সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঢাকা বিভাগে: নিসচা

85

২০২২ সালে সারা দেশের সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা, নিহত ও আহতদের সংখ্যা নিয়ে পরিসংখ্যান উপস্থাপন করেছে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ নিসচা। এ ছাড়াও সড়ক দুর্ঘটনা রোধে তারা কিছু সুপারিশমালা উত্থাপন করেছে। নিসচার তথ্য দেখা যায়, ২০২২ সালে সর্বোচ্চ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ঢাকা বিভাগ ও ঢাকা জেলাতে। যেখানে এই বিভাগ ও জেলাতেই সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যাও সর্বোচ্চ।

বুধবার (৪ জানুয়ারি) সকাল ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের মোহাম্মদ মওলানা আকরাম খাঁ মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এসময় এসব তথ্য উপস্থাপন করেন নিরাপদ সড়ক চাই এর চেয়ারম্যান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন।

যেখানে বিভাগ ভিত্তিক, জেলা ভিত্তিক, দুর্ঘটনার ধরন, সড়ক পথ, নৌপথ, রেলপথ এবং সড়ক পথের যানবাহনের প্রকারভেদে দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান উপস্থাপন করা।

ঢাকা বিভাগে সর্বোচ্চ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে, যার সংখ্যা ১৫২৪টি। যেখানে নিহতের সংখ্যা ১৮২৭ এবং আহতের সংখ্যা ২৩৩৩ জন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রাম বিভাগে ৯৪৭টি। এসব দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতের সংখ্যা যথাক্রমে ১১২৮ এবং ১১৪৯ জন। সবচেয়ে কম দুর্ঘটনা ঘটছে সিলেট বিভাগে ২৮৬টি। যেখানে ৩৩৭ নিহত ও ৪৩৫ জন আহত হয়েছেন। এ ছাড়া রাজশাহী বিভাগে ৭৪৮, খুলনা বিভাগে ৬৪৫, বরিশাল বিভাগে ৩৮২, রংপুর বিভাগে ৫২৪ ও ময়মনসিংহ বিভাগে ৩৩৮টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় রাজশাহী বিভাগে ৮৮৬ নিহত ও ১০০৫ আহত, খুলনা বিভাগে ৭৬৫ নিহত ও ৮৫৬ আহত, বরিশাল বিভাগে ৩৯৯ নিহত ও ৮৮৫ আহত, রংপুর বিভাগে ৫১৫ নিহত ও ৫৫৫ আহত এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ৩৭৮ নিহত ও ৩০৬ জন আহত হয়েছেন।

এসবের মধ্যে সড়কপথে ৫০৭০, রেলপথে ২৫৬ এবং নৌপথে ৭৭টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। যেখানে ৫২৪২ জন পুরুষ ও ৯৯২ জন নারী নিহত হয়েছেন।

সড়কপথে সবচেয়ে বেশি ঘটেছে গাড়ি চাপা দেওয়ার ঘটনা। যার সংখ্যা ৩১৪৬টি। এ ছাড়া পেছন থেকে ধাক্কার ঘটনা ৯১টি। মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছে ৮৬৭টি, উল্টে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৬৫৫টি, খাদে পড়ে দুর্ঘটনা ঘটেছে ১৯০টি, কাপড় পেঁচিয়ে দুর্ঘটনা ঘটেছে ১১টি। আর ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে ঘটেছে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা। যেখানে পাঁচশোর কিছু কম দুর্ঘটনায় ৫০০ এর বেশি মানুষ নিহত হয়েছে।

এই পরিসংখ্যান প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়, ২০২২ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ৮১০৪ জন। ২০২১ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মোট নিহতের সংখ্যা ছিলো ৪৯৬৯ জন। গত বছরের তুলনায় এ বছর সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা ৩১৩৫ জন বেশি। ২০২০ সালে মোট মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৫২২৭ জন। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার প্রায় ৫% কম ছিল। গত বছর ২০২১ এর তুলনায় ২০২২ সালে শতকরা ৩৮% মৃত্যু বেশি হয়েছে।

আহতের পরিসংখ্যান প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২২ সালে মোট ৭০২৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৯৭৮৩ জন লোক আহত হয়েছেন। ২০২১ সালে ৪০৯২টি সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছিল ৫০৮৫ জন, এবছর আহতের সংখ্যা ৪৬৯৮ জন বেশি। গত বছরের তুলনায় আহতের সংখ্যা এবার ৪৮ শতাংশ বেশি বলে রিপোর্টে পাওয়া যায়। অনেক ছোট ছোট দুর্ঘটনায় আহতদের স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা করা হয় বলে পত্রিকায়ও প্রকাশ হয় না। এদের মধ্যে অনেকেই আজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করে। যা এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা সম্ভব হয়নি।

নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের সুপারিশমালা হলো- সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ এর পুরোপুরি বাস্তবায়ন সংক্রান্ত জরুরি কার্যক্রম গ্রহণ করা, প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক নির্দেশিত ৬ দফাসহ ১১ দফা সম্বলিত টাস্ক ফোর্স কর্তৃক দাখিলকৃত ১১১টি সুপারিশনামা যত দ্রুত সম্ভব বাস্তবায়ন করা। সেই সাথে হাইওয়েতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য যোগাযোগ মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যৌথ তত্ত্বাবধানে উচ্চ পর্যায়ের মনিটরিং সেল গঠন করে তাদের মাধ্যমে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার ও সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে মহাসড়কের যাবতীয় বিষয়সমূহ মনিটরিং করতে হবে। করোনা নিয়ে সরকারিভাবে যেরকম প্রচার প্রচারণা চালানো হচ্ছে  একইভাবে সড়ক দুর্ঘটনা নিরসনে প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে। বিভিন্ন মিডিয়া মাধ্যমে সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান প্রচারের যে ধারাবাহিকতা শুরু হয়েছে ব্যাপকভাবে তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে।

স্কুলের পাঠ্যক্রমে সড়ক দুর্ঘটনারোধের বিষয়সমূহ অন্তর্ভুক্ত করার যে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, তা অবশ্যই বাস্তবায়ন করতে হবে। ঢাকা রুট ফ্রান্সাইজের যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন জরুরি। যেমন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে পরীক্ষামূলক একটি রুটে ইতোমধ্যে রেশনালাইজেশন কার্যক্রমের আওতায় (ঘাটারচর-গুলিস্তান-মতিঝিল হয়ে সাইনবোর্ড-কাঁচপুর ব্রিজ পর্যন্ত) চালু করা হয়েছে গণপরিবহন সার্ভিস। এই সার্ভিস ঢাকা সিটি ও ঢাকার আশপাশে যত দ্রুত সম্ভব চালু করা হলে, আমরা মনে করি যানজট এবং দুর্ঘটনার সংখ্যা নিয়ন্ত্রিত হবে।

সেইসাথে ট্রাফিক সিগন্যাল অমান্য করা, যত্র-তত্র গাড়ী পার্কিং করা, নির্দিষ্ট স্থান ব্যতিরেকে যেখানে-সেখানে যাত্রী উঠানো-নামানো, ওভার টেকিং করা, পাল্টা-পাল্টি ও বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো; অতিরিক্ত যাত্রী ও মাল বোঝাই করা, গাড়ির ছাদে যাত্রীবহন করা, ওভারব্রিজ কিংবা আন্ডারপাস বা জেব্রা ক্রসিং থাকা সত্বেও সেগুলো ব্যবহার না করার প্রবণতাকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মাধ্যমে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

ঢাকা-চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল মহাসড়কের মতো সকল মহাসড়ক এবং প্রধান সড়কে একমুখী চলাচলের সিদ্ধান্ত নিয়ে দীর্ঘ এবং উচ্চতা-সম্পন্ন সড়ক বিভাজন তথা রোড ডিভাইডারের ব্যবস্থা করতে হবে। সকল মহাসড়ক এবং প্রধান সড়ককে অবশ্যই ন্যূনতম চার লেনে উন্নীত করতে হবে। মহাসড়কের পাশে হাটিকুমরুল-বনপাড়া মহাসড়কের মত দু’পাশে ধীরগতির যানবাহন চলাচলের জন্য আলাদা সড়ক (সার্ভিস রোড) নির্মাণ করতে হবে। পথচারীদের নির্বিঘ্নে চলাচলের জন্য ফুটপথগুলো দখলমুক্ত করে যেখানে ফুটপাত নেই সেখানে ফুটপাত তৈরির ব্যবস্থা করতে হবে। নিয়মিত মনিটরিংয়ের মাধ্যমে পুনরায় যেন ফুটপাত দখল না হয় এ বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। এ ব্যাপারে সকল সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভা মেয়রদের নিকট বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।

সড়কের ত্রুটিগুলো অচিরেই দূর করতে হবে। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে ত্রুটিগুলো দূর করার কারণে সড়ক দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমে গেছে। একইভাবে অন্যান্য মহাসড়কের ত্রুটিগুলো দূর করলে সড়ক দুর্ঘটনা কমবে বলেও আশা করা যায়।

দেশের ৬৬টি প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণরত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সড়ক দুর্ঘটনারোধে করণীয় সম্পর্কিত যে প্রশিক্ষণ নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) এর নিজস্ব অর্থায়নে দেওয়া করা হচ্ছে এবং এর মাধ্যমে প্রতিটি শিক্ষক তাদের স্কুলে গিয়ে ছাত্র-ছাত্রী, অভিভাবক ও স্থানীয় জনগণকে সচেতন করছে; একইভাবে ইমাম প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটসহ মাদ্রাসা শিক্ষক ও স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের সরকারি খরচে সড়ক দুর্ঘটনারোধে করণীয় সম্পর্কিত প্রশিক্ষণ দিতে হবে। যাতে তারা স্ব স্ব এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনারোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। সেইসাথে স্কুল কার্যক্রমের মধ্যে স্কাউট, গার্লস গাইড, কাব-এর ইউনিটগুলোর মত প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে একটি রোড সেফটি ইউনিট গঠনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয়েছে, যারা পড়ালেখার পাশাপাশি সড়ক দুর্ঘটনারোধে বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারবে।