বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া টেস্ট সিরিজ ২০১৭ বাজে হারের পরও সিরিজ ড্র করার গর্ব

4746
AFP_S703L

১৯০২ সাল। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মাত্র ৩৬ রানে অল আউট অস্ট্রেলিয়া। প্রথম ইনিংসে। ১৮৮৮। ইংলিশরা সেবার সিডনিতেই ৪২ এর পর ৮৪ রানে স্বাগতিকদের অল আউট করে দিয়ে জিতেছিল ম্যাচটা। ২০০ রানের টার্গেট ছিল। ১২৯ বছর পেরিয়েছে মাঝে। হিমালয় উচ্চতার আশাবাদী মানুষও কি ভাবতে পারেন মাত্র ৮৬ রানের টার্গেট দিয়ে ম্যাচটা জিতে যাবে বাংলাদেশ? সেই সংখ্যাটা বুঝি শূন্যের কোটায়। তালগোল পাকানো ব্যাটিংয়ে টাইগারদের শেষটা হলো নিষ্ঠুর ভাবে। যে ২১টি ওভার বাকি ছিল চতুর্থ দিনের তাতেই কাজটা সেরে ফেলে অস্ট্রেলিয়া মান বাঁচানোর চরম স্বস্তি নিয়েই ফিরতে পারছে দেশে। ঢাকার অসাধারণ জয়ের পর চট্টগ্রামে প্রায় প্রতিরোধহীন হার। কেউ জিতলো না সিরিজ। ১-১ এ হলো ড্র। কিন্তু আসলেই কি জিতলো না কেউ? টাইগারদের গর্জনে যখন অস্ট্রেলিয়ার মতো দল হোয়াইটওয়াশ হওয়ার হুমকির মুখে পড়ে তখন এই ড্র তো বাংলাদেশের জন্য জয়ের চেয়ে বেশি ক্রিকেট ফোকলোরে বাংলাদেশের জন্য ঐতিহাসিক সিরিজটা অমরত্ব নিয়ে রয়ে গেলো ঠিকই সেটাও বা কি কম গর্বের?কিন্তু কথা থেকে যায়। চট্টগ্রামে এসে কি হলো বাংলাদেশের? চতুর্থ দিনের সকালে ১৩ বলের মধ্যে শেষ উইকেটটা কোনো রান না দিয়েই তুলে ফেলা। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম বাংলাদেশি বোলার হিসেবে ৪ উইকেট কাটার মাস্টার মোস্তাফিজুর রহমানের। ৩৭৭ প্রতিপক্ষকে অল আউট করে তখনো ম্যাচ বাঁচানোর বা তারো বেশি কিছু করার হাতছানিটা তখনো খুব আছে। কিন্তু কে জানতো অপেক্ষায় দুঃস্বপ্নের মতো এক ব্যাটিং। লেজেগোবরে ব্যাটিং বুঝি একেই বলে ৪৩ রানে দ্বিতীয় ইনিংসের ৫ উইকেট নেই সেরা পাঁচের এমন বিদায়ের পর আর কি থাকে? তবু টেনেটুনে ১৫৭। ৪৮ রানের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার ৩ উইকেট তুলে নেওয়াও আশাবাদী করতে পারে না। কেবল মাঠ ও টেলিভিশনের দর্শকদের মনে সামান্য উত্তেজনা আনে। রোমাঞ্চ তো হারিয়ে গেছে প্রথম ইনিংসের ব্যাটিংয়েই, প্রমাণিত ম্যাচশেষে। পুরো ম্যাচে একবারও হুইলটা ধরতে না পারা স্বাগতিকরা হেরে যায় সহজেই। ৭ উইকেটে। ১৫৩ ওভারেই। অস্ট্রেলিয়াকে টাইগারদের হোয়াইটওয়াশ করার স্বপ্নের সলীল সমাধী। গ্লেন ম্যাক্সওয়েল গ্যালারিতে বলটা পাঠিয়ে হাসিমুখেই একদিনের বিশ্রাম দিয়ে দেন দুই দলকে। স্টাইলের সাথে শেষ অস্ট্রেলিয়ার। ঠিক অস্ট্রেলিয়ার মতো করেই। ন্যাথান লায়ন সিংহের মতো গর্জন করলেন আবার। জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে ধুলো ওড়া পিচে পঞ্চম দিনে আরো বড় টার্গেট দিয়ে অস্ট্রেলিয়াকে ব্যাটিংয়ে পাঠানোর ভাবনাটা গোত্তা খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে নিজেদের হাতে গড়া পিচে। যেখানে ম্যাচে ক্যারিয়ার সেরা বোলিং লায়নের। ৭ উইকেটের পর ৬টি। আগের ১২টি পেরিয়ে যায়। দুই ম্যাচের সিরিজে ২২ উইকেট এক বোলারের বিস্ময় আর কাকে বলেতবে বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের এবং কিউরেটরদের ধন্যবাদ তিনি নিশ্চয়ই জানাবেন। ব্যাটসম্যানদের কাছ থেকে না চাইতেই পেয়েছেন বেশ উপহারমƒলক উইকেট। আর কিউরেটররা তো তার মতো অফির জন্য আদর্শ পিচ বানিয়ে রেখেছিলেন। যদিও সেটা ছিল বাংলাদেশের স্পিনারদের জন্য। শেষমেষ নিঃসন্দেহে সিরিজের সেরা খেলোয়াড় সবকিছু নিজের মতো করে নিয়ে দেশকে বিরাট লজ্জার মুখোমুখি হওয়া থেকে বাঁচিয়ে গেলেন। নিজের ঘরে তামিম ইকবাল (১২) ব্যর্থ দুই ইনিংসেই। ইমরুল কায়েস (১৫) আত্মবিশ্বাসহীনতায় উইকেট এমনভাবে বিসর্জন দেন যা সামনের দক্ষিণ আফ্রিকা সফর থেকে ছিটকে ফেলার জন্য যথেষ্ট। সৌম্য সরকারের (৯) ওপেনার হিসেবে গ্লানির মতো হয়ে থাকলো সিরিজটা। পাকা আমের মতো যখন টপাটপ বৃন্তচ্যুত হয়ে উইকেট পড়ছে, তখন নিশ্চয়ই অনেকে বৃষ্টির প্রার্থনায় কিন্তু ক্রিকেটদেব ঠিক করে রেখেছিলেন, ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম দুই দলের একটিকে চরম লজ্জাতে ফেলবেন না। এমনকি কোনোভাবেই মাত্র ১৭ বছর আগে টেস্ট পরিবারের দশম দেশ হওয়া দলটিকেও দেবেন না নিজেদের হারিয়ে ফেলার মতো কোনোকিছু। যা দেবার তা তো মিরপুরে আগেই দিয়ে এসেছেন। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ২০ রানের ঐতিহাসিক প্রথম জয়ে ১-০ তে লিড নেওয়ার আবেগি গৌরব আর মর্যাদা। ইতিহাসের পাতায় ঢুকে পড়ে প্রবল হুঙ্কারে পয়মন্ত ভেন্যু চট্টগ্রামে এসে ম্যাচটিতে নাটাইটা তাই কখনোই দেওয়া হলো না স্বাগতিকদের হাতে। ভুলে তো কেউ যায়নি ফেব্রুয়ারি-মার্চে চার টেস্টের ভারত সফর জয় দিয়েই শুরু করেছিল স্টিভেন স্মিথের দল। ওটা ২-১ হারলেও স্পিনার লায়ন ও স্টিভেন ওকিফি ছিলেন উপমহাদেশের স্পিনারদের মতো দুর্দান্ত। কিফি ভাগ্যের জোরে ফিরে প্রথম ইনিংসে একটিও উইকেট পেলেন না হয়তো মানিয়ে নেওয়ার সময়টা মেলেনি বলে। টানা বাঁহাতির মিছিল ব্যর্থ হচ্ছে দেখে আগের ইনিংসে ৮ নম্বরে ব্যাট করে ৪৫ রান দিয়ে কিছুটা এগিয়ে নেওয়া নাসির হোসেনকে কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে নামিয়ে দেন চার নম্বরে। কিন্তু সেই ডানহাতিকে বাঁহাতি স্পিনার ওকিফ ম্যাচে নিজের দুই শিকারের প্রথমটি বানিয়ে ফেলেন। ৫ রান করে নাসির বিদায় নেওয়ার আগেই অবশ্য সাকিব আল হাসান (২) লায়নকে এই ইনিংসের তৃতীয় উইকেটটি দিয়ে এসেছেন। প্রতিরোধের গল্প তবু লেখার সম্ভাবনা তো থেকেই যায়। এমন উইকেটের আদর্শ খেলোয়াড় মুমিনুল হক থেকে যান ৮ নম্বরের জন্য। প্রথম ইনিংসের মতো অধিনায়ক মুশফিকুর রহীম মাটি কামড়ে পড়ে থাকার দায়িত্বটা তুলে নেন নিজেরই কাঁধে। সাব্বির এসে যোগ দিলে কিছু হয়, কিছু হতে পারে ভাবা যাচ্ছিল। কিন্তু লায়নের বল খেলা তখন সবার জন্যই যেন সাধ্যের অতীত। কিন্তু সাব্বির স্টাম্পড হয়েছেন যেভাবে সেটি প্রশ্ন রেখে গেছে। আর একটু চেষ্টায় ভেতরেই থাকতে পারতেন। ২৪ রান করে তার বিদায়ে ৬ উইকেটে ৯৭ রানের দল টাইগাররা। ম্যাচ সর্বোচ্চ ৫৪ রানের জুটিটা সাব্বির-মুশফিকের। ওই যে আশাই তো মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে মুশফিক টিকে আছেন। মুমিনুল যোগ দেন। কিন্তু চা বিরতির সময় ৮ উইকেটে ১৫৪ রান মানে বাকি আর কি থাকে? ৬১ বলে ২৯ রান করে তার আগেই মুমিনুল চলে গেছেন লায়নের টানা তৃতীয় ৫ উইকেটের শিকার হয়ে। মুশফিক ১০৩ বলে ইনিংস সর্বোচ্চ ২৯ রান করে তার আগেই পেসার প্যাট কামিন্সের দ্বিতীয় শিকার। বুড়ো আঙুলের চোট নিয়েই মেহেদী হাসান মিরাজ ১৪টা রান দিয়ে গেলেন। যদিও বল করতে পারলেন না। এমন হতচ্ছারা ব্যাটিংয়ের পর সাগরিকা থেকে সব স্বপ্নই তো বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়েছে। তবু যদি কিছু হয় বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের নিবেদন ও প্রয়োগ প্রশ্নবিদ্ধ যখন তখন বোলাররা অস্ট্রেলিয়ার ডেভিড ওয়ার্নার, ম্যাট রেনশ ও স্মিথকে ফেরাতে পারে। কিন্তু কখনোই ম্যাচে ফিরতে না পারা বাংলাদেশের ভাগ্যে শেষ পর্যন্ত টেস্টে ধারাবাহিক হওয়ার লড়াই চালিয়ে যাওয়ার শিক্ষাটা হয়ে থাকে ঈশপের গল্পের সারকথার মতো।
সংক্ষিপ্ত স্কোর : বাংলাদেশ প্রথম ইনিংস: ৩০৫/১০ (১১৩.২ ওভার) (তামিম ৯, সৌম্য ৩৩, ইমরুল ৪, মুমিনুল ৩১, সাকিব ২৪, মুশফিক ৬৮, সাব্বির ৬৬, নাসির ৪৫,মিরাজ ১১, তাইজুল ৯, মোস্তাফিজ ০*; লায়ন ৭/৯৪, অ্যাগার ২/৫২)
অস্ট্রেলিয়া প্রথম ইনিংস: ৩৭৭/১০ (১১৯.৫ ওভার) (রেনশ ৪, ওয়ার্নার ১২৩, স্মিথ ৫৮, হ্যান্ডসকম্ব ৮২, ম্যাক্সওয়েল ৩৮, কার্টরাইট ১৮, ওয়েড ৮, অ্যাগার ২২, কামিন্স ৪, ওকিফ ৮*, লায়ন ০; মিরাজ ৩/৯৩, মোস্তাফিজ ৪/৮৪, তাইজুল ১/৭৮, সাকিব ১/৮২)
বাংলাদেশ দ্বিতীয় ইনিংস : ১৫৭/১০ (৭১.২) ( তামিম ১২, সৌম্য ৯, ইমরুল ১৫, নাসির ৫, সাকিব ২, মুশফিক ৩১, সাব্বির ২৪, মুমিনুল ২৯, মিরাজ ১৪*, তাইজুল ৪, মোস্তাফিজ ০; লায়ন ৬/৬০, কামিন্স ২/২৭, ও’কিফি ২/৪৯)
অস্ট্রেলিয়া দ্বিতীয় ইনংস : ৮৬/৩ (১৫.৩ ওভার) (রেনশ ২২, স্মিথ ১৬, হ্যান্ডসকম্ব ১৬* ম্যাক্সওয়েল ২৫*; মোস্তাফিজুর ১/১৬, সাকিব আল হাসান ১/৩৫, তাইজুল ১/২৬)