মোবাইল যখন সম্পর্ক নষ্টের কারণ – ফাবিং

52

আপনি অনেক দিন পুরোনো এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে এসেছেন। কিন্তু দেখা করতে এসে দেখেন, আপনার সাথে কথা বলা বাদ দিয়ে, সে মোবাইল স্ক্রল করতেই ব্যস্ত। আপনার দিকে একবার ভালোমতো তাকাচ্ছেও না, আপনার ওই সময় কেমন লাগবে? মনে হবেনা, যে দেখা করেই হয়তো ভুল করলেন? এমনটা মনে হতেই পারে, কারণ এই ধরণের আচরণ বিপরীত মানুষেকে মানসিকভাবে আঘাত করে। এতে সম্পর্ক নষ্ট হয়, এবং নিজের প্রতি একধরণের হীনমন্যতাও সৃষ্টি হয়।

এই যে ব্যাপারটি, অর্থাৎ কারো উপস্থিতিতে মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়া, এটির কিন্তু একটি নির্দিষ্ট নামও রয়েছে। একে বলা হয় ‘ফাবিং’ (Phubbing). ইংরেজি শব্দ Phone (ফোন) ও Snubbing (অবজ্ঞাপূর্ণ আচরণ) মিলে তৈরি হয়েছে ফাবিং শব্দটি। সুতরাং, ফোনের প্রতি মনোযোগ দিতে গিয়ে যখন আমরা সামনে থাকা রক্ত-মাংসের মানুষটিকে অবজ্ঞা করি, তখন সেটিকে বলা হয় ফাবিং। এক্ষেত্রে মনে হতেই পারে যে, ফাবিং খুব ভয়াবহ কোনো অপরাধ না। ভয়াবহ না হলেও, এর ফলাফল সামাজিক অবক্ষয়ের একটা কারণ হতে পারে। দুটি মানুষের মধ্যে যখন একজন অন্যজনের মনোযোগ চায়,তখন তৃতীয়পক্ষ হিসেবে মোবাইল ফোনের টুংটাং বিরক্তির কারণও হয়ে উঠতে পারে। ফাবিং এর ফলে নষ্ট হতে পারে সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতাও। আপনার বন্ধু, প্রেমিক/প্রেমিকা বা স্বামী/স্ত্রী, যদি আপনার কথা না শোনে, তাহলে আপনি না চাইলেও, বিপরীত মানুষটির প্রতি আপনার এক ধরণের অভিমান তৈরি হবে। আস্তে আস্তে সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা নষ্ট হবে। আপনি যখন আপনার সামনের বন্ধুটিকে বাদ দিয়ে ভার্চুয়াল জগতের বন্ধুটিকে মেসেজ পাঠাচ্ছেন, তার মানেটা কী দাঁড়াচ্ছে? তার মানে দাঁড়াচ্ছে এই যে, সামনাসামনি থাকা বন্ধুটির চেয়ে ভার্চুয়াল জগতের বন্ধুটিই আপনার কাছে বেশি মূল্যবান। আর বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে সবসময়ই একটা মান-অভিমান, মানসিক টানাপোড়েনের জায়গা থাকে। কেউই মানতে পারে না যে সে যাকে বন্ধু করে, সেই বন্ধুটি তাকে বন্ধু ভাবে না, কিংবা ভাবলেও অন্য আরেকজন বন্ধুর চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। এরকমটা যখন আপনার সামনে থাকা বন্ধুটিও ভাববে, তখন থেকেই আপনাদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হতে থাকবে।

একটি সম্পর্কে খুব ছোট ছোট মুহূর্তও অনেক বেশি মূল্যবান। হয়তো প্রেমিক-প্রেমিকা বা স্বামী-স্ত্রী কিছু বলছেন না, চুপ করে বসে আছেন। কিন্তু ওই নীরবতার সময়টুকুও আপনাদের একান্ত নিজস্ব। ওই সময়ে যদি তৃতীয় পুরুষ (কিংবা নারী) হিসেবে মোবাইলের অনাহূত আবির্ভাব ঘটে, তবে তার ফলাফল হতে পারে ভয়াবহ। অবজ্ঞাসূচক ব্যবহার নারীরা খেয়াল করে বেশি। বিশেষত নারীরা এই বিষয়গুলোতে বেশি প্রভাবিত হয়। একজন নারী হয়তো রাতের বেলা শুয়ে শুয়ে তার স্বামীকে সারাদিন কী কী হয়েছে তা বলছে। সে তখন চাইবে তার স্বামী পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে তার কথাই শুনুক। কিন্তু তার স্বামী যদি ভাবে, “এক কান দিয়ে তো শুনছিই সব কথা, সেই সাথে একটু মোবাইলও চাপি না!” তাহলেই কিন্তু লঙ্কাকাণ্ড ঘটে যেতে পারে। কিংবা তেমন কিছু না হলেও, ওই নারীর মনে একটা খারাপ লাগা কিন্তু থাকবেই, যা ঠিক ওই মুহূর্তে প্রকাশিত না হলেও, অন্য কোনো সময় ঠিকই বের হয়ে আসবে। ফলে তাদের সম্পর্কে বড় ধরনের ধাক্কা লাগবে।

শীতের আগমনে সুস্থতা ও চনমনেশীতের আগমনে সুস্থতা ও চনমনে তাছাড়া অবজ্ঞা কিংবা পূর্ণ মনোযোগ না পাওয়া থেকে এসব খারাপ লাগা কিন্তু কেবল নারীদের মনেই জন্মায় না, পুরুষদের মনেও জন্মায়। হয়তো একজন পুরুষ স্বাভাবিকভাবে খুব বেশি স্পর্শকাতর নয়। কিন্তু বারবার যখন তার সাথে এমনটা হতে থাকবে, তখন সে-ও একদিন ঠিকই প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে ফেলবে। আর সেই প্রতিক্রিয়ার সূত্র ধরে তাদের সম্পর্ক প্রায় খাদের কিনারায় চলে আসলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

মুক্তির উপায় কী?

ফাবিং যেহেতু একজন ব্যক্তি করে, কিন্তু এর প্রভাব পড়ে তার সঙ্গীর উপর, তাই তার সঙ্গীও এক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারে। কেউ যদি তার সঙ্গীর মাত্রাতিরিক্ত ফাবিংয়ে অতিষ্ঠ হয়ে যায়, তাহলে সে নিজেই তার সঙ্গীকে বলতে পারে, “দেখো, বারবার তোমার মোবাইল চেক করা উচিৎ না।” অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই এক কথাতেই কাজ হবে। তা-ও যদি সেই সঙ্গী একই ভুল করে, তাহলে তাকে ফের মনে করিয়ে দিতে হবে। এভাবে টানা কয়েকদিন মনে করিয়ে দিতে থাকলে সমস্যাটি অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। কিন্তু টানা কয়েকদিনেও যদি সমস্যার সমাধান না হয়, তাহলে আরো কঠোর কোনো পদক্ষেপ নিতে হবে। দুজনকে সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা যখন একে অন্যের সান্নিধ্যে থাকবে তখন খুব প্রয়োজন ছাড়া কোনো অবস্থাতেই মোবাইল হাতে নেয়া যাবে না। এরকম কড়াকড়ির মাধ্যমেও মোবাইলের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার কমিয়ে আনা যেতে পারে। যদি উপরের তিন প্রচেষ্টাতেও কোনো সুফল পাওয়া না যায়, তাহলে বুঝতে হবে ফাবিং করতে থাকা ব্যক্তিটি কোনো মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত। আর এই মানসিক সমস্যাকে কোনোক্রমেই হালকাভাবে নেয়া যাবে না। সমস্যাটির গভীরতা উপলব্ধি করতে হবে, এবং তাকে কোনো মনোচিকিৎসকের কাছে নিয়ে গিয়ে তার কাউন্সেলিং করাতে হবে।