বিদ্যুৎ উৎপাদক থেকে ক্রেতায় পরিণত হয়েছে পিডিবি

580

কয়েক বছর আগেও দেশের সিংহভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতো বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত ওই সংস্থাটি বর্তমানে উৎপাদনের চেয়ে বিদ্যুৎ ক্রয়েই বেশি মনোযোগী হয়ে পড়েছে। বিগত ২০০৯-১০ অর্থবছর পিডিবির মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার ৭০ শতাংশ। কিন্তু এখন উৎপাদন সক্ষমতায় প্রতিষ্ঠানটির মোট হিস্যা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৪৩ শতাংশে। তার বিপরীতে বাড়তে থাকে বিদ্যুৎ ক্রয় বাবদ ব্যয়। বর্তমানে পিডিবির মোট পরিচালন ব্যয়ের ৭০ শতাংশই যাচ্ছে বেসরকারি, রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্র থেকে বিদ্যু কিনে। যদিও ২০০৯-১০ অর্থবছরও ওই ব্যয় ছিল ৫৭ শতাংশ। পিডিবি সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিগত ২০০৯-১০ অর্থবছর মোট ৩৩টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে বেসরকারি, রেন্টাল ও কুইক রেন্টালসহ বেসরকারি খাতের ছিল ১৩টি। আর প্রায় ৫ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদনক্ষমতার মধ্যে সাড়ে ৩ হাজার মেগাওয়াটই ছিলো পিডিবির। বর্তমানে সক্ষমতা ১৫ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত হলেও পিডিবির নিজস্ব সক্ষমতা এখনো সাড়ে ৬ হাজার মেগাওয়াট। পিডিবির অনেক  বিদ্যুৎ কেন্দ্র এই সময়ে উৎপাদনে আসার কথা থাকলেও কাক্সিক্ষত অগ্রগতি হয়নি। ২০১৪ সালের বিভিন্ন সময় প্রতিষ্ঠানটির মোট ১১টি  বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ওসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে হাতেগোনা দু-একটি ছাড়া অধিকাংশেরই অগ্রগতিই আশানুরূপ নয়। সেগুলোর মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জে ফার্নেস অয়েলভিত্তিক ১০০ মেগাওয়াট, বাঘাবাড়ী ১০০ মেগাওয়াট গ্যাস  বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সংস্কার, বিবিয়ানার তৃতীয় ইউনিট এবং ঘোড়াশালের ৪৫০ মেগাওয়াট  বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ এখনো শেষ হয়নি। তাছাড়া শিকলবাহা ২২৫ মেগাওয়াট কম্বাইন সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির উৎপাদনে আসার কথা ছিল ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে। পরবর্তীতে প্রকল্পটি চালুর সময় ধরা হয় গতবছরের ডিসেম্বর। দ্বিতীয় দফা সময় বৃদ্ধির পরও প্রকল্পের অগ্রগতি এখন পর্যন্ত মাত্র ৫২ শতাংশ। মূলত দ্রুত সরবরাহের নামে বেসরকারি খাতকে সুযোগ দেয়ায় সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অগ্রগতি সেভাবে হচ্ছে না। ফলে বাড়ছে বেসরকারি কেন্দ্র থেকে  বিদ্যুৎ ক্রয়। রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল থেকে উচ্চ দামে বিদ্যুৎ কেনায় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটির লোকসানও বাড়ছে।
সূত্র জানায়, উৎপাদনের পাশাপাশি ঢাকা ও পশ্চিমাঞ্চল ছাড়া দেশের শহরাঞ্চলে বিদ্যুৎ বিতরণের একমাত্র রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান পিডিবি। নিজস্ব কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত এবং রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্র থেকে  বিদ্যুৎ কিনে রাষ্ট্রায়ত্ত ৫টি বিতরণ কোম্পানি ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি), ঢাকা ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো), ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ওজোপাডিকো), বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (বিআরইবি) ও নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (নওজোপাডিকো) কাছে পাইকারি মূল্যহারে বিক্রি করছে। বেসরকারি কেন্দ্র থেকে বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনতে গিয়ে চাপ বাড়ছে পিডিবির পরিচালন ব্যয়ে। বিগত ২০০৯-১০ অর্থবছর প্রতিষ্ঠানটির মোট পরিচালন ব্যয় ছিল ৭ হাজার ৫১২ কোটি টাকা। তার মধ্যে বেসরকারি খাত থেকে বিদ্যুৎ কেনায় ব্যয় হয় ৪ হাজার ২৮১ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ওই সময় প্রতিষ্ঠানটির পরিচালন ব্যয়ের প্রায় ৫৭ শতাংশ ছিল  বিদ্যুৎ ক্রয় বাবদ। আর সর্বশেষ ২০১৫-১৬ অর্থবছর ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার (আইপিপি) থেকে বিদ্যুৎ কিনতে পিডিবির ব্যয় হয়েছে ৭ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকা। তাছাড়া রেন্টাল থেকে ক্রয় বাবদ ৬ হাজার ৪৫২ কোটি, ভারত থেকে আমদানি বাবদ ১ হাজার ৯৬৬ কোটি ও সরকারি কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনতে ৩ হাজার ৯৯৩ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। অর্থাৎ অর্থবছরটিতে শুধুমাত্র বিদ্যুৎ ক্রয় বাবদই পিডিবির ব্যয় হয় ১৯ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা, যা তাদের মোট পরিচালন ব্যয়ের ৭০ শতাংশ।
সূত্র আরো জানায়, গত ৮ বছরে দেশে নতুন যে ৮০টি  বিদ্যুৎ কেন্দ্র যোগ হয়েছে তার ৫৪টিই বেসরকারি খাতের। বর্তমানে উৎপাদনরত মোট ১০৬টি  বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে ৬১টি ব্যক্তিখাতের। তার মধ্যে কুইক রেন্টাল ১৬টি, রেন্টাল ১১টি, আইপিপি ২১টি ও এসআইপিপি ১৩টি। আর ক্যাপটিভ পাওয়ার বাদে মোট উৎপাদন সক্ষমতা ১২ হাজার ২২৯ মেগাওয়াটের মধ্যে পিডিবির অংশ ৬ হাজার ৪৪০ মেগাওয়াট। প্রায় কাছাকাছি বেসরকারি খাতের উৎপাদনও। আর আমদানি হচ্ছে ৬০০ মেগাওয়াট। তাছাড়া বর্তমানে নির্মাণাধীন ৩১টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যেও ১৪টি ব্যক্তিখাতের। আর এ ধারা অব্যাহত থাকলে একসময় হয়তো পিডিবির নিজস্ব কোনো উৎপাদনই থাকবে না। তখন সেটি একটি এগ্রিগেটর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। তাছাড়া পিডিবিকে নিজেদের উৎপাদন ব্যয়ের দেড় থেকে দুই গুণ বেশি দামে বেসরকারি কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনতে হচ্ছে। ফলে প্রতি বছরই সংস্থাটির পরিচালন ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করছে। গত ৬ বছরে প্রতিষ্ঠানটির লোকসানের পরিমাণও দাঁড়িয়েছে ৪০ হাজার কোটি টাকা। সর্বশেষ অর্থবছরও লোকসান হয়েছে ৩ হাজার ৪৯৩ কোটি টাকা।
এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকারি কেন্দ্রের হিস্যা হ্রাস পেতে থাকলে বেসরকারি খাতের ওপর নির্ভরতা বাড়বে। তাতে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। বিদ্যুৎ খাতের ওপর পিডিবি নিয়ন্ত্রণ হারালে বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালিকরা তাদের সুবিধামতো উৎপাদন খরচ চাইবে। আর সরকারও তা মানতে বাধ্য হবে। কারণ বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনা ২০১০ অনুযায়ী ২০২১ সালের মধ্যে মোট উৎপাদন সক্ষমতা ২৪ হাজার ও ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াটে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সরকার। ওই লক্ষ্য অর্জনে কয়লাভিত্তিক প্রায় ২৫টি বড়  বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানান, চাহিদা বৃদ্ধিও কারণেই বিদ্যু ক্রয়ে পিডিবির ব্যয় বাড়ছে। বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো চালু হলে বেসরকারি খাত থেকে ক্রয়ের পরিমাণ কমতে পারে। তবে চাহিদা থাকলে তখনো হয়তো বেসরকারি খাত থেকে এখন যা কেনা হয়, তার চেয়ে বেশিও কিনতে হতে পারে।