগুলোর নির্মাণ কাজ শেষ করা যাবে। তিনি জানান, এই প্রকল্পের মেয়াদ আগামী ২০২৬ সালের জুন মাস পর্যন্ত। আশা করা যায়, আগামী বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা থাকবে না।
এদিকে অতিবৃষ্টিতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের বড়পুকুরিয়া এলাকায় প্রায় এক কিলোমিটার রেললাইন পানিতে তলিয়ে যায়। রেললাইন পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখা হয়। রাত থেকে সকাল পর্যন্ত চাঁপাইনবাবগঞ্জে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে। এর ফলে আন্তঃনগর ট্রেন বনলতা এক্সপ্রেস গতকাল শনিবার চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে ২ ঘণ্টা ১৫ মিনিট দেরিতে ছেড়ে যায়। এছাড়াও ঈশ্বরদী থেকে ছেড়ে আসা চাঁপাইনবাবগঞ্জ অভিমুখী ৫ আপ রাজশাহী কমিউটার ট্রেন অতিরিক্ত পানির কারণে বড়পুকুরিয়া এলাকায় চার ঘণ্টা আটকা পড়ে। এর ফলে শত শত যাত্রী দুর্ভোগে পড়েন। রেললাইন থেকে পানি নামার পর পুনরায় ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ রেলস্টেশন মাস্টার শহিদুল ইসলাম জানান, সারারাত বৃষ্টিতে আমনুরা থেকে সদর উপজেলার বড়পুকুরিয়ায় প্রায় এক কিলোমিটার রেললাইন পানির নিচে তলিয়ে যায়। এর ফলে পুকুরিয়া এলাকায় ট্রেন চলাচল করতে পারছিল না। সেখানে ৫ আপ কমিউটার ট্রেনটি সারারাত আটকা ছিল।
অপরদিকে বারঘরিয়া দৃষ্টিনন্দন পার্কে বিনোদনপ্রেমীদের জন্য নির্মিত বসার স্থানটি ভেঙে মহানন্দায় দেবে গেছে।
অন্যদিকে জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার বিনোদপুর ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের পাগলা নদীর ওপর নির্মিত একটি সেতুর দুই ধার থেকে মাটি সরে যাওয়ায় হুমকির মুখে পড়েছে সেতুটি। এছাড়া এটি জনসাধারণের চলাচলের জন্য ঝুঁকিপূর্ণও হয়ে গেছে।
এদিকে মাছচাষি অলি ও রবি জানান, সদর উপজেলার সাতনৈই এলাকায় অন্তত ৩০টি পুকুরের পানি উপচে সমস্ত মাছ ভেসে গেছে। এতে তাদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
তবে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. শাহীনূর রহমান জানান— এখন পর্যন্ত কোথাও কোনো মাছ ভেসে যায়নি।
এদিকে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. ইয়াছিন আলী জানান, শুক্রবার ভোর থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় গড় বৃষ্টি হয়েছে ১৯১ মিলিমিটার। এর মধ্যে সদর উপজেলায় বৃষ্টি হয়েছে ২৬০ মিলিমিটার, শিবগঞ্জ উপজেলায় ১৭৫ মিলিমিটার, গোমস্তাপুর উপজেলায় ১৮০ মিলিমিটার, নাচোল উপজেলায় ১৭৫ মিলিমিটার ও ভোলাহাট উপজেরা বৃষ্টি হয়েছে ১৬৫ মিলিমিটার।
ড. ইয়াছিন আরো জানান, ভারী বৃষ্টিতে জেলায় ৪ হাজার ৪৫৯ হেক্টর জমির ফসল আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ২ হাজার ২৩৫ হেক্টর রোপা আমন, ৩৭ হেক্টর আলু, ৯১৭ হেক্টর সরিষা, শাকসবজি ৩১৬ হেক্টর, ২৪৪ হেক্টর পেঁয়াজ, ২৫০ হেক্টর মাসকলাই, ৬৮ হেক্টর ভুট্টা, ১৩ হেক্টর স্ট্রবেরি, ৩৭৯ হেক্টর রসুন। চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরির সময় মোট ক্ষতি ও কৃষকের সংখ্যা জানা যবে বলে তিনি জানান।
 
 
 
 