পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি সর্ম্পকে সকলকে জানতে হবে

710

<শাহরিয়ার হোসেন শিমুল>

 

পরিবার পরিকল্পনা মানে শুধু জনসংখ্যা কমানো নয়, সামগ্রিক জীবনকে পরিকল্পিতভাবে চালানোর পরিকল্পনাই পরিবার পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্য।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, সুদৃঢ়ভাবে পরিকল্পিত পারিবারিক কাঠামো গড়ে তোলার জন্য স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার দ্বারা জন্ম নিয়ন্ত্রণ বা গর্ভবিরতি করণের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। অনেক ধরনের নিরাপদ এবং কার্যকর জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি প্রচলিত আছে। তবে এখনো সচেতনতার অভাবে সঠিক সময়ে অনেক দম্পতি সঠিক পদ্ধতি নিতে পারে না বলে পড়তে হয় নানান জটিলতায়। পরিবার পরিকল্পনার আধুনিক পদ্ধতিগুলো গ্রহণের মধ্যে আমাদের দেশের বেশিরভাগ নারী খাবার বড়ি এবং পুরুষরা কনডম বেশি ব্যবহার করে থাকেন। আজ যারা কিশোর-কিশোরী পরবর্তীতে তারাই হবে দম্পতি, তাই পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি সম্পর্কে আমাদের সকলের জানা উচিত।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার একমাত্র কমিউনিটি রেডিও, রেডিও মহানন্দার আয়োজনে গত ২ জুলাই কিশোর-কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনার পদ্ধতি বিষয়ে সদর উপজেলার রানীহাটি ইউনিয়নের কৃষ্ণগোবিন্দপুর মিঞা পাড়া কমিউনিটি ক্লিনিকে ২২জন কিশোরী ও দম্পতিদের নিয়ে একটি উঠান বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে কিশোর-কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন, পরিবার পরিকল্পনার পদ্ধতিগুলো বিশেষ করে দীর্ঘ মেয়াদী পদ্ধতি ও স্থায়ী পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। রানীহাটি ইউনিয়নের পরিবার পরিকল্পনার পরিদর্শক মো. মানিক আলী পরিবার পরিকল্পনার পদ্ধতিগুলো নিয়ে আলোচনা করেন। এসময় দীর্ঘ মেয়াদী পদ্ধতি সম্পর্কে তিনি বলেন-বর্তমানে বাংলাদেশে কপার-টি ৩৮০ অ ব্যবহার করা হয়। আইইউডি একটানা দশ বছরের জন্য কার্যকর। স্বাভাবিক প্রসবের ৪৮ ঘন্টার মধ্যে অথবা সিজারিয়ান অপারেশনের সময় আইইউডি গ্রহণ করা যায়। আইইউডি ব্যবহার করতে কোনো সমস্যা মনে হলে যে কোন সময়ে ক্লিনিকে/স্বাস্থ্য কেন্দ্রে গিয়ে খুলে নেয়া যায়। এসময়ে তিনি আরো বলেন, নারীদের জন্য অস্থায়ী দীর্ঘমেয়াদি পদ্ধতির নাম ইমপ্ল্যান্ট। এ পদ্ধতিটি বর্তমানে বেশি নিচ্ছে নব দম্পতিরা। এ পদ্ধতি হচ্ছে একটি বা দুটি নরম চিকন ক্যাপসুল যা দেয়াশলাই এর কাঠির চেয়ে ছোট। নারীদের হাতের কনুইয়ের উপরে ভিতরের দিকে চামড়ার নিচে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। মাসিকের প্রথম ৫-৭দিনের মধ্যে ইমপ্ল্যান্ট নিতে হবে। এ পদ্ধতি ৩/৫ বছরের জন্য কার্যকর। যেকোন পদ্ধতি গ্রহণ করার সময় ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী গ্রহণ করবেন।
বর্তমানে চাঁপাইনবাবগঞ্জে পরিবার পরিকল্পনার হার বেড়েছে, এখন অনেকে সচেতন। সরকারি কর্মসূচির পাশাপাশি কিশোর-কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা এবং পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি সম্পর্কে এখন কাজ করছে কমিউনিটি রেডিওগুলো। গত ৮ সেপ্টেম্বর সদর উপজেলার বালিয়াডাঙ্গা ইউনিয়নের শ্রীরামপুর কমিউিনিটি ক্লিনিকে পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক আব্দুস সামাদ বলেন-জন্ম নিয়ন্ত্রণের জন্য বেশ কিছু পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে স্থায়ী পদ্ধতি আর অস্থায়ী পদ্ধতি। নারীদের ক্ষেত্রে স্থায়ী পদ্ধতি হচ্ছে টিউবেকটমি (লাইগেশন)। এ পদ্ধতি হচ্ছে একটি সহজ অপারেশন। যে কোন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে এ পদ্ধতির সেবা প্রদান করা হয়ে থাকে। যে সকল সক্ষম দম্পতির দুটি জীবিত সন্তান আছে এবং ছোটটির বয়স কমপক্ষে এক বছর অতিক্রান্ত হয়েছে সেটা তাদের জন্য প্রযোজ্য। তিনি আরো বলেন টিউবেকটমি অপারেশন করতে সময় লাগে মাত্র ১৫-২০ মিনিট। এর কোন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই। অনেক ধরণের নিরাপদ এবং কার্যকর জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি প্রচলিত আছে। কোনো পদ্ধতি গ্রহণ করার আগে বিভিন্ন পদ্ধতি সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে নেওয়া প্রয়োজন। বিভিন্ন পদ্ধতি সম্পর্কে গ্রহীতাদের যখন একটা স্বচ্ছ ধারণা হবে, তখনই তাদের পক্ষে একটি পদ্ধতি বেছে নেয়া সহজ হবে। বৈঠকে ২৫ জন কিশোরী ও দম্পতিরা অংশগ্রহণ করেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার বারোঘরিয়া ইউনিয়নের পরিবার পরিকল্পনার পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক পা-ব কুমার সিংহ বলেন অনেকের ভুল ধারনা আছে যে পুরুষরা যদি স্থায়ী পদ্ধতি নেয় তাহলে তাদের ক্ষমতা কমে যায়, এবং সামাজিক ভয় বা কুসংস্কার থেকে তারা এটা গ্রহণ করে না। আসলে এটা একদম ঠিক না। কোন দম্পতির যদি একের অধিক সন্তান থাকে তাহালে সেই পুরুষ স্থায়ী পদ্ধতি এনএসবি নিতে পারবে। পা-ব কুমার সিংহ আরো বলেন, বারোঘরিয়া ইউনিয়নে প্রতি মাসে একটি করে বিশেষ ক্যাম্পইনের ব্যবস্থা করা হয় যেখানে দীর্ঘমেয়াদী ইমপ্ল্যান্ট আইইউডির সেবা দেয়া হয়। তিনি আরো বলেন বারোঘরিয়া ইউনিয়নে স্থায়ী সেবাগ্রহীতার হার হচ্ছে ৭.১ থেকে ২ শতাংশ। তবে আমরা প্রতিনিয়ত তাদের পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা দিয়ে থাকি। রেডিও মহানন্দা ৯৮.৮ এফএম পরিবার পরিকল্পনার বিভিন্ন বিষয়গুলো নিয়ে সচেতন করতে এবং তাদের পদ্ধতি গ্রহণে উদ্ধুদ্ধ করতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন এবং গ্রামে গিয়ে এই প্রচারনা চালানো হচ্ছে। এছাড়াও তারা সেখানে বিভিন্ন পদ্ধতি সম্পর্কে লিফলেট বিতরণ করা হয়। ইউকে ডিপার্টম্যান্ট ফর ইন্টারন্যাশানাল ডেভেলপম্যান্ট (ডিএফআইডি) অর্থয়ানে, আইপাস বাংলাদেশ এবং বিএনএনআরসি সহযোগিতায় এখন পর্যন্ত মোট ৫ টি উঠান বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে যেখানে ২০ থেকে ২৫ জন করে দম্পতি ও কিশোর-কিশোরীরা অংশগ্রহণ করেন। এছাড়াও প্রতি মাসে রেডিও মহানন্দায় সম্প্রচারিত হচ্ছে একটি ম্যাগাজিন এবং টক শো অনুষ্ঠান। যেখানে শ্রোতারা সরাসরি ফোন কলের মাধ্যমে তাদের সমস্যার কথা অতিথিদের কাছে বলতে পারবেন এবং উপস্থিত অতিথিবৃন্দ এসব প্রশ্নের উত্তর প্রদান করে থাকেন।
গণমাধ্যম হিসেবে জেলা থেকে প্রকাশিত পত্রিকা ও রেডিওতে পরিবার পরিকল্পনার সুফল সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে চলেছে। মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র, কমিউনিটি ক্লিনিক, স্যাটেলাইট ক্লিনিকে এ সেবা প্রদান করা হয়। নারী পুরুষের যে কোন স্থ্যায়ী ও অস্থায়ী পদ্ধতি নিতে স্থানীয় ক্লিনিক ও সদর হাসপাতালে সেবা পাওয়া যায়। সহজ লোভ্যতার কারণে যে কোন স্বাস্থ্যকেন্দ্রেও এ সেবা দেয়া হয়ে থাকে। কাজেই নিজের সুস্থতার জন্য, যৌন বাহিত রোগ, দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমাতে জন্মনিয়ন্ত্রণের কোন বিকল্প নেই। বর্তমান সরকারও এ বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন। জন্মনিয়ন্ত্রণে আরো প্রচার প্রচারণা চালাতে হবে, গড়ে তুলতে হবে সামাজিক আন্দোলন।
লেখক: গণমাধ্যম কর্মী