পশু বিক্রেতাদের দুশ্চিন্তা দূর হচ্ছে খুলে দেয়া হচ্ছে কোরবানির হাট

95

করোনা ভাইরাস অর্থনৈতিকভাবে চাঁপাইনবাবগঞ্জকে পঙ্গু করে দিচ্ছে। করোনার কারণে আমচাষি ও ব্যবসায়ীরা চরমভাবে ক্ষতিগস্ত হয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন জেলার সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ। বিপাকে পড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষ। বাইরের পাইকাররা আসতে না পারায় গতবছরের মতো এবারো আমের দাম পেল না আমচাষি ও ব্যবসায়িরা। এর ফলে কোটি কোটি টাকার ক্ষতির মুখে পড়বে তারা।
আমচাষিদের মতো পশুখামারিরা যেন বিপাকে না পড়ে এবং জেলাবাসী যেন ঠিকভাবে পশু কোরবানি দিতে পারেন সেই লক্ষে খুলে দেয়া হয়েছে পশুর হাট। তবে নির্ধারিত হাটের আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে হাট বসাতে হবে। কঠোরভাবে মানতে হবে স্বাস্থ্যবিধি।
গতকাল পশুর হাট পরিচালনার জন্য জেলা করোনা প্রতিরোধ কমিটির সঙ্গে সংসদ সদস্য, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও পৌরসভার মেয়রসহ সকল অংশীজনের মতবিনিময় সভায় এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
করোনা প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক মঞ্জুরুল হাফিজ বলেন- গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জেলার অর্থনৈতিক কর্মকান্ড সচল রাখতে জনপ্রতিনিধি ও জেলা করোনা প্রতিরোধ কমিটির মতামতের ভিত্তিতে আসন্ন পবিত্র ঈদুল আযহা উপলক্ষে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় গরুর হাট পরিচালনার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ইজারাকৃত নির্ধারিত পশুর হাট নির্দিষ্ট স্থানে না রেখে পাশাপাশি নিকটবর্তী কমপক্ষে দুটি স্থানে স্থানান্তরিত করতে হবে। সেক্ষেত্রে ইজারাদার মূল হাট হতে স্থানান্তরিত হাটগুলো থেকেও ইজারার অর্থ আদায় করতে পারবেন।
তিনি বলেন- হাটে আগত প্রতিটি মানুষের স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন নিশ্চিত করে কমপক্ষে ৫ ফুট দূরত্ব বজায় রেখে খুঁটি স্থাপন করে ওই খুঁটিতে পশু বেঁধে ইজারাদারগণ গরুর হাট পরিচালনা করবেন এবং স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনের ব্যর্থতায় ওই হাট বন্ধ করে দেয়া হলে ইজারাদারদের কোনো আপত্তি থাকবে না মর্মে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে হাট পরিচালনার পূর্বেই লিখিত অঙ্গীকারনামা প্রদান করতে হবে। প্রতিটি পশুর হাটের প্রবেশপথ ও বাহিরপথ নির্দিষ্ট করতে হবে। একটি পশু থেকে আরেকটা পশু এমনভাবে রাখতে হবে যেন ক্রেতাগণ কমপক্ষে ৫ ফুট দূরত্ব বজায় রেখে পশু ক্রয় করতে পারেন।
জেলা প্রশাসক বলেন, হাট ইজারাদার কর্তৃক হাট বসানোর আগে কোভিড-১৯ প্রতিরোধী মাস্ক, সাবান, জীবাণুমুক্তকরণ সামগ্রী ইত্যাদি সংগ্রহ করতে হবে। পরিষ্কার পানি সরবরাহ ও হাত ধোয়ার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে তরল সাবান / সাধারণ সাবানের ব্যবস্থা রাখতে হবে। নিরাপদ বর্জ্য নিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। স্বাস্থ্যবিধিসমূহ সার্বক্ষণিক মাইকে প্রচার করতে হবে। ভিড় এড়াতে মূল্য পরিশোধ ও হাসিল আদায় কাউন্টারের সংখ্যা বাড়াতে হবে।
জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত ওই সভায় চাপাইনবাবগঞ্জ-৩ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ সভাকে জানান, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে চলতি আম মৌসুমে জেলার আম ব্যবসায়ীরা আশানুরূপ ব্যবসা করতে পারেননি। আসন্ন পবিত্র ইদুল আযহা উপলক্ষে পশু কোরবানির হাট বসানো না হলে জেলার অনেক খামারি ও কৃষক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। তাদের ক্ষতির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে কোরবানি পশু বিক্রয়ের সুযোগ প্রদান করা প্রয়োজন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় প্রতি বছর সদর উপজেলার বটতলাহাট, শিবগঞ্জ উপজেলার তর্তীপুর হাট ও নাচোল উপজেলার সোনাইচন্ডী হাটে কোরবানি পশু হাট বসানো হয়। করোনা সংক্রমণ বিস্তার রোধে এবং জেলার বর্তমান করোনা নি¤œমুখী সংক্রমণ বজায় রাখতে হাটগুলোকে মূল হাটের জায়গার পাশাপাশি কয়েকটি উন্মুক্ত জায়গায় ছড়িয়ে দেয়া যেতে পারে বলে সভাকে অবহিত করেন তিনি।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ (শিবগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য ডা. সামিল উদ্দিন আহমেদ শিমুল সভাকে জানান, করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে আমের বাজার স্থাপনের পর যেভাবে নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল কোরবানি পশুর হাট বসানোর ক্ষেত্রেও একইভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পশু হাট বসানোর পরে করোনা সংক্রমণ যাতে কোনোভাবেই বিস্তার লাভ করতে না পারে সে বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তিনি আরো জানান, যদি স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন নিশ্চিত করে ইজারাদারগণ হাট পরিচালনা করতে না পারে তাহলে কোনো রকম পূর্ব নোটিশ ছাড়াই সেই হাট বন্ধ করে দেয়া হবে মর্মে ইজারাদারদের নিকট হতে লিখিত নিতে হবে।
সংরক্ষিত মহিলা আসন-৩৩৮, চাঁপাইনবাবগঞ্জ’র সংসদ সদস্য ফেরদৌসী ইসলাম জেসি সভাকে জানান, প্রতিটি ইউনিয়নে কিছু নির্দিষ্ট স্থানে বিক্রয়যোগ্য কোরবানি পশু রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট স্থানের জামে মসজিদ বা মাইকিংয়ের মাধ্যমে ওই স্থানে পশু বিক্রয়ের বিষয়টি অবহিত করা যেতে পারে। এরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে লোকজনকে দূরবর্তী হাটে গিয়ে গরু ক্রয়-বিক্রয় করতে হবে না। ফলে হাটসমূহে জনসমাগম কিছুটা কম হবে এবং করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া রোধ করা সম্ভব হবে বলে তিনি সভাকে জানান।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের সিভিল সার্জন সভাকে জানান, জেলায় সকল ধরনের পরীক্ষায় জুন মাসে সংক্রমণের গড় হার ১৭.৭৯% এবং জুলাই মাসে ১৫.০৫%। তিনি জানান, বর্তমানে করোনা সংক্রমণের হার নি¤œমুখী এবং এ ধারা অব্যাহত রাখাই আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। আসন্ন ঈদুল আযহা উপলক্ষে কোরবানি পশু হাটসমূহে স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন নিশ্চিতকল্পে সকলকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে মর্মে সভাকে জানান।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার মেয়র মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম জানান, একটি নির্দিষ্ট হাটকে বিভিন্ন জায়গায় স্থানান্তরিত করা হলে হাট ব্যবস্থাপনা করা কঠিন হয়ে পড়বে এবং হাটসমূহে স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। তিনি জানান, গরু ও ছাগলের হাট পৃথক পৃথক স্থানে বসানো গেলে জনসমাগম কিছুটা হ্রাস করা সম্ভব হবে। এছাড়া প্রতিটি হাটের রাস্তায় মাইকিংয়ের মাধ্যমে মাস্ক পরিধান ব্যতীত হাটে প্রবেশ না করার জন্য এবং স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন করে পশু ক্রয় করতে আহ্বান জানানো যেতে পারে।
শিবগঞ্জ পৌরসভার মেয়র সভাকে অবহিত করেন, শিবগঞ্জ উপজেলা তর্তীপুর হাটের পাশে একটি বৃহৎ বালুর মাঠ রয়েছে, যেখানে গরুর হাট স্থানান্তরের যাবতীয় কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। গরুর হাটে স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন নিশ্চিত করতে স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করা হয়েছে। যারা মাস্ক ও স্যানিটাইজার বিতরণ করবে। এছাড়া পৌরসভা থেকে ভিজিলেন্স টিম গঠন করা হয়েছে যারা সার্বক্ষণিক হাট পর্যবেক্ষণ করবেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের পুলিশ সুপার সভাকে জানান, কোরবানির পশু হাটসমূহে ব্যাংকিং সিস্টেমসহ আর্থিক বিষয় সংশ্লিষ্ট থাকায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যাপক কর্মযজ্ঞ পরিচালনা করতে হয়। কোরবানি পশু হাটগুলো একাধিক স্থানে স্থানান্তরিত করা হলে করোনা সংক্রমণ রোধ করা গেলেও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা অনেকটা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে। বড় হাটগুলোতে বাঁশ দিয়ে ঘিরে একদিকে প্রবেশ এবং অপরদিক দিয়ে বের হওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। পাশাপাশি ৫ ফুট দূরত্বে গরু বেঁধে রাখার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এছাড়া পশুর হাটে জনসমাগম হ্রাস করতে নির্ধারিত দিনের অতিরিক্ত দিনে হাট বসানো যেতে পারে মর্মে সভাকে অবহিত করেন তিনি।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মোস্তাফিজুর রহমান গৌড় বাংলাকে জানান, জেলায় ১৩ হাজার ১৬২ জন ছোটবড় খামারি রয়েছেন। যারা ঈদুল আযহাকে সামনে রেখে ১ লাখ ৬৩ হাজার ১৮৬টি গরু, ছাগল, মহিষ, ভেড়া ও গাড়ল লালন-পালন করেছেন। কোরবানিযোগ্য ষাঁড় রয়েছে ৩৫ হাজার ৬২৫টি, বলদ ২৫ হাজার ৮২০টি, গাভী ২৪ হাজার ৩৮৩টি, ছাগল ৫০ হাজার ১৫৫টি, গাড়ল ও ভেড়া ২১ হাজার ২১টি, মহিষ ৬ হাজার ১৭৯টি এবং অন্যান্য ৩টি। এছাড়াও বাড়িতে বাড়িতে অনেকেই ১টি বা ২টি করে গরু-ছাগল লালন-পালন করেছেন। তিনি জানান, সবমিলিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জে কোরবানির পশুর চাহিদা হচ্ছে ১ লাখ ৩ হাজার ৭৭৮টি। পালিত এইসব পশুর মধ্যে একটি বড় অংশ জেলার বাইরে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে চলে যায় বলে তিনি জানান।
শিবগঞ্জের এক গরু ব্যবসায়ী এবার ইদুল আযহাকে সামনে রেখে ১১০টি বড় সাইজের বলদ লালন-পালন করেছেন। তিনি এখনো আশাবাদী যে, ঢাকার বাজারে গরুগুলো বিক্রি করতে পারবেন।
অন্যদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর এলাকার ইকবাল হোসেন নামে এক খামারি জানান, এবার তিনি ঈদুল ফিতরের আগেই অধিকাংশ গরু বিক্রি করে দিয়েছেন। তবে এখনো ১৫টি গরু আছে। এই গরুগুলো বিক্রি নিয়ে চিন্তায় রয়েছেন।
এদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জে উন্নয়ন সংস্থা প্রয়াস মানিক উন্নয়ন সোসাইটি গড়ে তুলেছে ডেইরি ফার্ম। এই ফার্মে লিফট প্রকল্পের আওতায় এবার কোরবানির উপযোগী ১০টি ষাঁড় রয়েছে। যেগুলোর দাম ৭০ হাজার টাকা করে। এ তথ্য জানিয়েছেন সংস্থাটির প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. রাজিন বিন রেজাউল।