অটোরিকশা চালিয়ে পরিবার চালানো রোমান পেলেন জিপিএ-৫
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ভোলাহাট উপজেলার রোমান আলী শিশুবয়সেই ধরেছিলেন সংসারের হাল। পাশাপাশি চালিয়ে গেছেন পড়াশোনা। পরিশ্রমের ফসলও পেয়েছেন তিনি। চলতি বছর এসএসসি (ভোকেশনাল) পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সকল বিষয়ে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন। রোমান উপজেলার বজরাটেক সবজা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে পরীক্ষায় অংশ নেন।
রোমানের বাড়ি উপজেলার তাঁতিপাড়ায়। বাবা তোফাজ্জল হক অসুস্থ, শয্যাশায়ী। ২০১৩ সালে নিমগাছের ডাল ভাঙতে গিয়ে পড়ে গিয়ে কোমর ভেঙে যায়। পরে একটি কিডনিও বিকল হয়ে পড়ে। রোমান তখন নিতান্তই শিশু।
কয়েক বছর টেনেটুনে সংসার চললেও প্রাথমিকে পড়ার সময়ই রোমানকে নেমে পড়তে হয় জীবনযুদ্ধে। সংসারের খরচ আর বাবার ওষুধের খরচ জোগাতে অটোরিকশা নিয়ে রাস্তায় নামতে হয়। পরিশ্রম বেশি হলেও হাসিমুখে তা সয়ে গেছেন। পাশাপাশি পড়াশোনাকে ধরে রাখার চেষ্টা করেন।
প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে রোমান ভর্তি হন বজরাটেক সবজা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেখান থেকে অংশ নেন চলতি বছরের এসএসসি (ভোকেশনাল) পরীক্ষায়। ভাগ্য তাকে নিরাশ করেনি। কঠোর পরিশ্রমের পারিশ্রমিক হিসেবেই সকল বিষয়ে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন।
রোমান আলী জানান, শিশু বয়সেই সংসারের হাল ধরতে হওয়ায় তার জীবনে হতাশা নেমে এসেছিল। তবে হতাশা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছেন। মনের মধ্যে পণ করেছিলেন, যতই কষ্ট হউক, পড়াশোনা চালিয়ে যাবেন।
রোমান বলেন, পড়ালেখার ফাঁকে ফাঁকে অটোরিকশা নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন ভাড়া মারার জন্য। উপার্জিত আয় দিয়ে বাবার ওষুধ কেনার পর যা থাকত তা দিয়ে কোনো মতে সংসার চলত। তিনি বলেন, অটোরিকশা চালাতে গিয়ে শিক্ষক, বন্ধুবান্ধব ও পরিচিতদের দেখে প্রথম দিকে লজ্জা লাগছিল। তবে থেমে যাইনি। লক্ষ্য ছিল, যেভাবেই হোক সংসার এবং বাবার ওষুদের টাকা জোগাড় করতে হবে। পড়াশোনাও চালিয়ে যেতে হবে। তাই স্কুল করে অটোরিকশা চালানোর পর যেটুকু সময় পেতাম, সেটুকু সময় পড়াশোনার জন্য ব্যয় করতাম।
আগামীতে রোমানের লক্ষ্য, উচ্চ শিক্ষা অর্জনের। তবে বাধা দীনতা। আপাতত লক্ষ্য, এইচএসসির গণ্ডি পার করা। আর এইচএসসি পড়াশোনার খরচ চালানোর দুশ্চিন্তায় তিনি। এক্ষেত্রে কারো সহায়তা নিতেও আপত্তি নেই তার।
কথা হয় রোমানের চাচা জহরুল হকের সঙ্গে। তিনি জানান, ছোট ভাই তোফাজ্জলের ২০১৩ সাল থেকে চিকিৎসা চলছে। কোনোভাবে বেঁচে আছে সে। এখন ভাতিজা রোমানই রিকশা চালিয়ে সংসার চালায়। সারাদিন রিকশা চালিয়ে ক্লান্ত শরীরে রাতে যতটুকু সময় পেয়েছে, সেই সময়টুকু মন দিয়ে পড়েছে। এত প্রতিকূলতার মধ্যেও ভালো রেজাল্ট করেছে সে। তিনি বলেন, কেউ যদি পাশে দাঁড়ায়, তাহলে ছেলেটা উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে।
রোমানের মা রুনা বেগম বলেন, পড়াশোনার তেমন সুযোগ ছিল না। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে অভাবের সংসারের জন্য অটোরিকশা নিয়ে রাস্তায় বের হতো। যেটুকু সময় পেত, পড়াশোনা করত।
রোমানের বাবা বলেন, দেশের অনেক জায়গায় চিকিৎসা করতে গিয়ে সর্বস্ব হারিয়ে ফেলেছি। পরে একটি কিডনি নষ্ট হয়ে গেছে। তাই কাজকর্মও করতে পারি না। তিনি বলেন, ছেলে ভালো রেজাল্ট করার পরও তাকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারব কিনা, সেই দুশ্চিন্তায় আছি। এমনিতেই ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। তার ওপর রোমানের লেখাপড়ার খরচ।
তাই একমাত্র সন্তানের আগামী দিনের শিক্ষা অর্জনের জন্য মানুষের পাশাপাশি সরকারিভাবে সহযোগিতা কামনা করেন বাবা তোফাজ্জল।