রাজাকার সাঈদীর আমৃত্যু কারাদন্ড বহাল

284

যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদ-ের যে রায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ দিয়েছিল, পুনর্বিবেচনায় তাতে কোনো পরিবর্তন আসেনি। আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদনে খালাস চেয়েছিলেন একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী দল জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সাঈদী। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদ-ের রায় পুনর্বহাল চেয়েছিল। রবি ও গতকাল সোমবার শুনানি করে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারকের বেঞ্চ দুটি রিভিউ আবেদনই খারিজ করে দিয়েছে। এর ফলে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর যুদ্ধাপরাধ মামলার সকল বিচারিক প্রক্রিয়ার পরিসমাপ্তি ঘটল এবং তার আমৃত্যু কারাদ-ের রায়ই বহাল থাকল। ৭৭ বছর বয়সী সাঈদী বর্তমানে আছেন গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে। ২০১০ সালের ২৯ জুন থেকে তিনি কারাবন্দি। রিভিউ রায়ের পর তার ছেলে মাসুদ-বিন- সাঈদী তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ন্যায়বিচার পেলাম না, ন্যায় বিচার হল না। ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছি, একদিনের সাজাও প্রাপ্য ছিলো না। আর এই জামায়াত নেতার প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, যেহেতু সর্বোচ্চ আদালতের রায়, তাই ক্ষোভ-দুঃখ যাই থাকুক না কেন, রায় মেনে নিতে হবে। অন্যদিকে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম তার প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে সাঈদীকে দেশ, সভ্যতা ও মানুষের জন্য ‘ক্ষতিকর’ ব্যক্তি হিসেবে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক অপারধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন এবং তদন্ত সংস্থার ব্যর্থতা ও দুর্বলতার কারণে সাঈদীকে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা যায়নি। সাঈদী যুদ্ধাপরাধীদের শিরোমনি, তার সর্বোচ্চ শাস্তি না হওয়ায় আমি ব্যক্তিগতভাবে ব্যথিত। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী দুটি (ইব্রাহিম কুট্টি ও বিশা বালি) হত্যার দায় এড়াতে পারেন না। এর আগে আপিল বিভাগের দেওয়া রায়ে বলা হয়েছিল, তাঁর নির্দেশে হত্যাকা- ঘটানো হয় এবং তিনি ছিলেন হুকুমের আসামি। মানবতাবিরোধী অপরাধে হত্যার দায়ে অন্য আসামিদের ফাঁসি হলেও হুকুমের আসামির ফাঁসি না হওয়ায় আমার মনে চিরদিনের মতো একটা ব্যথা থেকেই যাবে। কারণ, সাঈদীর মতো অপরাধীদের শিরোমণির ফাঁসি হলো না। যেসব যুদ্ধাপরাধী ছিলেন, তাঁদের মধ্যে সাঈদী ছিলেন অনেক ধুরন্ধর। তিনি মামলার তথ্য-ডকুমেন্ট সরিয়ে ফেলার ক্ষেত্রে পারদর্শী ছিলেন। রাষ্ট্রের প্রধান আইনজীবী আরও বলেন, আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এ রায় আমাদের মেনে নিতে হবে। রায় দেওয়ার পর পরই আদালত প্রাঙ্গণে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন গণমাধ্যমের কাছে প্রতিক্রিয়ায় বলেন, আপিল বিভাগে আমরা দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর মুক্তি চেয়ে আবেদন করেছিলাম। প্রমাণ-দলিলাদি দিয়ে বলেছিলাম, ঘটনার সময় তিনি পিরোজপুরে ছিলেন না। এবং এই রায়ে আপিল বিভাগের এক বিচারপতি তাঁকে খালাস দিয়েছিলেন। একাত্তরে নিহত পিরোজপুরের বিশা বালি হত্যার সাক্ষী সুখরঞ্জন বালি ভিডিও সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তাঁর ভাইকে হত্যায় দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী জড়িত ছিলেন না। এরপর তাঁকে তুলে নিয়ে ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এসব বিষয় আমরা আদালতে উপস্থাপন করেছি। আইনজীবী আরও বলেন, এ ছাড়া আরও একটি বিষয় আমরা আদালতে বলেছি। রাষ্ট্রপক্ষ যে রিভিউ করেছে, তা সঠিক হয়নি। তামাদি আইন অনুযায়ী, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রিভিউ আবেদন করতে পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ। ফলে তাদের রিভিউ বাতিলের আবেদন করেছিলাম। আপিল বিভাগ দুটি রিভিউ শুনেছেন। শুনানি শেষে তা খারিজ করে দিয়েছেন। এর ফলে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আমৃত্যু কারাদ- বহাল থাকল। এ সময় খন্দকার মাহবুব হোসেন আরও বলেন, আমি সুপ্রিম কোর্টের একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী। আমি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এ রায় আমাদের মেনে নিতে হবে। খন্দকার মাহবুব হোসেনকে রায়ের ব্যাপারে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদ-প্রাপ্ত কারো আপিল বিভাগে এসে সাজা কমেনি। দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সাজা কমেছে। তাঁকে মৃত্যুদ-ের হাত থেকে বাঁচাতে পেরেছি, এতেই খুশি। আপিল বিভাগের এ রায়ে ‘সন্তুষ্ট’ হতে পারেননি সাঈদীর পরিবারের সদস্যরা। তাঁরা মনে করেছেন, ন্যায়বিচার পাননি। রায় দেওয়ার পর পরই আদালত প্রাঙ্গণে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছেলে পিরোজপুরের জিয়ানগর উপজেলার চেয়ারম্যান মাসুদ বিন সাঈদী গণমাধ্যমের কাছে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। মাসুদ বিন সাঈদী বলেন, আপিল বিভাগের রায়ে আমরা সন্তুষ্ট হতে পারিনি। আমরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছি। আমরা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মুক্তির জন্য যেসব প্রমাণ-দলিল দাখিল করেছি, তাতে তাঁর একদিনের দ-ও হওয়ার কথা নয়। তারপরও সর্বোচ্চ আদালতের রায় আমাদের মানতে হবে, শ্রদ্ধা দেখাতে হবে। সাঈদীর ছেলে আরও জানান, চার দিন আগে তিনি গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে তাঁর বাবার সঙ্গে দেখা করেছেন। তিনি সুস্থ আছেন, স্বাভাবিক আছেন। তিনি দেশবাসীকে সালাম জানিয়েছেন। তিনিও তাঁর মুক্তি আশা করেছিলেন। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রথম অভিযুক্ত ব্যক্তি হিসাবে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সাঈদীর বিচার শুরু হয়েছিল ২০১১ সালের ৩ অক্টোবর। মানবতাবিরোধী অপরাধের কারণে একাত্তরে জামায়াত নেতা সাঈদীকে পিরোজপুরের মানুষ চিনত ‘দেইল্লা রাজাকার’ নামে। সে সময় রাজাকার বাহিনীর সদস্য হিসেবে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যেসব মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় তিনি অংশ নিয়েছিলেন, তা উঠে এসেছে এ মামলার বিচারে। বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, নির্যাতন ও ধর্মান্তরে বাধ্য করার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সাঈদীর মৃত্যুদ-ের রায় দেয়। ওই রায়ের পর দেশজুড়ে সহিংসতা চালায় জামায়াত ও ইসলামি ছাত্রশিবিরের কর্মীরা। ওই তা-বে প্রথম তিন দিনেই নিহত হন অন্তত ৭০ জন। এ ছাড়া বহু গাড়ি-দোকানপাট ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, হিন্দুদের মন্দির-ঘরবাড়ি ভাংচুর করা হয়। এরপর সাঈদী আপিল করলে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে পাঁচ বিচারকের আপিল বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে রায় দেয়। তাতে সাজা কমে আমৃত্যু কারাদ-ের আদেশ আসে। একাত্তরের ‘দেইল্যা রাজাকারের’ সাজা কমানোর রায়ে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল ও গণজাগরণ মঞ্চসহ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার বিভিন্ন সংগঠন বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।শাহবাগে সে সময় শ্লোগান ওঠে – ‘আঁতাতের এই রায় মানি না, প্রহসনের এই রায় মানি না’। আপিল বিভাগের রায়ে ‘ধর্মীয় নেতা’র লেবাসধারী সাঈদীর মুখোশ উন্মোচিত হলেও সাজায় প্রত্যাশিত হয়নি জানিয়ে রাষ্ট্রপক্ষ রিভিউ চাওয়ার কথা জানিয়েছিল সে সময়। আপিলের রায়ের ১৫ মাস পর ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর সর্বোচ্চ আদালত এর পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করলে বিষয়টি রিভিউয়ের পর্যায়ে আসে। এরপর গতবছর ১২ জানুয়ারি সাঈদীর আমৃত্যু কারাদ-ের রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। এর পাঁচদিনের মাথায় খালাস চেয়ে রিভিউ আবেদন করেন সাঈদী। দুটি আবেদনই খারিজ হয়ে যাওয়ায় এই যুদ্ধাপরাধীর আমৃত্যু কারাদ-ের সাজাই বহাল থাকল।
আপিলের রায়ে ১০, ১৬ ও ১৯ নম্বর অভিযোগে হত্যা, নিপীড়ন, অপহরণ, নির্যাতন, ধর্ষণ ও ধর্মান্তরে বাধ্য করায় সাঈদীকে ‘যাবজ্জীবন’ কারাদ- দেয়া হয়। যাবজ্জীবন বলতে ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর সময় পর্যন্ত’ কারাবাস বোঝাবে বলে ব্যাখ্যা দেয় আদালত। এছাড়া ৮ নম্বর অভিযোগের একাংশের জন্য সাঈদীকে ১২ বছরের সশ্রম কারাদ- এবং ৭ নম্বর অভিযোগে ১০ বছর কারাদ-ের আদেশ দেয় আপিল বিভাগ। এর মধ্যে ৮ ও ১০ নম্বর অভিযোগে ইব্রাহিম কুট্টি ও বিসাবালীকে হত্যা এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি ঘরে আগুন দেওয়ার ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সাঈদীর ফাঁসির রায় দিয়েছিল। তবে চূড়ান্ত বিচারে তা টেকেনি।
অভিযোগ-১০: ১৯৭১ সালের ২ জুন সকাল ১০টার দিকে সাঈদীর নেতৃত্বে তার সশস্ত্র সহযোগীরা ইন্দুরকানি থানার উমেদপুর গ্রামের হিন্দুপাড়ার হানা দিয়ে ২৫টি ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। যার মধ্যে রয়েছে চিত্তরঞ্জন তালুকদার, হরেণ ঠাকুর, অনিল ম-ল, বিসাবালি, সুকাবালি, সতিশবালার ঘর। সাঈদীর ইন্ধনে তার সহযোগীরা বিসাবালীকে নারকেল গাছের সঙ্গে বেঁধে গুলি করে হত্যা করে।
অভিযোগ-১৬: স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে সাঈদীর নেতৃত্বে ১০-১২ জন সশস্ত্র রাজাকার পারেরহাট বন্দরের গৌরাঙ্গ সাহার বাড়ি থেকে তার তিন বোনকে অপহরণ করে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে তুলে দেয়। সেখানে তাদের আটকে রেখে তিন দিন ধরে ধর্ষণ করে পরে ছেড়ে দেয়া হয়।
অভিযোগ-১৯: স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে সাঈদী জোর করে মধুসুদন ঘরামী, কৃষ্ট সাহা, ডা. গণেশ সাহা, অজিত কুমার শীল, বিপদ সাহা, নারায়ণ সাহা, গৌরাঙ্গ পাল, সুনীল পাল, নারায়ণ পাল, অমূল্য হাওলাদার, শান্তি রায়, হরি রায় জুরান, ফকির দাস, টোনা দাস, গৌরাঙ্গ সাহা, হরিদাস, গৌরাঙ্গ সাহার মা ও তিন বোন মহামায়া, অন্যরাণী ও কামাল রাণীসহ ১০০/১৫০ জন হিন্দুকে ধর্মান্তরিত করেন।