বঙ্গবন্ধুকে কারা, কেন হত্যা করেছিল

736

<মুহম্মদ শফিকুর রহমান>

বঙ্গবন্ধুকে কারা হত্যা করেছে, কেন করেছে এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য এখন আর গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রয়োজন নেই। সবই এখন দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। হত্যাকারীরা দুটি গ্রুপে বিভক্ত ছিল- একটি হলো পরাজিত এবং নাকে খত দিয়ে আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তান মিলিটারি জান্তার গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এবং তাদের প্রভু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও দ্বিতীয় গ্রুপটি হলো আইএসআই ও তাদের প্রভুর ভাড়া করা বাঙালী চেহারার খুনী। পাকিস্তান ১৯৭১ সালে বলেছিল- ‘মাশরেকি পাকিস্তান মে হামকো মিট্টি চাহিয়ে, আদমি নেহি। জরুরত হো-তো মিট্টিকো ভি তামা বানাদো।’ এই নির্দেশ তারা বাস্তবায়ন করতে পারেনি, আর তাই ’৭১-এর ১৩-১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যা করা হয়েছিল বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও যেন মেধা শূন্যতায় আক্রান্ত হয়। হলো না। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে, যেখানে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ দেন, যেখানে এখন স্বাধীনতা ম্ভম্ভ, হানাদাররা সেখানে আত্মসমর্পণ করে। কিন্তু চক্রান্ত থেমে থাকেনি। সেদিন থেকেই ভাড়াটিয়া খুনী রিক্রুট করা শুরু হয়। রিক্রুট করা খুনী হলো খন্দকার মোশতাক, মিলিটারি জিয়াউর রহমান, মিলিটারি ফারুক, মিলিটারি বজলুল হুদা, মিলিটারি রশীদ, মিলিটারি নূর, মিলিটারি ডালিম, মিলিটারি পাশা ও অন্যারা। এর মধ্যে কয়েকজনের মৃত্যুদ- কার্যকর হয়েছে, কয়েকজন এখনও ফেরারি। এদের শাস্তি ভোগ থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। মোশতাকের সহযোগী মাহবুব আলী চাষী যেমন মরুভূমিতে গাড়িতে মরেছিল, খুনীরা যতই বিদেশে পলাতক থাকুক তাদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর হবেই, তাদেরও অস্বাভাবিক মৃত্যু হবে, হয়ত চাষীর মতো। তবে মিলিটারি জিয়ার স্কুল-কলেজ ড্রপ আউট স্ত্রী-পুত্র এখনও বাংলাদেশে এবং লন্ডনে আইএসআই’র ভাড়াটিয়া হিসেবে চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছে। হলে কি হবে? বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া স্বাধীনতার শক্তি অমোঘ, একে রুখতে পারে কেউ নেই। মিলিটারি জিয়াউর রহমানের পুত্র তারেক রহমান দুর্নীতির মামলার বোঝা মাথায় নিয়ে লন্ডনে পলাতক রয়েছে প্রায় এক দশক। সেখানে বসে মাঝে-মধ্যে এমন সব জ্ঞানদান করে যেগুলো কেবল মূর্খই করতে পারে এবং করছেও। অবশ্য লন্ডনে পলাতক মিলিটারি জিয়ার গ্যাং ছাড়াও রয়েছে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী। তারা বাংলাদেশ ও সরকারের বিরোধী কিছু লেখা লিখে দেয়, তারেক হোটেল ভাড়া করে সেগুলো বলে দেয় এবং তাদের বশংবদ দেশী-বিদেশী কিছু মিডিয়া তা প্রচার করে। ওই সব মিডিয়াও চলে যুদ্ধাপরাধী ও আইএসআইর পয়সায় এটি এখন ওপেন সিক্রেট। যেমন তারেক স্ত্রী-সন্তান নিয়ে লন্ডনের পশ এরিয়ায় বসবাসও করে সেই একই সোর্সের অর্থে। এটিও ওপেন সিক্রেট। এখন যে ব্যাপারটি বাংলাদেশে বেশি আলোচিত হচ্ছে তা হলো মিলিটারি জিয়া পতী বেগম খালেদা জিয়া এখন লন্ডনে কেন? বলা হচ্ছে চিকিৎসার জন্য। তাহলে ব্যাঙ্কক, সিঙ্গাপুর বা মার্কিন মুল্লুকে নয় কেন? এ জন্য যে, হাওয়া ভবন, খোয়াব ভবন বা খাম্বা দুর্নীতি বা আত্মসাত করা এতিমের টাকা তো দেশে রাখা ছিল ঝুঁকির ব্যাপার। তবে সেই টাকা যে এখনও ছিটানো হচ্ছে তার আলামত দেখা যাচ্ছে বেশ কিছুদিন থেকে। যাদের চোখ-কান খোলা আছে তারা স্বাভাবিক দৃষ্টিতে সব দেখছেন। আর সে কারণেই সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের তথাকথিত সুশীল সমাজ, সুশীল মিডিয়া বেশ তৎপর হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের একটি রায়ের পর এই শক্তিগুলো যেন হালে পানি পেয়েছে। তাদের লাফালাফি বেড়ে গেছে। এই লেখা যখন লিখছি তখন তোপখানা রোড থেকে কানে এলো জিয়া জিয়া, খালেদা খালেদা। এতদিন জাতীয় প্রেসক্লাবের হল ভাড়া করে কথা বলত, এখন রাজপথে নামা শুরু করেছে। আরও অশালীন, অভব্য ও কদর্য ব্যাপার হলো দুর্নীতির মামলায় লন্ডন পলাতক জিয়া তনয় আমাদের স্বাধীনতার মহান স্থপতি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী ও বাংলাদেশ জাতি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা পিতা সম্পর্কে কটাক্ষ করার ধৃষ্টতা প্রদর্শন। কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশন পরবর্তী একাদশ সংসদ নির্বাচনকে ফ্রি ফেয়ার ও ক্র্যাডিবল করার জন্য সংলাপ শুরু করেছে। বিএনপি এতদিন কেবল সংলাপ সংলাপ করে গলা ফাটাচ্ছিল, নির্বাচন কমিশন তা বাস্তবায়ন করছে। করুক, ভাল কথা। প্রথমেই দেখলাম বাংলাদেশে মিলিটারি শাসনের লাঞ্চ-ডিনারে জন্ম নেয়া সুশীল সমাজের সঙ্গে সংলাপ করেছে। একটি প্রভাবশালী জাতীয় দৈনিকে সংলাপ বৈঠকের যে ছবিটি ছেপেছে তা তিন শ’ আসনের পার্লামেন্টের কম নয় বলে মনে হলো। কারা এই সুশীল সমাজ, কে তাদের কোর্স করাল, কে সার্টিফিকেট দিল তা কেউ জানে না। তবে দেশের মিলিটারি প্রভাবিত কোন সরকার এলে তাদের স্যুট টাই শাড়ি সংগ্রহে ব্যাঙ্কক-সিঙ্গাপুর-কলকাতা দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে যায়। সচিবালয়ের কেরানিও তখন সুশীল হওয়ার জন্য লম্ফঝম্প শুরু করে। আমার এক বন্ধু এদের নাম দিয়েছেন ‘পরগাছা’। তারা শক্ত বৃক্ষ আঁকড়ে ধরার জন্য নির্বাচনে মিলিটারি নামানোর প্রস্তাব দিচ্ছে। যে বিশাল সুশীল বাহিনী নিয়ে সিইসি সংলাপে বসলেন এরা জনগণের কাছে এত চেনা যে, তাদের কোন প্রস্তাবই জনগণের মনে দাগ কাটবে না। আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সুশীল আসিফ নজরুল, তার কথায় বা প্রস্তাবে বিএনপি-জামায়াত খুশি হতে পারে, আর কেউ নয়। কিংবা দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, হাফিজউদ্দিন খান, সুলতানা কামাল, হোসেন জিল্লুর রহমান অতীতে এই মহারথীগণ জাতিকে অনেক জ্ঞান দিয়েছেন, ভবিষ্যতে আরও দেবেন, অশ্বডিম্ব না অন্য কিছু এ প্রশ্ন সাধারণ নাগরিকদের। এখন আগস্ট মাস। শোকের মাস। লিখতে বসেছিলাম ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কি ঘটেছিল এবং স্বাধীন বাংলাদেশ কি হারিয়েছিল? এক কথায় যদি বলতে হয় তবে বলব, স্বাধীন বাংলাদেশের অগ্রগতির ধারা লুণ্ঠিত হয়েছিল। সেদিন ১৫ আগস্ট না ঘটলে বা জাতির পিতাকে হত্যা না করলে এতদিন অপেক্ষা করতে হত না। ১০ বছরের মধ্যে আজকের মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতাম আমরা। এটি যারা বোঝে না বা যারা জাতির পিতাকে চেনে না বা জাতির একজন হিসেবে যে ‘প্রাইড’ তা ধারণ করতে পারে না, সে হতাভাগা, তাকে শুধু করুণাই করা যায়। মিলিটারি জিয়া পরিবার তো করুণারও অযোগ্য। মিলিটারি বা দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনী আমাদেরই কারও বাবা, কারও ভাই, কারও বোন বা কারও সন্তান। কথায় কথায় তাদের নামানোর প্রস্তাব কেন? ব্রিটিশরা এ দেশ থেকে চলে যাবার পর পাকিস্তানের ২৩ বছরের মধ্যে অল্প ক’দিন ছাড়া পুরোটাই এবং বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ২১ বছর এই মিলিটারি শাসন ছিল। নাগরিকদের ঘরে ‘ডিভিডেন্ট’ গেছে তা যারা বিশ্বাস করে তারা মিলিটারির উচ্ছিষ্টভোগী। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত শেখ হাসিনা ক্ষমতায় গেলে দেশ এগিয়ে যায়, মানুষ স্বপ্ন দেখতে শেখে, স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার ক্ষমতা অর্জন করে, দেশ এগিয়ে চলে।শোকের মাস আগস্ট এলে তাই আরও বেশি মনে পড়ে জাতির পিতার কথা। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসবেন। সিপিবির বর্তমান সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম তখন ডাকসুর ভিপি। আগের দিন থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাজানো হচ্ছিল। এই সেই বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে ১৯৪৮ সালে বঙ্গবন্ধুকে বহিষ্কার করা হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবার অজুহাত তুলে। বঙ্গবন্ধু তখন আইন বিভাগের ছাত্র ছিলেন। ভারত বিভাগের বছর ১৯৪৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েশন ডিগ্রী নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ভর্তি হন। হাইস্কুল জীবন থেকেই ছিলেন রাজনীতিক, তাই কর্মচারীদের আন্দোলন থেকে দূরে থাকতে পারেননি। এক পর্যায়ে তাঁকে গ্রেফতার করা হলো। বলা হলো মুচলেকা দিলে কিছু জরিমানা করা হবে এবং জেল থেকে মুক্ত হবেন, ছাত্রত্বও বাঁচবে, নইলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার হতে হবে। বঙ্গবন্ধু মুচলেকা এবং জরিমানা দিতে অস্বীকার করলেন, মাথা নোয়ালেন না। তখন রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলনেও অংশ নিচ্ছিলেন। কিছুতেই মাথা নোয়ালেন না। ছাত্রত্ব হারালেন, তবুও না। সেই বিশ্ববিদ্যালয়েই আসবেন। ডাকসু ও ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন নেতাকর্মীরা ব্যস্ত। তাদের মধ্যে যাকে দেখা গেল ক্যাম্পাস সাজাবার কাজে সাধারণ কর্মীর মতো কাজ করছে সে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠপুত্র শেখ কামাল। তখন ছাত্রলীগ কর্মী ছিলেন। ইত্তেফাকের রিপোর্টার হিসেবে রাত ১২টা পর্যন্ত ক্যাম্পাসে ছিলাম। তারপর নিউজ আপডেট করে বাসায় চলে যাই। সে নিউজ আর আলোর মুখ দেখেনি। খুনীরা তার আগে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে দেশকে অন্ধকারে ঠেলে দেয়। এই শেখ কামাল মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। শেখ জামালও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। শেখ রাসেল শিশু ছিল, প্রাপ্ত বয়স্ক হলে সেও যুদ্ধে যেত।আজ সবই স্মৃতি। শেখ কামালকে বেশি করে মনে পড়ছে। জাতির পিতার সন্তান, সরকার প্রধান বা রাষ্ট্রের এক নম্বর নাগরিক বাবা, সমস্ত ক্ষমতা তাঁর হাতে তবুও হাওয়া ভবন-খোয়াব ভবন, ডান্ডি ডাইং কোকো ওয়ান-টু বানাননি। বরং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী নিয়েছেন, বানিয়েছেন আবাহনীর মতো আধুনিক ফুটবল ক্রীড়াচক্র। বানিয়েছেন থিয়েটার, সঙ্গীত সংগঠন ইত্যাদি। সে সময় এমন উদ্যমী, এমন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন তরুণ বেশি ছিল না। ওকে তো শ্রদ্ধা করতেই হয়। বস্তুত বঙ্গবন্ধুর সন্তান এবং পৌত্র-পৌত্রীরা একেকজন শেখ কামালের মতোই। স্কুল-কলেজ ড্রপ-আউটরাই কেবল তাদের কটাক্ষ করতে পারে। লেখাপড়া না থাকলে যা হয় তা-ই।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও সভাপতি, জাতীয় প্রেসক্লাব