১০ শতাংশ ঢাবি শিক্ষার্থীর যথাসময়ে স্নাতক শেষ হচ্ছে না

73

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) ১০ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী চার বছরে স্নাতক শেষ করতে পারছেন না। অনুষদভেদে এই হার ১০ থেকে ২০ শতাংশ। তবে বিজ্ঞানবিষয়ক অনুষদগুলোতে তা ২০ থেকে ৪৭ শতাংশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের নথিপত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন ছয় হাজার ৪২৩ জন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তর, ফলাফল প্রস্তুতকরণ শাখায় যোগাযোগ করে এই ঝরে পড়ার কোনো নির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে ঢাবির বিজ্ঞান অনুষদের এক শিক্ষক বলেন, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কতজন শিক্ষার্থী সময়মতো পড়াশোনা শেষ করছেন, কতজন ফেল করছেন, কতজন ঝরে পড়ছেন—এসব বিষয় নিয়ে নির্দিষ্ট তথ্য থাকা প্রয়োজন। তাহলে কেন শিক্ষার্থীরা ঝরে পড়ছেন সেসবের কারণ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় তার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারবে।

বিজ্ঞান অনুষদে ২০১৪-১৫ থেকে ২০১৭-১৮—এই চার শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে যথাক্রমে ৪৭, ৪৪, ৪০ ও ৪২ শতাংশ শিক্ষার্থী যথাসময়ে স্নাতক শেষ করতে পারেননি। জীববিজ্ঞান অনুষদে যথাসময়ে স্নাতক শেষ করতে না পারার হার যথাক্রমে ২২, ২৯, ২৮ ও ২২ শতাংশ। আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস অনুষদে ২৫, ২৫, ৩২ ও ১৫ শতাংশ। ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি অনুষদে যথাক্রমে ৩৫, ২৪, ২৯ ও ৩৫ শতাংশ শিক্ষার্থী যথাসময়ে স্নাতক শেষ করতে পারেননি।

বিজ্ঞান অনুষদের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ২০১৭-১৮ সেশনের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমার এত দিনে মাস্টার্সে থাকার কথা। কিন্তু আমি এখনো স্নাতক শেষ করতে পারিনি। আমাদের বিভাগগুলোতে পাসের হার কম। ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থীও পাস করে না ঠিকভাবে। এ জন্য সময়মতো অনার্স শেষ হয় না। শিক্ষকদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর আমাদের পাস-ফেল নির্ধারণ হয়। এই বিষয়গুলোতে প্রতিবছরই অনেক শিক্ষার্থী একেবারেই ঝরে পড়ে।’

বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক আব্দুস সামাদ বলেন, ‘ইচ্ছাকৃতভাবে কয়েকটি বিষয়ে ইমপ্রুভমেন্ট রেখে দেওয়া, দ্বিতীয়বার মেডিক্যালে বা গুচ্ছে ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়ে পড়াশোনা না করা, বিষয়গুলোতে আগ্রহ না থাকা, ইন্টারমিডিয়েট লেভেলের সঙ্গে এই লেভেলের পড়াশোনার বিস্তর তফাৎ থাকার কারণে এমন হয়। তবে এ হার বর্তমানে কমে আসছে। আমরা বর্তমানে শিক্ষকদের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যুক্ত করে দিচ্ছি। তাঁদের সমস্যাগুলো মনিটর করছি। সামনের বছরগুলোতে এ হার অনেকাংশে কমে আসবে।’

এদিকে ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদে যথাসময়ে স্নাতক শেষ করতে না পারার হার সবচেয়ে কম। এই অনুষদে ২০১৪-১৫ থেকে ২০১৭-১৮ পর্যন্ত চার শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে যথাক্রমে ৭, ৩, ৯ ও ৭ শতাংশ শিক্ষার্থী যথাসময়ে স্নাতক শেষ করতে পারেননি। কলা অনুষদে এই হার ১১ থেকে ১৮ শতাংশ, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদে ৩ থেকে ১২ শতাংশ, চারুকলা অনুষদে ৯ থেকে ২৫ শতাংশ, আইন অনুষদে ৭ থেকে ২৪ শতাংশ, ফার্মেসি অনুষদে ১৩ থেকে ৩০ শতাংশ এবং ইনস্টিটিউটগুলোতে ২ থেকে ১০ শতাংশ।

এই বিষয়ে ঢাবির ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘এর অর্থ যে শুধু ফেল করছে তা নয়। এর অর্থ যে শিক্ষাটা গ্রহণ করতে পারছে না। শিক্ষকদের এই জিনিস আগেই অনুভব করা উচিত, তাঁরা যা পড়াচ্ছেন তা শিক্ষার্থীরা গ্রহণ করতে পারছে কি না। আমার মনে হয় যে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক অনেক জরুরি। আমাদের সময়ে কলা সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ থেকেও বিজ্ঞান অনুষদে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক অনেক নিবিড় ছিল। এটা এখন আগের মতো নিবিড় নয়। আরেকটি কারণ হতে পারে, শিক্ষার্থীদের আগ্রহও অনেক কমে গেছে। বিজ্ঞানের তাত্ত্বিক বিষয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কমে গেছে, প্রায়োগিক, ইঞ্জিনিয়ারিং এসব বিষয়ে তাদের আগ্রহ। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আরো বেশি যোগাযোগ, তাদের আগ্রহ আরো বাড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব শিক্ষকদের। এ জন্য শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক নিবিড় হওয়া জরুরি।’

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, ‘অনেক শিক্ষার্থী পছন্দমতো বিষয় না পেয়ে, চাকরির বাজারে এই বিষয়ে তেমন সুযোগ নেই ইত্যাদি বিষয় মনে করে বিভিন্ন জায়গায় দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে চলে যেতে চায়। যারা চলে যেতে পারে তারা যায়। তবে যারা পারে না তাদের এই দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়ে প্রথম বর্ষের পড়াশোনা খারাপ হয়। যার প্রভাব তার প্রতিটি বর্ষের ফলাফলে থেকে যায়। আরেকটি কারণ হলো যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় তারা থাকা ও পড়াশোনার সুষ্ঠু পরিবেশ পায় না। আবাসিক হলে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের সিটের সুবিধা দেওয়ার ব্যবস্থা নেই। ফলে পড়াশোনার পরিবেশের কারণে তারা ঠিকঠাকভাবে পড়াশোনা করতে পারে না।’

উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘এ রকম ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী যথাসময়ে স্নাতক শেষ করতে পারে না, এ সংখ্যা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে আমাদের অনেক শিক্ষার্থীর মধ্যে একটা মানসিকতা থাকে যে একটা বিষয় পেলেই হলো। পছন্দমতো বিষয় না পেলেও তারা ঢাবিতে পড়তে চায়। পরবর্তী সময়ে তারা এতে ভালো ফলাফল অর্জন করতে পারে না। এ জন্য অনেক শিক্ষার্থী ঠিকঠাক সময়ে পড়াশোনা শেষ করতে পারে না।’