বিশেষ নিবন্ধ : চাঁপাইনবাবগঞ্জের পক্ষে ফজলি আমের জিআই স্বীকৃতির দাবি

211
সামসুল ইসলাম টুকু

ফজলি আম জিআই পণ্য হিসেবে রাজশাহী জেলার পক্ষে নিবন্ধনের বিরোধিতা করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার পক্ষে নিবন্ধনের দাবিতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তরে আপত্তি দাখিল করা হয়। প্রেক্ষিতে পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর এই আপত্তির যৌক্তিকতা বিবেচনা করেই আগামী ২৪ মে উভয়পক্ষের শুনানির দিন ধার্য করেছে।
ইতোপূর্বে ফজলি আমের জিআই স্বীকৃতির দাবিতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও শিবগঞ্জে বাগানমালিক, আম ব্যবসায়ী, চেম্বার অব কমার্স, সাংবাদিকসহ জেলার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ মানববন্ধন, জেলা প্রশাসককে স্মারকলিপি প্রদানসহ আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে।
জাতীয় পর্যায়ে আম বলতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমকেই বোঝায় এবং সেটা প্রায় হাজার বছরেরও অধিক সময় ধরে। কেননা ফজলি আমের উৎপত্তি গৌড় থেকে। দেশ বিভাগের প্রায় দেড়শত বছর আগে থেকেই মালদহ তথা গৌড়ের ফজলি আমের সুখ্যাতি রয়েছে। গৌড়ের অংশ হিসেবে সেই সুখ্যাতির পূর্ণ দাবিদার চাঁপাইনবাবগঞ্জ।
১৮০০ শতাব্দীতে চাঁপাইনবাবঞ্জ সীমান্ত সংলগ্ন গৌড়ে ফজলিবিবি নামে এক বৃদ্ধ বাস করতেন। সে সময় মালদহ জেলা কালেক্টর র‌্যাভেন ’শ সরকারি কাজে গৌড়ে আসেন ও বৃদ্ধার বাড়ির কাছে শিবির স্থাপন করেন। কালেক্টরের আগমন বার্তা শুনে বৃদ্ধা কালেক্টরের জন্য উপঢৌকন হিসেবে তার বাড়ির আঙ্গিনার আম উপহার দেন। কালেক্টর আম খেয়ে তৃপ্ত হয়ে বৃদ্ধার কাছে সেই আমের নাম জানতে চান। বৃদ্ধা কথা বুঝতে না পেরে তার নিজের নাম ‘ফজলি বিবি’ বলেন। সেই থেকে র‌্যাভেন ’শ আমটির নামকরণ করেন ‘ফজলি’।
রাজশাহীতে ফজলি বা অন্য কোনো আমের ঐতিহাসিক স্বীকৃতি নেই। কেননা ফজলি আমের চারা চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে রাজশাহীসহ অন্যান্য জেলায় সংগ্রহ ও রোপণ করা হয়েছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ রাজশাহী জেলার অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সময় পরিচিতি সংকট দেখা দেয়। সেই সুবাদেই চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম ‘রাজশাহীর আম’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাট উপজেলা হলো দেশ বিভাগ-পূর্ব থেকে রেশমের সূতিকাগার। বর্তমানে দেশের মোট ৭০ শতাংশ রেশম সুতা সেখানে উৎপাদিত হয়। শুধু তাই নয়, শিবগঞ্জ উপজেলার হরিনগর, সদর উপজেলার লাহারপুর ও বারঘরিয়ার তাঁতে বোনা রেশম বস্ত্র দেশখ্যাত। এসব গ্রামের বুননকৃত রেশম বস্ত্র নিয়ে গিয়ে রাজশাহীর সিল মেরে দেশভাগের পর থেকে এখন পর্যন্ত বিপণন অব্যাহত আছে। এভাবেই রেশমের জিআই স্বীকৃতিও ছিনতাই হয়ে গেছে।
কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে উৎপাদিত মোট ফজলি আমের এক-তৃতীয়াংশ চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলাতেই উৎপাদিত হয়। এ জেলায় ৩৮ হাজার হেক্টর জমিতে ৪ লাখ টনের উপর আম উৎপাদিত হয়, যার মধ্যে ২৩ শতাংশ বা প্রায় ৮৫ হাজার টন ফজলি আম উৎপাদিত হয়। যেখানে রাজশাহী জেলায় ফজলি আম উৎপাদন হয় মাত্র ২৮ হাজার টন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলাতে যে পরিমাণ ফজলি আম উৎপাদন হয়, বাকি সব অন্যান্য জেলা মিলে ওই পরিমাণ উৎপাদন হয়। স্বাধীনতার পর থেকে সিংহভাগ আমের বিপণন হয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকেই। এখনো এই ধারা অব্যাহত আছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার মতো বিশাল পরিমাণের আমবাগান আজও অন্য কোনো জেলায় নেই। আমের জন্য লাগসই ভূপ্রকৃতি ও আবহাওয়া আমচাষের জন্য খুবই উপযোগী।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর যে সকল শর্তের প্রেক্ষিতে জিআই পণ্যের স্বীকৃতি প্রদান করে (অর্থাৎ ঐতিহাসিক, ভৌগোলিক, উৎপাদন, বিপণন ও নামকরণ) সবই ফজলি আমের ক্ষেত্রে পূরণ করেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কোনো ভোক্তার সামনে যদি চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহীর ফজলি আম রাখা যায় তাহলে ভোক্তা প্রথমেই চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আমই বেছে নেবে। এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কি হতে পারে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনের মাননীয় সংসদ সদস্য মহান সংসদে ফজলি আমের জিআই স্বীকৃতির দাবিতে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেছেন। এছাড়া অন্য দুজন মাননীয় সংসদ সদস্যও চাঁপাইনবাবগঞ্জের পক্ষেই ফজলি আমের জিআই স্বীকৃতির দাবি জানিয়েছেন।

সামসুল ইসলাম টুকু : প্রবীণ সাংবাদিক ও লেখক