মেঘ ছুঁতে বান্দরবানের কেওক্রাডং

331

দুর্গম পথে ঘাম ঝরানো ট্যুর হিসেবে বান্দরবানের কেওক্রাডং জনপ্রিয় গন্তব্য। দেশের তৃতীয়তম উঁচু পাহাড় এটি। পাহাড় জয়ের রোমাঞ্চকর অভিযানের উদ্দেশ্যে এক রাতে তিন বন্ধু রওনা হলাম। ভোরে গিয়ে নামলাম বান্দরবান শহরে। শহরের তখনও ঘুম ভাঙেনি। পথে গাড়িঘোড়া নেই বললেই চলে। থেমে থেমে অটোরিকশা চলছে। আমরা একটাতে উঠে বসলাম রুমা বাসস্ট্যান্ড যাব বলে। রুমা বাসস্ট্যান্ড থেকে সকাল ৮টায় বাস ছাড়ে রুমা বাজারের উদ্দেশ্যে। ৮টা মানে ৮টা। ৫ মিনিট পরে গেলে আর বাস পাবেন না। তখন ৯টা বাজার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এক ঘণ্টা পরপর বাস। প্রথম ট্রিপেই যাওয়া ভালো; অনেক সময় বাঁচবে। পথিমধ্যে সেনাবাহিনীর টহল দলের কাছে আপনার নাম এন্ট্রি করতে হবে। চাইলে তারা আপনাকে চেক করবে। মনে রাখতে হবে, আপনার নিরাপত্তার জন্যই এই ব্যবস্থা।  রুমা বাজার নেমেই আপনাকে গাইড ঠিক করতে হবে। কিছু ফর্ম ফিলাপ ও ফটোকপি করতে হবে। কাজগুলো গাইডই করে দিবে। গাইড ছাড়া আপনি যেতে পারবেন না।

রুমা বাজার থেকে জিপ বা মোটরসাইকেল বা লোকাল জিপে আপনাকে যেতে হবে বগালেক। এই পথেই কেওক্রাডং যেতে হয়। মানুষ বেশি থাকলে জিপ ভাড়া করাই ভালো। কম হলে মোটরসাইকেলে যেতে পারেন। অথবা লোকাল জিপ। সেক্ষেত্রে গাইডকে আগেই জানিয়ে রাখতে হবে। বগালেকে একদিন থেকে পরদিন সকালে যেতে হবে কেওক্রাডং। বলে রাখা ভালো, আপনি বগালেকে ওইদিন চাইলে নাও থাকতে পারেন। সেক্ষেত্রে রুমা বাসস্ট্যান্ড থেকে ৮টার বাস কোনোভাবেই মিস করা যাবে না। আমরা অবশ্য বগালেকে একদিন অবস্থান করেছি। কেননা সারা রাত-দিন জার্নি করে আবার ৩ ঘণ্টা ট্রেকিং একটু কষ্টকর হয়ে যায়। বগালেকে আপনি থাকলে অবশ্যই রবার্টদার হোটেলে খাবেন। দারুণ খাবার! কেওক্রাডং গিয়ে তার খাবার আপনাকে মিস করতে হবে। কেননা কেওক্রাডং-এ একটাই হোটেল। খাবার তেমন সুবিধার না। পরদিন ট্রেকিং-এর জন্য বের হতে হবে সকাল সকাল। রোদ বাড়লে কষ্টকর হয়ে যাবে ট্রেকিং। ভালো মানের জুতা নিয়ে যেতে হবে। ট্রেকিংয়ের জন্য ভালো কিছু জুতা পাওয়া যায় ফুটপাতেই। সাথে যথেষ্ট পরিমাণে পানি নিয়েছিলাম আমরা। পাশাপাশি স্যালাইন।

বলিউড অভিনেতা নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকীর একটা সিনেমা ছিল ‘মাউন্টেন ম্যান’। সেখানে সে তার স্ত্রীর জন্য বছরের পর বছর পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরি করে। কেননা এই রাস্তার জন্য তার স্ত্রীকে সে বাঁচাতে পারেনি। সিনেমাটি সত্য ঘটনার উপরে নির্মিত। দশরথ মাঝির চরিত্রে অভিনয় করেন নওয়াজ। ভাবছিলাম দশরথ মাঝি পাহাড় কাটতে পারলে সামান্য পাহাড়ে চড়তে পারব না কেন আমরা? সবাই সেই সিনেমার ডায়লগ বলতে বলতে ট্রেকিং করছিলাম। ‘জাব তাক তোরেঙ্গে নেহি, তব তাক ছোরেঙ্গে নেহি।’

পথেই পড়বে চিংড়ি ঝরনা। চাইলে গোসল করে নিতে পারেন, তবে বেশি সময় নষ্ট না করাই ভালো। দার্জিলিং পাড়ার কাছাকাছি এলেই কিছু পাহাড়ি আপনার জন্য লেবুর শরবত, পাকা পেঁপে, পাহাড়ি পেয়ারা নিয়ে অপেক্ষা করবে। এখানে মেঘ দেখার পাশাপাশি কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে পারবেন। দয়া করে এদের সাথে দামাদামি করবেন না। তাদের জীবন এমনিতেই খুব কষ্টের। সামনেই পড়বে দার্জিলিং পাড়া। খুবই পরিচ্ছন্ন একটি পাড়া। এখানে একদমই নোংরা করবেন না। অনুমতি ছাড়া ছবি তুলবেন না। এখানে আমরা কিছুক্ষণ জিরিয়ে, এরপর শেষ গন্তব্যের জন্য রওনা দিলাম। ৩০ থেকে ৪০ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে যাই কেওক্রাডং এর চূড়ায়। ৩২০০ ফুট উঁচুতে! নিজেকে কিছুক্ষণের জন্য বিশাল কিছু মনে হতে লাগল। যেন এভারেস্ট জয় করে ফেলেছি। মনে হচ্ছিল হাত বাড়ালেই মেঘ ছুঁয়ে যাবে। কেন জানি আমার মনে হলো মেঘের একটা শুভ্র ঘ্রাণ আছে। সবসময় আমি এই ঘ্রাণ পাই যেন। মনে হয় এই ঘ্রাণ ছুঁয়ে, মেঘ ছুঁয়ে যদি থাকতে পারতাম আজীবন! কিন্তু সে তো আর সম্ভব নয়, সুতরাং ফিরতেই হলো।

পাঠক এবার চলুন কিছু তথ্য আপনাকে জানিয়ে রাখি। যেমন- ঢাকা থেকে বান্দরবান বাসে ৬২০ টাকা (নন এসি)। বান্দরবান শহর থেকে রুমা বাসস্ট্যান্ড ১৫ টাকা অটোরিকশা ভাড়া। রুমা বাসস্ট্যান্ড থেকে রুমা বাজার ১১০ টাকা বাস ভাড়া। রুমা বাজারে ফর্ম ফিলাপ ও ফটোকপি ১৫০ টাকা। রুমা বাজার থেকে বগা লেক ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকা চাঁদের গাড়ি বা জিপ রিজার্ভ। ৩০০ টাকা বাইকে, এক বাইকে দুজন। ১০০ টাকা লোকাল জিপ, যাতে পাহাড়িরা যাতায়াত করে। আপনি চাইলে এই তিনটার যেকোনো একটাতে যেতে পারবেন। বগালেকে রাত্রিযাপন প্রতি জন ১৫০ টাকা। বগালেকে খাওয়া প্রতি জন ১২০ টাকা। কেওক্রাডং-এ রাত্রিযাপন প্রতি জন ৩০০ টাকা। কেওক্রাডং-এ খাওয়া প্রতি জন ১৩০ টাকা। কেওক্রাডং-এ গোসল করতে হলে বড় এক বালতি পানি ৫০ টাকা। গাইড ২৬০০ টাকা দুই রাত তিন দিনের জন্য। ৩২০০ টাকা তিন রাত চার দিন।

যে খরচগুলো উল্লেখ করেছি, এখানে দাম কষাকষির কোনো ব্যাপার নেই। এগুলো ফিক্সড। শুধুমাত্র জিপ ভাড়া করার ক্ষেত্রে কিছুটা দামাদামি করতে পারবেন। গাইড যদি ভালো হয় তাহলে অনেক সাশ্রয়ী খরচে ট্যুর দেয়া সম্ভব। তিনিই সব ম্যানেজ করবেন। পরিচিত গাইড থাকলে সেক্ষেত্রে দুদিন আগে থেকেই বলে রাখা ভালো। নাহলে সেখানে গিয়ে সিরিয়াল অনুযায়ী যে গাইড পড়বে তাকে নিয়েই আপনাকে যেতে হবে। সিরিয়ালের দায়িত্ব দেখভাল করেন সজীব দাশ। ওখানে মা ইলেকট্রনিক্স নামে তার একটি দোকান আছে।

সবচেয়ে জরুরি কথা জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি নিতে ভুলবেন না। না থাকলে স্টুডেন্ট, চাকরিস্থলের পরিচয়পত্র বা পাসপোর্ট কিংবা জন্মনিবন্ধনের ফটোকপি সঙ্গে রাখবেন। অন্যথায় আপনার নিরাপত্তা বিবেচনায় বগা লেক কিংবা কেওক্রাডং-এর দিকে পা বাড়ানের অনুমতি মিলবে না। অর্ধেক পথ থেকেই ফেরত আসতে হবে। পাহাড়িরা খুব পরিচ্ছন্ন। সেখানে গিয়ে আমাদের উচিত নোংরা না করা। চিংড়ি ঝরনায় অনেক ময়লা দেখতে পেয়েছি। সিগারেট, চিপসের প্যাকেট এগুলো যেখান সেখানে ফেলবেন না। পথে বাস্কেট দেয়া আছে। সেগুলো ব্যবহার করবেন।