র‌্যাব সদস্যদের শৃঙ্খলা বজায় রাখার আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর

344

র‌্যাব সদস্যদের শৃঙ্খলা বজায় রাখার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, প্রতিটি সদস্যকে দেশপ্রেম, সততা, কর্তব্যনিষ্ঠা, দক্ষতা ও পেশাদারিত্বের মনোভাব নিয়ে দায়িত্ব পালন করতে হবে। মনে রাখতে হবে আপনারা একটি শৃঙ্খলা-বাহিনীর সদস্য। প্রধানমন্ত্রী বলেন, নৈতিক স্খলন যে কোন বাহিনীর মনোবল দুর্বল করে দেয়। মনে রাখবেন, জনগণের পয়সায় আমাদের-আপনাদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করা হয়। আমরা সকলেই জনগণের সেবক। সেই জনগণ যেন কোনভাবেই নিগৃহীত না হয়, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুধবার সকালে রাজধানীর কুর্মিটোলায় র‌্যাব সদর দপ্তরে র‌্যাব ফোর্সেস’র ১৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত দরবারে প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। র‌্যাবের মহাপরিচালক অতিরিক্ত আইজিপি বেনজির আহমেদ অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন। প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব) তারিক আহমেদ সিদ্দিকী, পুলিশের আইজিপি মো শহীদুল হক সহ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা এবং আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। এরআগে, প্রধানমন্ত্রী র‌্যাব সদর দপ্তরে এসে পৌঁছলে মেজর মঞ্জুরুল ইসলামের নেতৃত্বে র‌্যাব ফোর্সেস অনার গার্ড প্রধানমন্ত্রীকে গার্ড অব অনার প্রদান করে। অপরাধ ও জঙ্গিদমনে ২০০৪ সালে বাংলাদেশ পুলিশের র‌্যাব ইউনিট গঠন করা হয়। বাংলাদেশ পুলিশ, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, বিজিবি এবং আনসার সদস্যদের নিয়ে এই বাহিনী গঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার, সন্ত্রাস, জঙ্গি, চরমপন্থী দমনসহ সুন্দরবনের জলদস্যুদের আত্মসমর্পণ এবং দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের চরমপন্থী দমনেও র‌্যাব কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে। র‌্যাব সদস্যদের একটি সুশৃংখল বাহিনীর সদস্য হিসেবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই বাহিনীর প্রতিটি সদস্যকে দেশপ্রেম, সততা, কর্তব্যনিষ্ঠা, দক্ষতা ও পেশাদারিত্বের মনোভাব নিয়ে দায়িত্ব পালন করতে হবে। শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশ পালন করা একটি বাহিনীর সদস্যদের জন্য অবশ্য পালনীয় কর্তব্য উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নৈতিক স্খলন যে কোন বাহিনীর মনোবল দুর্বল করে দেয়। মনে রাখবেন, জনগণের পয়সায় আমাদের-আপনাদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করা হয়। আমরা সকলেই জনগণের সেবক। সেই জনগণ যেন কোনভাবেই নিগৃহীত না হয়, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। তিনি বলেন, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির গভীর সম্পর্ক রয়েছে। মানুষের জানমালের নিরাপত্তা না থাকলে দেশে বিনিয়োগ আসবে না, কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে না। জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধান করাই র‌্যাব সদস্যদের মূল লক্ষ্য উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, ‘আইন-কানুন এবং নিয়ম-নীতি মেনে আপনাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করবেন- এটাই আমার প্রত্যাশা।’ বিগত ৮ বছর ধরে জনগণের জীবনমান উন্নয়নে আমরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতার ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত ও সুখী-সমৃদ্ধ স্বপ্নের ‘সোনার বাংলাদেশ’ গড়ার লক্ষ্যে আজ আমরা অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছি। প্রধানমন্ত্রী র‌্যাব সদস্যদের উদ্দেশে বলেন, এ বাহিনীর নতুন নতুন ব্যাটালিয়ন উদ্বোধন করা হয়েছে। র‌্যাবের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও সুযোগ-সুবিধা বহুগুণে বৃদ্ধি করা হয়েছে। র‌্যাব সদরদপ্তর এবং র‌্যাব ট্রেনিং স্কুলসহ সকল ব্যাটালিয়নের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। র‌্যাব সদরদপ্তর, র‌্যাব-১৩ এবং ১৪ ব্যতীত সকল ব্যাটালিয়নের অবকাঠামো নির্মাণ কাজ একনেক-এ অনুমোদিত হয়েছে। ২০১৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত র‌্যাব-এর বাজেট প্রায় দ্বিগুণ করা হয়েছে। অপরাধী সনাক্ত করতে র‌্যাবের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য সরকারের পদক্ষেপ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ বাহিনীতে অস্পষ্ট ফিঙ্গারপ্রিন্ট সংগ্রহ, টেলিফোন সেট ট্রাকিং-এর যন্ত্রসহ অত্যাধুনিক সরঞ্জামাদি সংযোজন করা হয়েছে। র‌্যাবের অপারেশনাল শক্তি বৃদ্ধি করতে দু’টি হেলিকপ্টারসহ প্রয়োজনীয় যানবাহন বরাদ্দ দিয়েছি আমরা। ফলে, র‌্যাব জল, স্থল ও আকাশপথে দ্রুত আভিযান কার্যক্রম পরিচালনার সক্ষমতা অর্জন করেছে। পরিণত হয়েছে একটি ত্রিমাত্রিক বাহিনীতে।র‌্যাব ফোর্সেস’র বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা এবং র‌্যাব স্পেশাল ফোর্সেস’র ওপর অনুষ্ঠানে দুটি ভিডিও চিত্র প্রদর্শিত হয়। অনুষ্ঠানে সুন্দরবনে র‌্যাবের কর্মকান্ড নিয়েও একটি ভিডিও চিত্র পরিবেশিত হয়। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে র‌্যাব-৯ এর জন্য নবনির্মিত হেডকোয়াটার্স ভবনেরও ফলক উন্মোচন করেন। যদিও যে হেলিকপ্টার আমরা দেখেছি তাতে ৫ জনের বেশি অপারেশন পরিচালনায় গেলেও এর বেশি শক্তি সম্পন্ন হেলিকপ্টার প্রয়োজন। সেখানে আমি মনে করি, যার যেখানে সক্ষমতা আছে সেটা একে অপরকে, বাহিনীগুলোর পারস্পরিক সহযোগিতা করা উচিত এবং পরবর্তীতে সেসব ঘাটতিসমূহ পূরণ করা হবে, উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু জানতেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা সকল উন্নয়নের পূর্বশর্ত। এ লক্ষ্যে তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনের পাশাপাশি দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগ যখনই সরকার গঠন করেছে, তখনই দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যাপক উন্নয়ন করেছে। দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা খাতে বরাদ্দকৃত অর্থকে আমরা ব্যয় নয়, বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করি। তিনি বলেন, দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় র‌্যাব যথেষ্ট সাফল্য অর্জনে সক্ষম হয়েছে। অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার, সন্ত্রাস, জঙ্গি, চরমপন্থী দমনসহ সকল ধরণের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে র‌্যাব অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলেছে। র‌্যাব সদস্যগণ জঙ্গি সংগঠনের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাসহ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জঙ্গি সদস্যকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে এবং তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অবৈধ অস্ত্র, বোমা ও বিস্ফোরক দ্রব্য উদ্ধার করেছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। র‌্যাবের অভিযানের সাফল্য সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সম্প্রতি সিলেটের জঙ্গি আস্তানা আতিয়া মহলকে দক্ষতা ও সাহসিকতার সঙ্গে র‌্যাব বিস্ফোরক মুক্ত করে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করে। এ সময় তিনি, সিলেটের জঙ্গি আস্তানা আতিয়া মহলে অভিযান পরিচালনার সময় নিহত র‌্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালক লে কর্নেল মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে স্বজনদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করেন। এছাড়া র‌্যাব’র দায়িত্ব পালনকালে নিহত দেশপ্রেমিক সদস্যদের সকলের তিনি রুহের মাগফেরাত কামনা করেন। র‌্যাবের পক্ষ থেকে সুন্দরবনের জলদস্যুদের আত্মসমর্পণ করানো ছিল এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের চরমপন্থী দমনেও র‌্যাব কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক চরমপন্থীদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। র‌্যাব তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করেছে বিপুল পরিমাণ অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশীয় অস্ত্র।তিনি বলেন, অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায় করে এ ধরনের অপরাধীদের বিরুদ্ধে র‌্যাব কার্যকর অভিযান পরিচালনা করে আসছে। পাশাপাশি মাদক পাচার প্রতিরোধ এবং এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্যসংখ্যক অপহƒত শিশু ও ব্যক্তিকে তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। দেশীয় অসাধু ব্যবসায়ীর পাশাপাশি বিদেশী চোরাচালানী, জাল মুদ্রা ও পাসপোর্ট প্রস্তুতকারী এবং অবৈধ ভিওআইপি বিরোধী অভিযান পরিচালনা করে রাষ্ট্রীয় রাজস্ব বৃদ্ধিতে এই বাহিনীর অবদানকেও তিনি স্মরণ করেন। র‌্যাব জননিরাপত্তায় হুমকি ও আতঙ্ক সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা এবং ভেজাল বিরোধী অভিযান জোরদার করে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার মাধ্যমে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করে জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে এনেছে।প্রধানমন্ত্রী এখানে আত্মসমর্পণকারীদের উদ্দেশ্যে বলেন, এই আত্মসমর্পণের পরে সুন্দরবন এখন একটি নিরাপদ জনপদ এবং তারা সেখানে (আত্মসমর্পণের পর পুনর্বাসিতরা) জীবন-জীবিকা করেও খাচ্ছে। তারা যেন এই ভুল পথে আর না ফেরে সে জন্য সবরকমের সাহায্য এবং জীবন-জীবিকার সুযোগ আমাদের করে দিতে হবে। জঙ্গিবাদকে একটি বৈশ্বিক সমস্যা আখ্যায়িত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জঙ্গিবাদ শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের অনেক দেশে একটি নতুন উপদ্রব হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। আমরা জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ নির্মূলে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করেছি। তিনি বলেন, নিরীহ কোমলমতি যুবকদের প্রলোভন দেখিয়ে বা ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে জঙ্গিবাদের দিকে আকৃষ্ট করা হচ্ছে। এজন্য দমন কার্যক্রমের পাশাপাশি জনসচেতনতা তৈরিতে আমাদের মনযোগ দিতে হবে। র‌্যাব সম্প্রতি কতিপয় বিষয়ে জঙ্গিবাদীদের অপব্যাখ্যা এবং পবিত্র কোরআনের সংশ্লিষ্ট আয়াত ও হাদীসের সঠিক ব্যাখ্যা শীর্ষক একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেছে উল্লেখ করে এই উদ্যোগের প্রশংসা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটি একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এ পুস্তক ব্যাপক প্রচারের উদ্যোগ নিন। সরকার প্রধান বলেন, তিনি নিজেও ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দেশের সকল জেলার সাধারণ মানুষ, ইমাম, স্কুল শিক্ষক, মুক্তিযোদ্ধাসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলেছেন। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা তৈরির আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন,  আমরা যে যেখানে আছি সেখান থেকেই জঙ্গিবাদের মোকাবেলা করতে হবে। তা না হলে আমাদের সব অর্জন বিনষ্ট হয়ে যাবে। পাশাপাশি তিনি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়াতে এবং প্রতিকার নয়, প্রতিরোধের দিকেই বেশি নজর দেয়ার আহবান জানান।