শিশু জোনায়েদ মোল্লা কুয়েতগামী কুয়েত এয়ারওয়েজের ফ্লাইটে

81

সবই ছিল যথারীতি স্বাভাবিক। বিমানবন্দরের প্রতিটি সিকিউরিটি পয়েন্টে ছিল নিরাপত্তাকর্মীদের সজাগ সতর্ক অবস্থান। তবুও খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে, অথচ কি এক অবিশ্বাস্য কৌশলে সবাইকে বোকা বানিয়ে ভেতরে ঢুকে যেতে সক্ষম হয় ১২ বছরের শিশু জোনায়েদ।
বয়সটা তার ১২, কিন্তু তার আচরণ ছিল ঠিক যেন রবীন্দ্রনাথের ছুটি গল্পের সেই ফটিকের মতোই। আগে পিছে নারী পুরুষ যাকেই দেখেছে, সবাইকে বাবা মা আর অভিভাবক পরিচয় দিয়েই ঢুকে গেছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মতো কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেদ করে। এভাবে পাসপোর্ট ভিসা টিকিট ছাড়াই বিমানবন্দরের চার নং গেট, চেক ইন কাউন্টার, ইমিগ্রেশন, আইএনএস ও হোল্ডিং লাউঞ্জ পেরিয়ে একবারে ফ্লাইটের সিট পর্যন্ত। এতগুলো নিরাপত্তা গেট পেরিয়ে কীভাবে সেটাই এখন ভাবিয়ে তুলেছে গোটা বিমানবন্দরের সমস্ত গোয়েন্দা সংস্থা ও নিরাপত্তাকর্মীদের। সোমবারের এমন অবিশ্বাস্য কা-ে বিমানবন্দরের ১০ জনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন।

এদিকে ওই রহস্য বালককে বুধবার সকালে ফিরিয়ে দেওয়া হয় তার এক চাচার কাছে। এয়ারপোর্ট থানা পুলিশের কাছে কাটানোর পর তাকে শেষ পর্যন্ত তার স্বজনের কাছে হস্তান্তর ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। একবার পুলিশ ভেবেছিল তাকে বিকল্প পন্থা হিসেবে কিশোর অপরাধ বা সংশোধনাগারে পাঠানোর। কিন্তু দেশের সংশোধনাগার বা কিশোর অপরাধকেন্দ্রের যে হাল হকিকত তাতে ভরসা ছিল না কোনো সংস্থারই। এমন ভাবনা থেকেই চাচার কাছেই ফিরিয়ে দেওয়া হয়। মঙ্গলবার রাত ৩টা ১০ মিনিটে ঢাকা থেকে কুয়েতগামী কুয়েত এয়ারওয়েজের ফ্লাইটে (কেইউ-২৮৪) এমন অবিশ্ব্যাস্য কা- ঘটে।
এদিকে বুধবার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পরিদর্শনে দেখা যায়- পাসপোর্ট ছাড়া ফ্লাইটে ওঠার এ অবিশ্বাস্য ঘটনায় সবাই বিস্মিত। সবারই কৌতূহলী প্রশ্ন একটাই এটা কিভাবে সম্ভব? দৈনিক জনকণ্ঠেরও একই প্রশ্নের যা জানা গেল তা খুবই স্বাভাবিক। যার অর্থ দাঁড়ায় এ রকম, প্রতিটি পয়েন্টের নিরাপত্তাকর্মীরাই মনে করে নিয়েছিল এত যাত্রীর ভিড়ে ছেলেটির মা বাবা অথবা অভিভাবক হয়তো সামনেই কোথাও আছে। এই ভেবে সবাই তাকে ছেড়ে দিয়েছে। এভাবেই ছাড়তে ছাড়তে ফ্লাইটের সিট পর্যন্ত তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
এ সম্পর্কে বুধবার বিমানবন্দরের সেই রাতের ঘটনার পুরো দৃশ্য সিসিটিভির ফুটেজে যা দেখা গেছে- তা যতটাই স্বাভাবিক মনে হয়- ততটাই অবিশ্বাস্য লাগে।
যেমন সিসি টিভিতে দেখা গেছে জোনায়েদ রাতে বিমানবন্দরের ৪নং গেটের সামনে আসতেই এক আনসার সদস্য তাকে জিজ্ঞাস করে তোমার সঙ্গে কে? সে উত্তর দেয় পেছনে আমার মা। আনসার দেখতে পান, সামনেও ক’জন যাত্রী পেছনেও ক’জন নারী পুরুষ। এভাবে সে ভেতরে ঢুকে যাওয়ার পর আনসার সদস্য আর কাউকে কিছুই জিজ্ঞাসাও করেননি। ভেতরে গিয়ে সে কি করছে সেটা তার দায়িত্বেও পড়েনি।
ভেতরে প্রবেশ করলেও সে কোনো কুয়েত এয়ারের চেক ইন কাউন্টারে যায়নি। তাকে দেখা গেছে, একটি কিছুক্ষণ পায়চারি করার পর ইমিগ্রেশন প্রবেশ গেটের সামনে। সে অপেক্ষায় ছিল সেখানে কোনো নারী পুরুষ জটলা হয় কি না। তার মতোই তাই হয়েছে। কিছুক্ষণ পর দেখা গেল ক’জন নারী পুরুষ আগে পিছে। সে তাদের মাঝেই ঢুকে পড়ে। গেটে ইমিগ্রেশন নিরাপত্তা কর্মী কজন নারী পুরুষের একাধিক পাসপোর্ট চেক করতে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছেন। তাদের মাঝেই শিশুটিও ঢুকে পড়েছে। তাকে দেখে নিরাপত্তাকর্মীর কাছে মনে শিশুটি হয়তো তাদের সঙ্গেই।

এভাবে ইমিগ্রেশনের কাউন্টারে তার সামনের যাত্রীদের একের পর এক পাসপোর্টে সিল মেরে বিদায় করা হচ্ছে। তাদের সঙ্গে শিশুটি যে কাউন্টারের নিচে দাঁড়ানো সেটাও দেখেননি ইমিগ্রেশন পুলিশ। স্বভাবতই জোনায়েদ ওদেরই সন্তানের ভঙ্গিতেই ইমিগ্রেশনের গেট পেরিয়ে চলে যায় হোল্ডিং ফাইনাল আইএনএস গেটে। সেখানেও দেখা গেছে আগে পিছে নারী পুরুষের মাঝে কারোর সন্তানের মতোই ভাব নিয়েই চলে গেছে একদম হোল্ডিং লাউঞ্জে। ওখানে কিছুক্ষণ বসার পর সোজা চলে যায় কুয়েত এয়ারের ফ্লাইটে। এখানেও দেখা গেছে ফ্লাইটের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দুজন বিমানবালা সবাই হাত দিয়ে ইশারা দিয়ে যার যার আসনের এরিয়া দেখাতে।

তারা কোনো যাত্রীর পাসপোর্টও হাতে নেননি। জোনায়েদ সরাসরি ভেতরে ঢুকে একটা আসনে বসে পড়ে। কিছুক্ষণ পর ওই সিটের প্রকৃত যাত্রী যখন তাকে ওঠাতে বলেন তখনই সবার টনক নড়ে। বিমানবালারা ছুটে আসে। তার হাতে পাসপোর্ট টিকিট বোর্ডিং কার্ড কিছুই নেই। তাহলে কিভাবে সম্ভব? জোনায়েদকে প্রশ্নবানে জর্জরিত করতে থাকলেও সে কৌশলে সব এড়িয়ে গেছে। অবস্থা জটিল আকার ধারণ করায় বিমানবালারা ফ্লাইটে সব যাত্রীর মাথা গুনলেন। তখন নিশ্চিত হন জোনায়েদ অবৈধভাবেই ফ্লাইটে উঠেছে। তাৎক্ষণিক তাকে নিরাপত্তাকর্মী ডেকে হস্তান্তর করা হয়। রাতে প্রাথমিকভাবে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে নিশ্চিত হয় সবাই নিরাপত্তা ফাঁকফোকরেই সে ভেতরে ঢুকেছে। রাতেই হৈচৈ পড়ে যায় গোটা বিমানবন্দরে। পরদিন মঙ্গলবার বিমানবন্দর থানা পুলিশ জোনায়েদের বাবা মাকে ফোন করে ডেকে পাঠায়। কিন্তু তারা কেউ আসেনি। বুধবার সকালে তার এক চাচা এসে নিয়ে যায় গ্রামের বাড়িতে। চাঞ্চল্যকর ও অবিশ্বাস্য এ ঘটনায় তোলপাড় চলে। এ ঘটনায় ৫ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। বিমানবন্দর পুলিশ জানায়, জোনায়েদের বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুর থানার বরইহাটি গ্রামের বাঁশবাড়িয়ায়।

তার বাবার নাম ইমরান মোল্লা ও মা জেসমিন আক্তার। তাদের পরিবারেও রয়েছে নানা অশান্তি। ছেলেটিও কিছুটা অপ্রকৃতিস্থ ও রহস্যময়। জোনায়েদ গোপালগঞ্জের একটি মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। ৫ দিন আগে বাসা থেকে পালিয়ে যায়। তবে বাসা থেকে পালানো তার প্রথম নয়। এর আগেও একাধিকবার বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিল সে। পরে নিজে নিজেই বাড়িতে ফিরে যেত। আবার এর আগেও একবার সে বিমানন্দরে এসেছিল। তখনো সে বিমানবন্দরে ঢুকতে চেয়েছিল। কিন্তু নিরাপত্তাকর্মীরা তাকে ফিরিয়ে দেয়।
পুলিশ জানিয়েছে, একান্ত কৌতূহলবসত প্লেনে উঠেছিল জোনায়েদ। গত তিন মাসে চার বার বাড়ি থেকে পালিয়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যায় সে। এর আগেও প্লেনে চড়তে ব্যর্থ হয়ে বাড়িতে ফিরে গেছে। এবার কৌশল পাল্টে বিমানবন্দরে ঢুকতে সক্ষম হয়। একটি পরিবারের সঙ্গে কথাবার্তার মাধ্যমে মিশে যায় সে। তাই কেউ ধরতে পারেনি।
এ বিষয়ে বুধবার বিমানবন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আজিজুল হক মিয়া বলেন, আগে মাদ্রাসায় পড়লেও বর্তমানে শিশুটি পড়াশোনা করছে না। পরিবার জানে সে বাড়ি থেকে বের হলেও কয়েকদিন পরে আবার ফিরে যায়, তাই পুলিশে জানায়নি। যেহেতু ঘটনাটি একজন শিশু ঘটিয়েছে আমরা শিশুদের ওভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারি না। তবে সে জানিয়েছে, বিমান দেখতে বিমানবন্দরে এসেছে, লোকজনের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে প্লেনে উঠেছে। বুধবার ভোরে তাকে বাবা-মার কাছে হস্তান্তর করে পুলিশ। এবার শিশুটির বাবা-মাকে ভবিষ্যতে শিশুর বিষয়ে আরও যতœশীল হওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়।

বেবিচক চেয়ারম্যান জানান, এ ঘটনায় যাদের গাফিলতি ছিল গতকালই প্রত্যেককে সাসপেন্ড (প্রত্যাহার) করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। তাদের মধ্যে ১০ জনকে চিহ্নিত করে প্রত্যাহার করা হয়েছে। তারা ইমিগ্রেশন পুলিশ, এভসেক, কুয়েত এয়ারওয়েজ এবং গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলার। এ ঘটনায় ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কমিটি তাদের প্রতিবেদনে পুরো ঘটনাটি বিস্তারিতভাবে তুলে ধরবে।
জানতে চাইলে, বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন ড. কামরুল ইসলাম বলেন, যেই মুহূর্তে বিমানবন্দরের সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা শৃঙ্খলায় ফিরিয়ে আনা হয়েছে, কর্মচারীদের আচরণ বিধি সম্পর্কে সচেতন করে সেবা নিশ্চিত করা হয়েছে সেই মুহূর্তে এরকম একটি ঘটনা খুবই অনাকাক্সিক্ষত ও দুর্ভাগ্যজনক। আমরা এখন সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েই বিষয়টি দেখছি।
বিমানে উঠে পড়া শিশুর বাড়ি মুকসুদপুর ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা মুকসুদপুর থেকে জানান, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জোনায়েদ মোল্লা নামের যে শিশুটি কুয়েত এয়ারওয়েজের বিমানে উঠে যায় তার বাড়ি গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর। শিশু জোনায়েদ মোল্লা মুকসুদপুরের বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়নের পারইহাটি গ্রামের ইমরান মোল্লার ছেলে। এই ঘটনায় মুকসুদপুর উপজেলাব্যাপী চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। শিশুটির বাড়িতে ব্যাপক লোকজনের সমাগম হচ্ছে।

শিশুটির চাচা ইউসুফ মোল্লা জানান, তার ভাতিজা জোনায়েদ মোল্লা খুবই দুরন্ত। তাকে হাফেজিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি করা হয়েছিল। সেখান থেকে সে বারবার পালিয়ে আসে বলে তাকে মাদ্রাসা থেকে এনে স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে। তবুও সে বাড়ি থেকে মাঝে মধ্যে হারিয়ে যায় আবার একাই ফিরে আসে। তারই ধারাবাহিকতায় গত এক সপ্তাহ আগে সে বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। পরবর্তীতে আমরা তার খোঁজ পাই। সেখানে গিয়ে জানতে পারি সে সেখান থেকেও পালিয়ে গেছে। বিমানে উঠে পড়ার ব্যাপারে আমরা কিছুই জানি না। শিশু জোনায়েদ মোল্লা জানায়, সে বিমানবন্দরের সব নিরাপত্তারক্ষীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে বিমানে উঠে পড়ে। সে কোনো কিছু না ভেবে শখেরবশে বিমানে উঠে। সে জানেই না যে বিমানে উঠতে বডিং পাস, পাসপোর্ট এবং ভিসা লাগে। সে ভুল করে বিমানে উঠে পড়েছে বলে জানায়।