বৃদ্ধ টুলুরানীর জীবন কথন

604

আজ যারা বৃদ্ধ তারা নিজেদের জীবনের মূল্যবান সময়, ধন-স¤পদ বিনিয়োগ করেছিলেন সন্তানের জন্য, নিজের জন্য রাখেন নি কিছুই। কিন্তু আজ অনেক মা কিংবা বাবা সন্তানের কাছ থেকে এর একটি ক্ষুদ্র অংশও পাচ্ছেন না। কখনও দেখা যায় সন্তান তার নিজের পরিবারের খরচ যোগাতে হিমশিম খাচ্ছে, তাই পিতা-মাতাকে মনে করছে বোঝা। আবার এমনও দেখা যায় যে সন্তানের টাকা পয়সার অভাব নেই, কিন্তু পিতা-মাতাকে নিজের কাছে রাখার প্রয়োজন বোধ করছেন না, বা বোঝা মনে করছেন। কেউ কেউ আবার এমনও বলেন, তার টাকার অভাব না থাকলেও সময়ের অভাব আছে, পিতা-মাতাকে দেখভাল করা বা তাদের সঙ্গে কথা বলার মতো পর্যাপ্ত সময় তার নেই। তবে এমন মানুষের সংখ্যা খুব বেশি না হলেও কমনয়। আবার এমনও দেখা গেছে যে সংসারে ছেলে সন্তানই নেই। মেয়ে সন্তানদের বিয়ে হয়ে গেলে তারা শ্বশুরবাড়িতে স্বামী সন্তান নিয়ে ঘর-সংসার করেন। তাদের মধ্যে দুয়েকজন বৃদ্ধ মা বাবাকে সাহায্য করার সুযোগ পেলেও দরিদ্র পরিবারের সেই মেয়েরা ইচ্ছে থাকলেও তা পারে না।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের হরিপুর এলাকায় গিয়েছিলাম অনুষ্ঠানের কিছু কাজে। একটা বাড়িতে বসে আমার কাজগুলো শেষ করে বের হয়েছি অফিসে ফিরে আসার জন্য। হাতে রয়েছে বুম আর রেকর্ডার। তা দেখে প্রায় ৬২ বছর বয়সী এক বৃদ্ধা গায়ের সবটুকু শক্তি দিয়ে দৌড়ে এলেন আমার কাছে। আমার গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, “মা শোন, তুমি তো সাংবাদিক। হামার ম্যালাই বয়স হয়্য গেছে, তাও হামাকে কেহু একটা বয়স্ক ভাতা কার্ড কর‌্যা দেয় না, হামি কি করবো কহোতো মা।” আমি হতবাক হয়ে গেলাম। উনি আমাকে কাকুতি মিনতি করে আরো অনেক কিছু বলতে চায়লেন। কিন্তু আমি ওনার কথা কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। তাই ওনাকে থামিয়ে আমি বললাম, আপনার নাম কি? বাড়ি কোথায়? ইতোমধ্যে সেখানে অনেক মানুষ জমা হয়ে গেলো। তারা সবাই আমাকে বলতে লাগলো, ও অনেক গরিব নারী। ও কি বলতে চায়ছে একটু শোনেন। আপনি তো সাংবাদিক, যদি ওর জন্য কিছু করতে পারেন। আমি মহিলাকে বললাম, চলেন আপনার বাড়ি কোনটা আমাকে দেখান। আমাকে নিয়ে গিয়ে বসতে দেবার জন্য অস্থির হয়ে পড়লেন বৃদ্ধ মহিলা। কিন্তু ওনার বাড়িতে এমন কিছুই ছিলনা যাতে আমাকে বসতে দেবেন। আমি বুঝতে পেরে বললাম, ঠিক আছে, বসতে দিতে হবে না।
তাঁর কথা আমি জানতে চাইলাম। তখন তিনি বলতে শুরু করলেন। “হামার দ’ুটা বেটি, অরঘে বিহ্যা দিয়্যা দিয়্যাছি। এখন এই বাড়িতে হামি একলাই থাকি। ওরা হামাকে দেখতে আসতে পারে না, অরঘে সংসার লিয়্যা ওরা ব্যস্ত। মাঝে মধ্যে আসে। হামারঘে এখানকার মেমবারকে কহ্যাছিনু কার্ড করার লাইগ্যা, কিন্তু হয় নি। আরো কতো কার কাছে গেছিনু মা, তাও কেহু কর‌্যা দেয় নি। বর্ষার সময় হামার ঘরের টিন দিয়্যা পানি পড়ে। পানির সময় ঘরের বিছান পর্যন্ত ভিজ্যা যায়।” আমি যখন তাঁর কথাগুলো শুনছিলাম, তখন একজন মহিলা পাশ থেকে আমাকে কিছু বলতে চায়ছিলেন। আমি ওনার কথাগুলো শুনলাম। তিনি বলছিলেন, “এই মহিলা সত্যি খুব গরিব। ও অন্যের বাড়ি থেকে চেয়ে নিয়ে এসে খায়। যদি কারো মনে একটু দয়া হয় তাহলে এক মুঠো চাল দ্যাই। কতদিন আমি ওকে খেতে দিই। আর যদি অসুস্থ হয়ে বিছানা থেকে পাঁচ দিন উঠতে না পারে তাও কেহু দেখার নাই।” সবার কথাগুলো শোনার পর মনটা খুব খারাপ হল এভেবে যে এখনও অনেক বৃদ্ধ মহিলা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত। ওই ওয়ার্ড কাউন্সিলর মতিউর রহমান মটন মিয়াকে বিষয়টি জানানো হলে তিনি টুলু রানীর বাড়িতে গিয়ে সবকিছু দেখার পর আশ্বাস দেন যে তিনি টুলু রানীকে বয়স্ক ভাতা কার্ড করে দেবেন।
আবহমানকাল থেকে চলে আসা পারিবারিক বন্ধনে যে দীনতা প্রকাশ পাচ্ছে তার দায়ভার আমাদেরকে নিয়ে একটু ভাবতে হবে। আমাদের কর্তব্যবোধ, শ্রদ্ধাবোধ, মানবিক মুল্যবোধ, ধর্মীয় মূল্যবোধের জায়গাটি আরো বেশী স্বচ্ছ হওয়া উচিত। আমরা তো পারি আমাদের মা-বাবাকে শেষ বয়সে আমাদের পাশে রেখে একটু ভালবাসা দিতে, তাদেরকে নিজ হাতে খাইয়ে দিতে, নিজ হাতে সেবা করতে কিংবা একটু হাসি মুখে খোঁজখবর নিতে। মা-বাবা শেষ বয়সে বেশী কিছু চান না, তাদের সাথে একটু ভালো করে কথা বলুন, দেখবেন তাদের চেহারায় কি প্রশান্তির ছোঁয়া।

মরিয়ম নেসা
ফেলো, রেডিও মহানন্দা ৯৮.৮ এফএম