বাণিজ্য সংকটে বাংলাদেশ-ভারত স্থল সীমান্ত পথ

318

বাংলাদেশ-ভারতের স্থল সীমান্ত দিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি অল্প হওয়ায় উদ্বিগ্ন ভারতের কর্মকর্তা মহল। বাংলাদেশ-ভারতের ৬০০ কোটি ডলারের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের ৫০ শতাংশ (অর্ধেক) হয় স্থলপথে। সম্প্রতি সবচেয়ে বড় ইন্টিগ্রেটেড চেকপোস্ট বেনাপোল (বাংলাদেশ)-পেট্রাপোল (ভারত) স্থাপন করা হয়েছে বেশি দিন হয়নি। এই চেকপোস্টের মাধ্যমে দক্ষিণ/সেন্ট্রাল বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ সংযুক্ত রয়েছে। এ ধরনের প্রথম চেকপোস্ট চালু করা হয়েছিল তারও কিছুদিন আগে দুই দেশের চুক্তিতে আগরতলা-আখাউড়া এলাকায়। এ সমস্যার সমধানে দুটি প্রস্তাব হাজির করছেন তারা, (১) সাগর পথে পণ্য পরিবহন বৃদ্ধি এবং রেলপথে যাতায়াত ও পণ্য পরিবহন বাড়ানো। বেনাপোল-পেট্রাপোল চেকপোস্টের সবচেয়ে বড় সমস্যা উভয় পাশেই মানুষের ঘনবসতির ব্যাপকতা, মূল সড়কও অনেক ছোট। নদীর তীরও সমস্যা তৈরি করে। এছাড়া অনেক সময় ছোটোখাটো আইনশৃঙ্খলাজনিত সমস্যা ও বাধা, হোক তা প্রাকৃতিক বা রাজনৈতিক কারণে; নিয়মিতই উভয় পাশে পণ্য আনা-নেওয়াতে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে।
কলকাতাভিত্তিক একটি আন্তর্জাতিক পরিবহন কোম্পানি কাস্তুরিলাল হরলাল-এর এক মুখপাত্র বলেন, কলকাতা থেকে পেট্রাপোলের দূরত্ব মাত্র ৮০ কিলোমিটার। কিন্তু এতটুকু দূরত্বের শেষ তিন কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে এখন পড়ে ৭২ ঘণ্টা সময় লাগে। সামান্য একটা কিছু হলেই এটা ঘটে। এর ফল হচ্ছে সব সময় যানজট যা কয়েকমাইল ছাড়িয়ে সীমান্তের দুই পারে। মালবোঝাই ট্রাকগুলো আটকে পড়তে বাধ্য হয়। মুখপাত্র আরও বলেন, ফলে ডেলিভারি শিডিউলকে করে তোলে অর্থহীন, উভয় দেশের অর্ডার বাতিল ও লোকসানের মুখে পড়ে আমদানি-রফতানি। এটার সঙ্গে অবশ্যই যোগ হবে সময়, খাবার ও কয়েক মানুষের শ্রম ঘণ্টা। যা আগে থেকে পরিকল্পনা করা যায় না। স্থানীয় পণ্য পরিবহনকারীদের মতে, সাধারণভাবে বাংলাদেশের অংশের সড়কের অবস্থা ভালো। ভারতের ভেতরে অংশে কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যকে সড়ক প্রশস্ত ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য চাপ দিয়ে আসছে, বেশ কয়েকটি প্রণোদনার প্রস্তাবও দিয়েছে। তবে সড়ক প্রশস্ত করা এবং সড়কের চারপাশ দখলমুক্ত করা রাজ্য সরকারের দায়িত্ব। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছায় ঘাটতি এবং দুর্বল আর্থিক ব্যবস্থা আছে। ক্ষমতাসীন দলের ভোটব্যাংকের কথা বাদ দিলে চলবে না। যখন বেআইনী ও দখলের প্রশ্ন আসে তাতে স্থানীয় নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতা থাকে। কেন্দ্রের ঘোষণা অনুযায়ী উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। সবচেয়ে খারাপ হলো, এই বিষয়টিকে কলকাতাভিত্তিক কর্মকর্তারা গুরুত্বের সঙ্গেই নেন না। ঢাকা ও দিল্লির উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু খুব একটা অগ্রগতি হয়নি। যদি প্রশস্ত সড়কে উভয় দেশের পণ্য ও মানুষের অবাধ পরিবহন ও চলাচল নিশ্চিত করা না যায় তাহলে দীর্ঘমেয়াদে দক্ষিণ এশিয়াসহ পুরো অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নতিতে প্রভাব পড়বে। বিমসটেক, বিবিআইন, লুকইস্ট এবং অন্যান্য গ্রুপ ও প্রকল্পেও এর প্রভাব পড়বে।
কিভাবে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বাড়ানো যায় নিয়ে এখনও ভারতের বিশেষজ্ঞরা বিভক্ত। কয়েকজন মনে করেন, নৌপথে পণ্য পরিবহন বৃদ্ধি করা দরকার। এই মতের বিশেষজ্ঞরা দেরিতে হলেও দ্বিপক্ষীয় চুক্তির কথা তুলে ধরেন। এই চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের রফতানিকারকদের ভারতে পণ্য পাঠানোর জন্য সিঙ্গাপুর বা কলম্বো বন্দর ব্যবহার প্রয়োজন পড়বে না। বাংলাদেশি জাহাজ এখন কলকাতা, হালদা, পারাদিপ ও অন্য বন্দরে সরাসরি আসতে পারে। একইভাবে ভারতের জাহাজগুলোও সরাসরি বাংলাদেশের বন্দরে যেতে পারে। নৌপথে পণ্য পরিবহনের সুবিধা হলো জ¦ালানি খরচ কম। যে কোনও ধরনের ব্যাঘাত ও দূষণ এড়ানো যাবে। কয়েকটি পরিসংখ্যান অনুসারে, নৌপথে পণ্য খালাসের ক্ষেত্রে সড়ক পথের তুলনায় ৩০ শতাংশ অর্থ কম লাগবে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম ও কলকাতা-হালদিয়াতে আরও বেশি জাহাজ গ্রহণের সামর্থ্য রয়েছে। যা এসব বন্দরের আর্থিক কার্যকারতা বৃদ্ধি করবে।
বিশেষজ্ঞদের আরেকটি দল মনে করেন, রেলপথে পণ্য পরিবহনই সবচেয়ে ভালো উপায়। দুই দেশের রেল যোগাযোগ রয়েছে। কুমিল্লা-ত্রিপুরা আগেই ছিল, কিছুদিন আগে কলকাতা-খুলনা চালু হয়েছে। মৈত্রী এক্সপ্রেস নিয়মিতই ঢাকা-কলকাতা চলাচল করছে। কলকাতায় কর্মরত এক মাল্টিন্যাশনাল এজেন্সির অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ শৌনাক মুখার্জি বলেন, এসব সেবার মাধ্যমে যতবেশি সম্ভব পণ্য ও মানুষের পরিবহন নিশ্চিত করতে চুক্তি করা উচিত উভয় দেশের। যাতে করে সময়মাফিক ও টানা চলাচল অব্যাহত থাকে। তাৎপর্যপূর্ণ হলো কোনও রকমের প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই দুই দেশের মধ্যে রেল যোগাযোগ রয়েছে। যা স্থল পথের চেয়ে অনেক ভালো। মুখার্জি জানান, দীর্ঘ মেয়াদে যাত্রী ও কার্গো পরিবহনের ক্ষেত্রে রেলপথই সাশ্রয়ী হবে। আর তা নৌপথের চেয়েও দ্রুত হবে। দুই দেশের উচিত রেল যোগাযোগ সম্প্রসারণে কাজ করা।
সমাধান যাই হোক উভয় দেশের রফতানিকারকরা পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে উন্নতি দেখতে উন্মুখ। এ ক্ষেত্রে উন্নতি না ঘটলে আঞ্চলিক অর্থনীতি শ্লথ হয়ে পড়তে পারে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ও ভারতের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বৃদ্ধির চেয়ে সহায়ক আর কিছু হতে পারে না।