ভারতের ব্যান্ডউইথ ট্রানজিট বাতিল করলো বাংলাদেশ

বাংলাদেশকে ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে ব্যান্ডউইথ সরবরাহের প্রস্তাব বাতিল করেছে ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি)।

ট্রানজিটের কারণে আঞ্চলিক হাব হিসেবে বাংলাদেশের সম্ভাবনা দুর্বল হতে পারে বলে ট্রানজিট বাতিল করা হয়েছে।গত বছর ভারতী এয়ারটেলের মাধ্যমে সিঙ্গাপুর থেকে আখাউড়া সীমান্ত হয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ব্যান্ডউইথ সরবরাহের জন্য সামিট কমিউনিকেশনস এবং ফাইবার অ্যাট হোম আবেদন করলে বিটিআরসি এ ব্যাপারে টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অনুমতি চায়।

২০০৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে ফাইবার অ্যাট হোম ছিল অন্যতম সুবিধাভোগী। সরকারি চুক্তি ও লাইসেন্স প্রাপ্তির ক্ষেত্রে তারা সামিট কমিউনিকেশন্সের পরেই দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল।

দুই আন্তর্জাতিক টেরিস্ট্রিয়াল কেবল অপারেটর বিটিআরসির অনুমতি চাওয়ার আগে, আগের বছর ভারতী এয়ারটেল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি আবেদন করে। এতে তারা আখাউড়া হয়ে আগরতলাকে বাংলাদেশের কক্সবাজার ও কুয়াকাটার সাবমেরিন কেবল ল্যান্ডিং স্টেশনের সঙ্গে কানেক্ট করে সিঙ্গাপুর পর্যন্ত যাওয়ার অনুমতি চেয়েছিল।বলা হয়, এই ব্যবস্থায় বাংলাদেশ ট্রানজিট রুট হিসাবে কাজ করবে। এতে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরা, অরুণাচল প্রদেশ, আসাম, মিজোরাম, মণিপুর, মেঘালয় এবং নাগাল্যান্ডের জন্য দ্রুত ইন্টারনেট সংযোগ নিশ্চিত হবে।

বর্তমানে ভারতের সেভেন সিস্টার্স নামে পরিচিত রাজ্যগুলো চেন্নাইয়ে সাবমেরিন কেবলের মাধ্যমে সিঙ্গাপুরের সঙ্গে সংযুক্ত। চেন্নাইয়ের সাবমেরিন কেবল প্রতিবেশী দেশের অভ্যন্তরীণ ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে এই সুবিধা দিয়ে থাকে।চেন্নাইয়ের ল্যান্ডিং স্টেশন উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে প্রায় ৫ হাজার ৫০০ কিলোমিটার দূরে। এত বেশি দূরত্বের কারণে ইন্টারনেটের গতি কমে যায়।অন্যদিকে পাহাড়ি ভূপ্রকৃতির কারণে ঐ অঞ্চলে ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ক রক্ষণাবেক্ষণ এবং নতুন নেটওয়ার্ক স্থাপন তুলনামূলক কঠিন।বিটিআরসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এমদাদ উল বারী গণমাধ্যমকে বলেন, গাইডলাইন অনুযায়ী এ ধরনের ‘ট্রানজিট’ ব্যবস্থা দেওয়ার কোনো বিধান নেই।

এরপরই ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রক সংস্থা গত সপ্তাহে টেলিকম মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি পাঠিয়ে তাদের আগের আবেদনটি প্রত্যাহার করতে বলে।
বিটিআরসির নথি অনুযায়ী, এ ট্রানজিটের কারণে আঞ্চলিক হাব হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান দুর্বল হবে এবং ভারত এখানে শক্তিশালী হাব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।

এটি বাংলাদেশকে মেটা, গুগল, আকামাই এবং অ্যামাজনের মতো কনটেন্ট ডেলিভারি নেটওয়ার্ক (সিডিএন) সরবরাহকারীদের জন্য পয়েন্ট অব প্রেজেন্স (পিওপি) হওয়ার সম্ভাবনাকেও বাধাগ্রস্ত করবে।পিওপি এমন একটি জায়গা বা ডেটা সেন্টার যা বিভিন্ন নেটওয়ার্কের মধ্যে আন্তঃসংযোগ পয়েন্ট হিসাবে কাজ করে। এটি বিভিন্ন নেটওয়ার্ক, ইন্টারনেট পরিষেবা সরবরাহকারী এবং সিডিএনগুলোর মধ্যে ডেটা ট্র্যাফিক বিনিময় সহজ করে। সংক্ষেপে, এটি এমন একটি কেন্দ্রীয় হাব যেখানে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ডেটা হাইওয়ে একত্রিত হয়।

বর্তমানে মেটা, গুগল, আকামাই এবং অ্যামাজনের মতো সিডিএনগুলোর ভারতের কলকাতা, চেন্নাই এবং মুম্বাই শহরে পিওপি রয়েছে। সামিট এবং ফাইবার অ্যাট হোম ট্রানজিট কানেক্টিভিটির মাধ্যমে ভারতীয় টেলিকম অপারেটররা খুব সহজেই সেভেন সিস্টার্সে ইন্টারনেট সেবা দিতে পারবে।এছাড়া এই ব্যবস্থা বাংলাদেশের নিজস্ব অবকাঠামো দিয়ে মিয়ানমার ও উত্তর-পশ্চিম চীনের কিছু অংশে ইন্টারনেট সেবা দেওয়ার সম্ভাবনাকে চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলবে।বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক ব্যান্ডউইথের প্রায় ৬০ শতাংশ সরবরাহ করে সামিট কমিউনিকেশনস ও ফাইবার অ্যাট হোম এর সাতটি আইটিসি এবং বাকি ৪০ শতাংশ সরবরাহ করে বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবলস (বিএসসি)।

বিএসসির ব্যান্ডউইথ ৭ হাজার ২১৭ জিবিপিএস থাকা সত্ত্বেও বর্তমানে ব্যবহার হচ্ছে মাত্র ২ হাজার ৩৪৩ জিবিপিএস।বিসিএসের পর্যাপ্ত ক্ষমতা ও কেবল থাকলেও আইটিসি অপারেটরদের এ ধরনের সংযোগ দেওয়া হলে আইটিসি অপারেটরদের ব্যান্ডউইথ ব্যবহার আরো বৃদ্ধি পাবে। এতে করে বিসিএসের অব্যবহৃত বিপুল এই ব্যান্ডউইথ কাজে লাগানো ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।

তবে ফাইবার অ্যাট হোমের প্রধান টেকনোলজি অফিসার সুমন আহমেদ সাবির দাবি করেন, এটি বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর হবে না। যদিও তিনি স্বীকার করেন যে, এতে ভারতের সেভেন সিস্টার্স রাজ্যগুলো নিঃসন্দেহে আরো বেশি লাভবান হবে। তবে বাংলাদেশও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মাধ্যমে লাভবান হবে, এবং বিএসসি, আইটিসি ও ন্যাশনওয়াইড টেলিযোগাযোগ ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (এনটিটিএন) অপারেটররা লাভের অংশীদার হবে।এ বিষয়ে সামিট কমিউনিকেশনসের মন্তব্যের জন্য যোগাযোগ করা হলেও অনুরোধে সাড়া দেয়নি তারা।

বাংলাদেশ ইন্টারনেট গভর্নেন্স ফোরামের সভাপতি আমিনুল হাকিম বলেন, আলটিমেটলি ভারতের ব্যান্ডউইথ ভারতেই শেষ হবে, আর বাংলাদেশ নিছক একটি ট্রানজিট পয়েন্টে পরিণত হবে।

প্রথমে মনে হতে পারে বাংলাদেশ এই ব্যবস্থার মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করবে। তবে, যেহেতু ট্রানজিট সুবিধার্থে দুটি স্থানীয় আইটিসি সরবরাহকারী ইতোমধ্যে ভারতীয় সংস্থাগুলো থেকে ব্যান্ডউইথ আমদানি করছে, এবং এতে করে পরিষেবা বিনিময়ের যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে তাতে সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হবে বলে জানান আমিনুল হাকিম।

পরিকল্পনা বাস্তবায়িত না হলে ‘ক্ষতি’ ভারতেরই

ভারতের সেভেন সিস্টার্স থেকে চেন্নাই সাবমেরিন ক্যাবলের ল্যান্ডিং স্টেশনের দূরত্ব ৫৫০০ কিলোমিটার। বর্তমান নেটওয়ার্কে ভারতের সিঙ্গাপুর পর্যন্ত দূরত্ব ৮৭০০ কিলোমিটার। সেভেন সিস্টার্সের পথের এলাকা দুর্গম হওয়ায় ফাইবার নেটওয়ার্ক রক্ষণাবেক্ষণ, নতুন নেটওয়ার্ক তৈরি ও নেটওয়ার্ক ঠিক রাখা বেশ দুঃসাধ্য কর্মযজ্ঞ।

শুধু তাই নয়, দীর্ঘ দূরত্বের কারণে ল্যাটেন্সি হয় ৫৫ মিলিসেকেন্ড, এটি সিঙ্গাপুর পর্যন্ত গিয়ে দাঁড়ায় ৮৭ মিলিসেকেন্ড। বাড়ায় খরচও। ফলে মানসম্মত সেবা দেওয়া অনেক চ্যালেঞ্জিং। অন্যদিকে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে এই ট্রানজিট নেটওয়ার্কের কারণে দূরত্ব কমে যাবে ৩ হাজার ৭০০ কিলোমিটার আর সিঙ্গাপুর পর্যন্ত ল্যাটেন্সি কমে যাবে ৩৭ মিলিসেকেন্ড।

বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবলস পিএলসির (বিএসসিপিএলসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আসলাম হোসেন বলেন, তারা যেটা করতে যাচ্ছিল, কলকাতা দিয়ে ইন্ডিয়ার ব্যান্ডউইথ নেবে, সেটা আমার দেশের ভেতর দিয়ে নিয়ে ওই ব্যান্ডউইথ সেভেন সিস্টার্সে পাঠাবে। এটা ইলিগ্যাল ট্রাফিকিং।

আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট গেটওয়ে অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (আইআইজিএবি) সভাপতি আমিনুল হাকিম বলেন, এই ট্রানজিটে বাংলাদেশের কোনো লাভ হতো না। লাভবান হতো দুই আইটিসি অপারেটর। তারা কৌশলে এমন একটি আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ে যেতো যেখানে আইটিসি হিসেবে ভারত হতে ব্যান্ডউইথ কেনা এবং এই ট্রানজিটের চার্জ নিয়ে কোনো লেনদেন হতো না। ফলে সরকার বিপুল রাজস্ব হারাতো।