রহনপুরে পূণর্ভবার তীরে গ্রাম বাংলার পিঠা-পুলি উৎসব ও পোষালু
গোমস্তাপুর উপজেলার রহনপুর পৌর এলাকায় পূণর্ভবা নদী তীরের বাবুরঘোন গ্রামে প্রতিবছরের ন্যয় এবছরও হয়ে গেল গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী পিঠা-পুলি উৎসব এবং গ্রামীন পিকনিক ’পোষালু’। আয়োজন ও উপস্থাপনের স্বকীয়তার কারণে ১৭ বছর আগে ২০০৮ সালে একদম ঘরোয়া আবহে শুরু হওয়া আয়োজনটি জনপ্রিয় ও সমাদৃত হয়েছে। দূর-দূরান্তের অতিথিরা দেশীয় সংস্কৃতির শেকড়ের টানে এখন অপেক্ষা করে থাকেন শীতের মৌসুমের এই দিনটির জন্য। অনেকেই আবার একে বলেন নবান্ন উৎসব।
আজ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানে মাতোয়ারা ছিল মূল আয়োজক উত্তর রহনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মমতাজ বেগমের বড় গলি ঘেরা ও বিশাল আঙ্গিণার বাড়িটি। আয়োজনের মধ্যে ছিল নতুন ধানের ঢেঁকিছাটা ও যাঁতায় পেষা চালের তৈরি বিভিন্ন পিঠা তৈরী ও খাওয়া, দুপুরে আলু-ডিমের ঘন্ট দিয়ে তরকারি ও নানা পদের শীতের শাকের সাথে ভাপ ওঠা অগ্রাহায়ণ মাসে ওঠা চালের ভাত দিয়ে পোষালু। দুপুরের এই খাবার ভারী মজার বলেই সকলের আগ্রহের কেন্দ্র শুধু পিঠা নয় এটিও। আর আগ্রহ দিনব্যাপী বিভিন্ন বয়সী নারী এবং কিশোরীদের হারিয়ে যেতে বসা গ্রামীন গীত। সঙ্গে রয়েছে বিলুপ্তপ্রায় গ্রামীন খেলাধুলো। দিনব্যাপী শিশুদের আনন্দ-হুল্লোড় তো পুরো গ্রামেই ছড়িয়ে পড়েছে। অংশগ্রহণকারীদের পোষাকেও রয়েছে উৎসব। হলুদ পেড়ে লাল শাড়ি পরে উঠোনের চারদিকে কুয়াশা ঘেরা ভোর থেকেই বসে গেছেন নারী ও কিশোরীরা।
তবে দিনের শুরু কাকডাকা ভোরে। কিশোরীরা সারিবদ্ধভাবে কলসিতে নদী থেকে পানি আনার মধ্যে দিয়ে কাজ শুরু হয়। এরপর ছাঁটা হয় চাল। পিষা হয় যঁতায়। এরপর আঙ্গিনার মাঝখানে বড় হাঁড়িতে পানি সিদ্ধ করে ভাপ উঠলে সেই ভাপ দিয়ে তৈরী তে শুরু করে ভাপা,কুলি ,তিল,তেল সহ বিভিন্ন রকমের পিঠা। গরম গরম পরিবেশনও করা হয় শীতের সকালে। সকল কাজই হয় আনন্দের সাথে গীত গাইতে গাইতে দলবদ্ধভাবে। সেই মাথে চলে একক ও দলীয় নৃত্য, একক ও দলীয় গান, ছড়া ও কবিতা আবৃত্তি, অভিনয় ইত্যাদি বিনোদনমূলক পরিবেশনা যার সবই বাঙ্গালীর গ্রামীন সংস্কৃতির অংশ।
মূল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও খেলাধুলো হয় বাড়ির আঙ্গিনা ও পাশের বড় গলিতে দুপুরের পোষালু খাবার পর পড়ণÍ বিকেলে। অতিথিদের সমাদর করে খাওয়ানো হয়। গণ্যমান্য ব্যাক্তিদের বাড়ি বাড়িতে পৌঁছে দেয়া হয় পিঠা। দিন ব্যাপী পুরো গ্রামেই বিরাজ করে উৎসবের আমেজ।বিকেলে বৌ-ঝি’রা অংশ নেন বালিশ খেলা, চামচ খেলা, হাড়ি খেলা,এক্কা দোক্কা,কিত কিত খেলা, কলসি দৌড় ইত্যাদি খেলায়। সন্ধ্যায় শেষ হয় এই আয়োজন। আয়োজনের খরচ যোগায় গ্রামের বিদ্যলয়ের শিক্ষার্থীরা এবং গৃহীনিরা। শধু টাকা দিয়ে নয়। বরং বাড়ি বাড়ি থেকে ধান,চাল, আলু, মসলা, ডিম,তেল সংগ্রহ করা হয় উৎসবের আগেই।
মমতাজ বেগম বলেন, দাদী-নানীর কাছে শোণা নবান্ন উৎসবের গল্প থেকে তিনি প্রথ অনুপ্রেরণা পান। পুরোনো যুগে ধান ওঠার পর গৃহস্থরা দাওয়াত করে কৃষক-কৃষাণী,আত্মীয় আর অতিথিদের খাওয়াতেন বলে। এসব গল্প শুনে, গ্রামীন সংস্কৃতির টানে আর হারিয়ে যেতে বসা বিভিন্ন ঐতিহ্য ধরে রাখতে নিজের বাড়িতেই উৎসব শুরু করেন। শুরুর দিনগুলো সহজ ছিল না। শিশু ও নারীদের নিয়ে কাজ করতে তিনি ভালবাসেন। অনেক পরিশ্রম করতে হয়। বিদেশী সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের যুগে আমাদেও নিজেদের ঐতিহ্য ও অথীতকে তো হারিয়ে যেতে দেয়া যাবে না। সকলকেই এসব রক্ষায় কাজ করতে হবে। চিন্তা করতে হবে। তিনি আরও বলেন, আমার প্রধান শক্তি আমার পরিবার। বোন জেলার ভোলাহাট উপজেলার খানেআলমপুর মাদ্রাসার ইসলামী স্টাডিজের প্রভাষক শামীমা বেগম ও ভাই আল মামুন আমার পাশে থাকেন সবসময়। পারিবারিক আয়োজনেই ১৭ বছর ধরে এই উসব চলছে জানিয়ে মমতাজ বলেন, দেশীয় সংস্কৃতির বিভিন্ন দিন সহ বিভিন্ন জাতীয় দিবস তাঁরা পারিবারিক আয়োজনেই গ্রামবাসী ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে পালন করেন। অনুষ্ঠানে অংশ নিতে যাওয়া জেলার প্রবীণ সাংবাদিক সামসুল ইসলাম টুকু ও হরিমোহন সরকারি উচ্চ-বিদ্যালয়ের শিক্ষক আজমাল মামুন বলেন, এম আয়োজন বিরল। যে কেউ দেখলে আবেগাপ্লুত হয়ে পুরোনো যুগে ফিরে যাবেন।