বঙ্গবন্ধু ৭০-এর নির্বাচনী বক্তৃতাতেই একটি আধুনিক রাষ্ট্রের রূপরেখা তুলে ধরেন

588

<মাহফুজা জেসমিন>

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭০ সালের নির্বাচনী বক্তৃতায় একটি আধুনিক স্বায়ত্তশাসিত রাষ্ট্রের রূপরেখা তুলে ধরেছিলেন। সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে ২৮ অক্টোবর পাকিস্তান টেলিভিশন সার্ভিস ও রেডিও পাকিস্তান আয়োজিত ‘রাজনৈতিক সম্প্রচার’ শীর্ষক বক্তৃতামালার প্রথম বক্তা ছিলেন পাকিস্তান আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর নির্বাচিত বক্তৃতা ও বিবৃতির সংকলন ‘বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ’ বইয়ের সম্পাদক বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার এই বক্তৃতা সম্পর্কে বলেন, ‘পাকিস্তানের ইতিহাসে এটাই প্রথম ক্ষমতাসীনদের বাইরের রাজনীতিবিদরা রেডিও-টিভির মতো গণমাধ্যমে রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচারের সুযোগ পান।’ রামেন্দু মজুমদার এই বইতে ১৯৭০ সালের ২৮ অক্টোবর থেকে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর নির্বাচিত বক্তৃতা ও বিবৃতিগুলো পটভূমিসহ বাংলা এবং ইংরেজিতে সংকলন ও সম্পাদনা করেন। ১৯৭২ সালে প্রথম কলকাতার ওরিয়েন্ট লংম্যান প্রকাশনা থেকে ‘বাংলাদেশ মাই বাংলাদেশ’ নামে বইটি ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়। পরে ১৯৮৯ সালে ঢাকার কথন প্রকাশনী এর বাংলা সংকলন ‘বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ’ প্রকাশ করে। পরবর্তীতে মুক্তধারা ১৯৭২ সালের জুলাই এবং ২০১০ সালে এর দ্বিতীয় ও তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশ করে। বঙ্গবন্ধুর এই নির্বাচনী বক্তৃতাটি পূর্ব পাকিস্তানের শ্রোতাদের জন্য বাংলায় এবং পশ্চিম পাকিস্তানের শ্রোতাদের জন্যে ইংরেজিতে রেকর্ডিং করা হয়। পরের দিন বঙ্গবন্ধুর এই বক্তৃতা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের গণমাধ্যমগুলো ব্যাপকভাবে প্রচার করে। এই বক্তৃতার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুই প্রথমবারের মতো পাকিস্তানের গণমাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে ‘বাংলা’ নামে অভিহিত করেন। যা বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির সাথে সম্পর্কিত অনেক শব্দের মতই পাকিস্তান রেডিও-টিভিতে নিষিদ্ধ ছিল। ঐতিহাসিক এই বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বৈষম্যহীন, ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের রূপরেখা তুলে ধরেন। এতে তিনি পূর্ববাংলার স্বায়ত্বশাসনের পাশাপাশি এদেশের জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির পথও নির্দেশ করেন। তিনি কৃষি, শিক্ষা, বিদ্যুৎ ও স্বাস্থ্যসহ অর্থনৈতিক উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলো সম্পর্কেও তাঁর পরিকল্পনা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার প্রয়োজন মেটানোর জন্যে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধনের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।’ বঙ্গবন্ধু বন্যা নিয়ন্ত্রণ, সবার জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিতকরণ এবং পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা’র উন্নয়নকে অর্থনৈতিক মৌলিক ভিত্তির প্রথম তিনটি স্তম্ভ হিসেবে উল্লেখ করেন। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বন্যা নিয়ন্ত্রণ অবশ্যই প্রথম কর্তব্য হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। জরুরী অবস্থার ভিত্তিতে একটি সুসংহত ও সুষ্ঠু বন্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির বাস্তবায়ন করা আশু প্রয়োজন।’ তিনি বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নয়নকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় উল্লেখ করে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প নির্মাণের জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি ও গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করার তাগিদ দেন। তিনি বলেন, সমবায়ের মাধ্যমে ক্ষুদ্রাকৃতির শিল্প গড়ে তুলতে হবে। গ্রামে গ্রামে এসব শিল্পকে এমনভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে, যার ফলে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে বিভিন্ন প্রকার শিল্প সুযোগ পৌঁছায় এবং গ্রামীণ মানুষের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নকে তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করে তিনি উত্তরবঙ্গের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য যমুনা সেতু নির্মাণের আশা প্রকাশ করেন। তাঁরই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরে এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেন। বঙ্গবন্ধু এই বক্তৃতায় কেন্দ্রিভূত অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা এবং কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্রে মাত্র ১৫ শতাংশ বাঙালী প্রতিনিধিত্বের কঠোর সমালোচনা করে এর পুনর্বিন্যাসের দাবি জানান। জাতির জনক গ্রাম ও শহরের উন্নয়ন বৈষম্য দূর করতে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টির ওপর জোর দেন। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের বিকাশে তিনি কুটির শিল্পের কাঁচামাল সরবরাহ, বাজারজাতকরণ ও ঋণদানের সুবিধা দেয়ার প্রস্তাব করেন। বঙ্গবন্ধু কৃষির আধুনিকায়নকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে তিনি কৃষকদের হাতে প্রয়োজনীয় কৃষি যন্ত্রপাতি, সার, ও বীজ সরবরাহ এবং কৃষি ঋণ দেয়ার সুপারিশ করেন। এই বক্তৃতায় তিনি ২৫ বিঘা পর্যন্ত কৃষি জমির খাজনা বিলোপ এবং বকেয়া খাজনা মওকুফ করার প্রস্তাব করেন। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী শেখ মুজিবুর রহমান শিক্ষাখাতে বিনিয়োগকে ‘উৎকৃষ্ট বিনিয়োগ’ আখ্যা দিয়ে জাতীয় উৎপাদনের শতকরা কমপক্ষে ৪ ভাগ সম্পদ শিক্ষাখাতে বরাদ্দ দেয়ার প্রস্তাব করেন। তিনি স্কুল, কলেজ এবং বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি করার সুপারিশ করেন। তিনি পাঁচ বছর বয়স্ক শিশুদের বাধ্যতামূলক অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা এবং স্বল্পমূল্যে সবার জন্য মাধ্যমিক শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করার প্রস্তাব করেন। দেশে মেডিকেল ও কারিগরী বিশ্ববিদ্যালয়সহ নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ওপরও জোর দেন। দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির বিষয়টিও তিনি নজরে আনেন।বঙ্গবন্ধু সবার জন্য চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে ‘পল্লী চিকিৎসা কেন্দ্র’ নির্মাণের প্রস্তাব করেন। তিনি বলেন, ‘প্রতি ইউনিয়নে একটি করে পল্লী চিকিৎসা কেন্দ্র এবং প্রতি থানা সদরে একটি করে হাসপাতাল অবিলম্বে স্থাপনের দরকার।’ তিনি চিকিৎসা গ্রাজুয়েটদের জন্য ‘ন্যাশনাল সার্ভিস’ প্রবর্তন এবং পল্লী এলাকার জন্য বিপুল সংখ্যাক প্যারা মেডিকেল পার্সোনেলদের ট্রেনিং দেয়ার সুপারিশ করেন। জাতির পিতার দেখানো পথ অনুসরণ করেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশেষ ১০টি উদ্যোগের মধ্যে কমিউনিটি ক্লিনিক ও মানসিক স্বাস্থ্যকে অন্তর্ভূক্ত করেন। বর্তমানে ১৬ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে সারাদেশে হাজার হাজার মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হচ্ছে।