যে দ্বীপে শুধু খরগোশের বসবাস!

47

খরগোশময় দ্বীপ। যতদূর চোখ যায়, শুধু খরগোশ আর খরগোশ। যদি কখনও ভুলেও সেখানে চলে যান, তাহলে অনায়াসে আপনি এসব খরগোশের মাঝে হারিয়ে যেতে পারেন। হিরোশিমা থেকে মাত্র অর্ধশত কিলোমিটার দূরে এই ওকুনোশিমা দ্বীপের অবস্থান। স্থানীয় ভাষায় একে বলা হয় ‘উসাগি শিমা’। বাংলায় যাকে বলে- ‘খরগোশের দ্বীপ’। রাশিয়া-জাপান যুদ্ধের আগ পর্যন্ত ওকুনোশিমা দ্বীপটি ছিল একটি কৃষিভূমি। যুদ্ধকালীন নিরাপত্তা বাড়াতে দ্বীপটিতে ১০টি দুর্গ নির্মাণ করে জাপান। সেই থেকেই দ্বীপটি সামরিক কাজে ব্যবহৃত হতে থাকে।

দ্বীপটির ইতিহাস: উনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে রাসায়নিক অস্ত্র পরীক্ষায় ব্যবহৃত হতো দ্বীপটি। ১৯২৯ সালে এখানে একটি গ্যাস কারখানা তৈরি হয়। তাতে বিষাক্ত রাসায়নিক গ্যাস তৈরি হতো। এই গ্যাস যুদ্ধক্ষেত্রে জাপানের সামরিক বাহিনী ব্যবহার করতো। চীন-জাপান যুদ্ধে এসব গ্যাস ব্যবহৃত হয়। এমনকি বেসামরিক লোকদের বিরুদ্ধেও ব্যবহৃত হতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কারখানাটি বন্ধ হয়ে যায়। তখন সব রাসায়নিক পুড়িয়ে ফেলা হয়। এমনকি দ্বীপটি জাপানের মানচিত্র থেকে মুছে ফেলার চেষ্টাও হয়েছিল। জনসাধারণের আনাগোনাও নিষিদ্ধ হয়েছিল এই দ্বীপে। কারণ দ্বীপটির বাতাসে ভেসে বেড়াত বিষাক্ত গ্যাস। অনেক দিন পর দ্বীপটি মানুষের বসবাসের উপযোগী কিনা, সেটি পরীক্ষা করতে সেখানে কিছু খরগোশ ছেড়ে দেওয়া হয়। যদিও অনেকে মনে করেন, ১৯৭১ সালে বেশ কিছু শিক্ষার্থী ওকুনোশিমায় বেড়াতে এসেছিলেন। তারা আটটি খরগোশ ছেড়ে দেন সেখানে। তারপর খরগোশের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এক সময় সেটি খরগোশের দ্বীপ হয়ে ওঠে। চারদিকে শুধু খরগোশ আর খরগোশ। বর্তমানে ওকুনোশিমা দ্বীপে হাজারো খরগোশ রয়েছে। এসব খরগোশ বেশ বন্ধুবৎসল। মানুষ দেখলেই ছুটে আসে। খরগোশের এই দ্বীপ এখন হয়ে উঠেছে পর্যটন কেন্দ্র। পর্যটকরা এখানে শুধুই খরগোশ দেখতে আসে। বিশ্বব্যাপী অনেকেই খরগোশকে খাওয়াতে ভালোবাসেন। খরগোশের জন্য আলাদা খাবারও পাওয়া যায়। পর্যটকরা প্যাকেটে করে খরগোশের জন্য গাজর, বাঁধাকপি প্রভৃতি নিয়ে যান। প্যাকেট ভরা খাবারের টানে খরগোশগুলোও ছুটে যায় পর্যটকদের দিকে।

সম্প্রতি ওকুনোশিমা দ্বীপে পর্যটকদের কুকুর-বিড়াল নিয়ে প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে জাপান সরকার। তবে অন্যান্য পোষা প্রাণী সঙ্গে করে নিয়ে যেতে কোনো অসুবিধা নেই। হিরোশিমা থেকে ওকুনোশিমায় ফেরিতে যাওয়া সম্ভব। মাত্র ১৫ মিনিটে পর্যটকরা সেখানে পৌঁছাতে পারবেন। খরগোশের পাশাপাশি দ্বীপটিতে পর্যটকদের রয়েছে সূর্যাস্ত উপভোগের জন্য দুর্দান্ত জায়গা।

এই দ্বীপের খরগোশের সুরক্ষায় কাজ করছে জাপানের বন্যপ্রাণী অধিদপ্তর। তারা বলছে, খরগোশ ভেজা চামড়া বা নষ্ট সবজি খায় না। পাশাপাশি তাদের পেটে আলু হজম হয় না। আবার মানুষের বিভিন্ন খাবার বা স্ন্যাকস তাদের দেওয়া যাবে না। তাই তাদের জন্য নির্দিষ্ট খাবার নিতে হবে। কেউ যদি তার পোষা খরগোশকে এখানে এনে ছেড়ে দেন, তবে তা সুখকর হবে না। বন্য খরগোশের সঙ্গে পোষা খরগোশের মিশতে অসুবিধা হবে। বন্য খরগোশের আক্রমণের শিকার হওয়ার আশঙ্কা একদম উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সমুদ্র পরিবেষ্টন করে রাখা এই ওকুনোশিমা দ্বীপ হিরোশিমা প্রিফেকচারের তাকেহারা শহর থেকে ২ মাইল দূরে অবস্থিত। দ্বীপটির আয়তন ৪ দশমিক ৩ বর্গ কিলোমিটার।

১৯৮৮ সালে জাপান সরকার ওকুনোশিমায় বিষাক্ত গ্যাস জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করে। উদ্দেশ্য ছিল- বিষাক্ত গ্যাস সম্পর্কে সচেতনতা, যুদ্ধের ভয়াবহতার কথা জানানো। আজও রয়েছে রাসায়নিক প্ল্যান্টের ধ্বংসাবশেষ। জনশ্রুতি আছে, রাসায়নিক কারখানায় খরগোশদের ওপরেও গ্যাস পরীক্ষা করা হতো। তবে সেসব খরগোশের সঙ্গে এখনকার খরগোশের কোনো সম্পর্ক নেই। সেখানকার প্রাচীন দুর্গগুলো এখনও রয়েছে। একটা সময় গ্যাস কারখানা প্রতিষ্ঠার আগে দ্বীপটিতে চাষাবাদ হতো, জনসমাগম ছিল। দ্বীপটিতে এক সময় একাধিক পরিবার বসবাস করতো। এক সময় সেখানে মানব ধ্বংসের কারখানা চালু হয়েছিল। এরপর তা ধ্বংস হয়ে বর্তমান ‘খরগোশের দ্বীপে’ পরিণত হয়ে ওঠে।