Site icon রেডিও মহানন্দা ৯৮.৮ এফএম

রোনালদো ছিলেন অসহায়

ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। নামটি যুক্তরাষ্ট্রের ৪০তম প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের নাম থেকে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রেসিডেন্টের মতো রাজকীয় জীবন ছিল না রোনালদোর। বরং রাজকীয় জীবনের উলটো বাস্তবতায় বেড়ে উঠেছিলেন এখনকার ফুটবল মহাতারকা। যেখানে মাথা গোঁজার মতো ঠাঁই পেতে হিমশিম খেতে হয়েছে তার পরিবারকে। বাবা হোসে দিনিস অ্যাভেইরো দেশের জন্য যুদ্ধ করেও ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে পারেননি। ভরণপোষণের জন্য মা মারিয়া দোলোরেস পরিচ্ছনতাকর্মী হিসেবে কাজ করেছেন। তবে সেসব প্রতিকূলতা রোনালদোকে আটকে রাখতে পারেনি।

পরিবার থেকে যুদ্ধটা শুরু : মোজাম্বিক ও অ্যাঙ্গোলার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শেষে রোনালদোর বাবা যখন নিজের ঘরে ফেরেন, তখন সেখানে আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না, ছিল না কোনো উপার্জন। যোদ্ধা অ্যাভেইরো হতাশার সাগরে ডুবে যান। ভেঙে পড়েন মানসিকভাবে। পরিবার চালানোর জন্য স্থানীয় একটি ফুটবল ক্লাবে খেলোয়াড়দের ব্যাগ বহনের দায়িত্ব নেন এবং একটি বাগানের দেখাশুনা শুরু করেন। কিন্তু মানসিক অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় জড়িয়ে পড়েন মাদকের করাল গ্রাসে। শিশু রোনালদো বাবার অবস্থা দেখে খুবই অসহায় হয়ে পড়েছিলেন। কখনো তিনি বাবার ঘনিষ্ঠ হতে পারেননি। নিজের হৃদয়ের কথা বাবাকে বলতে পারেননি। রোনালদো শপথ নেন, আর যাইহোক জীবনে কখনো মাদক হাতে নেবেন না। এ দিকে নিজের এমন ভঙ্গুর অবস্থায়ও রোনালদোকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন বাবা অ্যাভেইরো। তিনি যখন খেলোয়াড়দের ব্যাগ বহন করতেন তখন বন্ধুদের বলতেন, আমার ছেলে একদিন ফুটবলের মহাতারকা হবে। বাস্তবে সেটিই হয়েছে। বিশ্ব ফুটবলে মহাতারকা হিসেবে নিজের জাত চিনিয়েছেন রোনালদো। ২০০৫ সালে তার বাবা মারা যায় লিভারের সমস্যায়। সে সময়ে পরিবার চালানোর জন্য রান্না ও পরিচ্ছন্নতার কাজ শুরু করেন রোনালদোর মা। মাঝেমধ্যে সন্তানরাও সে কাজে সহায়তা করতেন। এমনই অবস্থার মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছেন রোনালদো।

স্কুল জীবনের ইতি ও সুপ্ত আগ্নেয়গিরি আবিষ্কার : ছোটবেলায় ছিঁচকাঁদুনে ছিলেন রোনালদো। কথায় কথায় কান্না করতেন। স্কুলের পড়াশুনা তার ভালো লাগত না। একদিন শ্রেণিকক্ষের মধ্যে শিক্ষকের সামনে একটি চেয়ার ফেলে বলেন, শিক্ষক তার প্রতি সম্মান দেখায় না। এই ঘটনায় তাকে বহিষ্কার করা হয়। স্কুল জীবনের ইতি ঘটে সেখানেই। এরপরে ফুটবলে নিজেকে সঁপে দেন। মা এবং তিন ভাইবোন থেকে সমর্থনও পেয়েছিলেন সেদিনের সেই বিস্ময়বালক। আট বছর বয়সে স্থানীয় একটি ফুটবল অ্যাকাডেমিতে নাম লিখিয়েছিলেন তিনি। সেখান থেকে ১২ বছরের সময়ে পরিবার ছেড়ে স্পোর্টিং লিসবনের যুব অ্যাকাডেমিতে যোগ দেন। এখানে আসার পেছনে বন্ধু আলবার্ট ফানত্রাওর ভূমিকা সকলেরই জানা। ক্লাবটির পক্ষ থেকে একটি খেলার আয়োজন করে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, যে এই খেলায় বেশি গোল করতে পারবে, তাকে ভর্তির সুযোগ দেওয়া হবে। সেই খেলায় একটি করে গোল করেন রোনালদো ও ফানত্রাও। এরপরে আরেকটি গোলের সুযোগ পান ফানত্রাও, কিন্তু নিজে গোল না করে বন্ধু রোনালদোকে দিয়ে গোলটি করান তিনি। তাতেই সুযোগ তৈরি হয় রনের জন্য। এক সাক্ষাত্কারে রোনালদো বলেছিলেন, ‘আমার সফলতার পেছনে আমার বন্ধুর অবদান কখনো ভুলব না।’

১৫ থেকে ১৮ : এই তিনটি বছর রোনালদোর জীবনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় বললে অত্যুক্তি করা হবে না। বয়স যখন ১৫, তখন তার হার্টে সমস্যা ধরা পড়ে। সিআরসেভেনের হৃদস্পন্দন ছিল স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি। ফুটবল নিয়ে তৈরি হয়েছিল শঙ্কা। তবে ডাক্তার রোগ বুঝে লেজার অপারেশনের মাধ্যমে সেটিকে ঠিক করে দেন। এরপরেই শুরু হয় ‘ছোট্ট মৌমাছি’র ম্যাজিক। তারুণ্যের কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য বলেছিলেন, ‘আঠারো বছর বয়স যে দুর্বার / পথে প্রান্তরে ছোটায় বহু তুফান।’ সেই তুফান দেখিয়েছেন রোনালদো। ২০০৩ সালে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড দিয়ে যাত্রা শুরু হয় তার। ২৩ বছর বয়সে হাতে তুলে নেন প্রথম ব্যালন ডি’অর। ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায় রিয়াল মাদ্রিদে গিয়ে। এরপরে আর পেছনে ফেরার গল্প নেই তার জীবনে। বর্তমানে ইউরোপীয় ক্লাবের পাঠ চুকিয়ে এশিয়ার ক্লাব আল নাসরে দাপট দেখিয়ে যাচ্ছেন। এখন পর্যন্ত ১ হাজার ২০০ ম্যাচ খেলে ৮৭৫টি গোল করেছেন তিনি। ৩৯ বছর বয়সে এসেও নাম লেখাচ্ছেন নিত্যনতুন রেকর্ডে। পাঁচ বারের ব্যালন ডি’অর জয়ী এই তারকার পুরস্কারের রয়েছে লম্বা তালিকা। বর্তমানে পর্তুগিজ তারকার যে সম্পদ রয়েছে, সেটি টাকার অঙ্কে ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি হবে। তাতে বাবার যে যুদ্ধ দেখে বড় হয়েছেন তিনি, সেই যুদ্ধের গল্প এখন কেবলই শব্দের গাঁথুনিতে সীমাবদ্ধ।

Exit mobile version