ইবার পরিসরে রাষ্ট্রবিরোধী নানা অপপ্রচার, অনলাইন জুয়াসহ বিভিন্ন প্রতারণা এবং ব্যক্তির বিরুদ্ধে মানহানিকর কর্মকাণ্ড বন্ধে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) সক্ষমতার ঘাটতি উদ্বেগ বাড়াচ্ছে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ ও ইনস্টাগ্রামের মূল প্রতিষ্ঠান মেটার সঙ্গে বাংলাদেশ এখনো পর্যন্ত কোনো চুক্তি (মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্টেন্স ট্রিটি-এমলেট) করতে পারেনি। ডাটাবেইসের বাইরে রয়ে গেছে অনেক নতুন-পুরনো মোবাইল হ্যান্ডসেট। ভুয়া রেজিস্ট্রেশন করা মোবাইল সিম দিয়েও চলছে নানা অপকর্ম।
এসব সিম ব্যবহার করে ভুয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খোলা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে হারে সাইবার অপরাধ বাড়ছে সে অনুযায়ী যথাযথ উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হয়েছে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ। এমলেট চুক্তি করতে না পারায় মেটার কাছ থেকে অনেক ধরনের নিশ্চিত সেবা নেওয়া থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। প্রয়োজনীয় তথ্য-প্রমাণসহ অভিযোগ করে ক্ষতিকর কনটেন্ট সরানোর আবেদন করলে সর্বোচ্চ ৩৫ শতাংশ কনটেন্ট সরায় মেটা।
কিন্তু এই প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ হওয়ায় অনেকে নানা ক্ষতির মুখে পড়েন। বিটিআরসির চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর শিকদার বিষয়টি অস্বীকার করছেন না। গতকাল তিনি বলেন, ‘আমরা আপত্তিকর কিছু দেখলে সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করি। সামর্থ্য অনুযায়ী ডিলিট করা হয়।
কিন্তু সরাসরি সব কিছু সরিয়ে ফেলতে বা ডিলিট করতে পারি না। অনেক পর্নোগ্রাফি ও জুয়ার সাইট আমরা বন্ধ করেছি। যেগুলো পারিনি সেগুলো সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ করেছি। কিন্তু অনেক অনুরোধ রক্ষা হয় না। ফেসবুক ৩৫ শতাংশ, ইউটিউব ৩০ থেকে ৩২ শতাংশ আর টিকটক ৯৫ শতাংশ অনুরোধ রাখে।’
বিটিআরসি চেয়ারম্যান আরো বলেন, ‘ফেসবুক ও ইউটিউবে বিজ্ঞাপন দিয়ে বহু মানুষকে প্রতারণা করা হচ্ছে। এগুলো বন্ধ করা যাচ্ছে না। চলতি মাসেই ওদের (ফেসবুক কর্তৃপক্ষ মেটা) সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আমি রাগারাগি করেছি। ওরা ওদের কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ডের কথা বলে। আমাদের সমাজে যেটা আপত্তিকর ওদের সমাজে সেটাকে আপত্তিকর হিসেবে দেখা হয় না। তার পরও ওদের লিগ্যাল টিম আছে। তারা আমাদের দেশের আইন সম্পর্কে সচেতন। আমরা বহুবার ওদের বলেছি। কিন্তু ওরা সব অনুরোধ রাখে না। সর্বশেষ সম্প্রতি একটি ভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছি। ওরা তো আমাদের দেশের গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা আয় করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকে আমরা চিঠি দিয়ে বলেছি, বিটিআরসির ক্লিয়ারেন্স ছাড়া যেন ওদের টাকা না দেওয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে সম্মত হলে হয়তো ওরাও আমাদের অনুরোধ রক্ষা করতে বাধ্য হবে।’
এ বিষয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘মেটা কলকাতায় ডাটা সেন্টার করলেই যে আমাদের এখানে লোকাল অফিস করবে না তা তো বলেনি। মেটার ফেসবুক আমাদের দেশে ব্যবসা করছে। ব্যবসার জন্যই তারা এ দেশকে হারাতে চাইবে না।’
বিটিআরসির তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে বেশি ব্যবহার হওয়া সামাজিক মাধ্যমগুলো হলো ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক, হোয়াটসঅ্যাপ, বিগো, লাইকি, ইমো ও টুইটার। এসব পরিসরে দেশে সাত কোটির বেশি ব্যবহারকারী রয়েছে। ব্যবহারকারীদের একটা অংশ একাধিক মাধ্যম ব্যবহার করে। বাংলাদেশে ১১ কোটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট সক্রিয় আছে বলে বিভিন্ন সময় সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেশি অ্যাকাউন্ট হওয়ার কারণে বাংলাদেশে এর অপব্যবহারও বাড়ছে।
সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো অধ্যাপক মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দেশের অনেক বড় প্রতিষ্ঠান ফেসবুক, গুগলে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। সেখান থেকে তারা ভ্যাট দিলেও ট্যাক্স দিচ্ছে না। এটা নিয়ে সারা বিশ্বেই আন্দোলন হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘তথ্য সুরক্ষার জন্য ভারত একটি আইনের দিকে অনেক এগিয়ে গিয়েছিল। আইনটির জন্য টুইটারের সঙ্গে তাদের ঝামেলা সৃষ্টি হয়েছিল। ভারত কিন্তু সেই আইন থেকে পিছিয়েছে। কিন্তু ভারতের আদলে আমাদের তৈরি করা খসড়াটি থেকে আমরা পিছিয়ে আসতে পারিনি। সেই খসড়াটি এখন ভেটিংয়ে আছে।’
র্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে. কর্নেল মশিউর রহমান জুয়েল বলেন, ‘সাইবার ক্রাইমের ভৌগোলিক কোনো সীমা নেই। এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। শনাক্ত করাটা অনেক ক্ষেত্রে কঠিন। তবে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, সরকারবিরোধী গুজব ছড়ানোর মতো বিষয়গুলো বিদেশ থেকে করা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রেও আমরা আইনি জটিলতার মধ্যে পড়ে যাচ্ছি।’