লালনের আখড়া, ছেউড়িয়া, কুমারখালি

666

এই আখড়াটা একটু কেমন যেন। মানুষগুলোও একটু ভিন্ন। আপাত দৃষ্টিতে বদ্ধ এক পাগলী চিৎকার করে বলছে- আমারে না হয় ঠকালি, আল্লারে ঠকাবি কেমনে? ধর্ম বিশ্বাসীদের জন্য শক্ত প্রশ্ন। কিছু ফকির, অডিটেরিয়ামে অস্থায়ী ঠাই নিয়েছেন। যেমনটা সবসময় কেউ না কেউ নেয়। হয়তো বাউল জীবনে- গানকেই তারা সবচেয়ে আপন সঙ্গী করেছেন ‘গান গাই আমার মনরে বুঝাই, মন থাকে পাগলপারা, আর কিছু চায়না মনে গান ছাড়া। কিছু পেশাদার বাউল সঙ্গীত শিল্পীরও আনাগোনা দেখা যায়। তারা ঠিক বাউল বিশ্বাসে দীক্ষিত নয়, কিন্তু তাদের জন্যই বাউল সঙ্গীত আমাদের কাছে সহজে পৌছায়। মূল ফটক দিয়ে সোজা তাকালে লালনের মাজার দেখা যায়। ভেতরে লালন আর তার পালক মা মতিজান ফকিরানীর কবর। বহিঃপার্শে আরো ১৫ জন এবং পেছন দিকে একটু দূরে আরও ৮ জনের কবর আছে। লালনের আখড়ার বর্তমান খাদেম ফকির মোহাম্মদ আলি শাহ্ও একটু অন্য ধরনের- আপাদমস্তক সফেদ মানুষ। সম্ভবত, বেশ বৈশিষ্ট্য ম-িত মানুষটির অতি সাধারণ আচরণই তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। লালনকে (১৭৭৪-১৮৯০সাল) বাউল গানের অগ্রদূতদের অন্যতম একজন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। লালন ফকিরকে আমরা-লালন, লালন সাঁই, লালন শাহ, মহাত্মা লালন ইত্যাদি নামেও চিনি । তাকে ‘বাউল সম্রাট’ও বলা হয়। তার গানের মাধ্যমেই উনিশ শতকে বাউল গান বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তার গানেই প্রভাবিত হয়েই কাঙাল হরিনাথ দেশের প্রথম সংঘবদ্ধ বাউল দল ‘শখের বাউল’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার গান ও দর্শন দিয়ে প্রভাবিত হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও অ্যালেন গিন্সবার্গের মতো বহু খ্যাতনামা ও সাধারণ মানুষ। লালনের জীবদ্দশায় তার একমাত্র স্কেচটি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। এটি ছাড়া লালনের অবয়ব সম্পর্কে আর কোন ধারণা পাওয়া যায় না। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্কেচ নিয়েও বেশ বিতর্ক আছে। লালন সাধারণ মানুষের পাশে এসে দারিয়েছেন বহু বার। কাঙাল হরিনাথের গ্রামবার্তা প্রকাশিকায় ঠাকুর-জমিদারদের প্রজাপীডনের সংবাদ ও তথ্য প্রকাশের সূত্র ধরে উচ্চপদস্থ ইংরেজ কর্মকর্তারা প্রত্যক্ষ অনুসন্ধানে আসেন। এতে কাঙাল হরিনাথের উপর বেজায ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন ঠাকুর-জমিদারেরা। তাঁকে শায়েস্তা করার উদ্দেশ্যে লাঠিয়াল পাঠালে- শিষ্যদের নিয়ে লাঠিয়ালদের প্রতিরোধ করতে লালন কাঙাল হরিনাথের পাশে এসে দাঁড়ান। ১৮৯০ সালের ১৭ই অক্টোবর লালন ১১৬ বছর বযসে কুষ্টিয়ার কুমারখালির ছেউড়িয়াতে নিজ আখড়ায মৃত্যুবরণ করেন। একদিন হয়তো এই পৃথিবীতে বাউলদের দর্শনই সবচে শক্তিশালী হবে। লালন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শাহ্ আব্দুল করিম – সব বাউলাদের দর্শন একসাথে মিলবে সে মিছিলে। যেভাবে যাবেন : কুষ্টিয়াকে লালনের শহরও বলে। চৌরহাস মোড়, মজমপুর গেট, বা রেল স্টেশন যেখান থেকেই রওনা দেন না কেন গড়পড়তা ২০ টাকার রিক্সা ভাড়া খরচ পড়বে। আর অটোতে গেলে মাথাপ্রতি খরচ হবে ১০ টাকা। লালনের আখড়া কুমারখালি উপজেলার মধ্যে পরলেও কুষ্টিয়া জেলা শহর থেকে যাওয়া সোজা।