পদ্মা নদী ভাঙনের আতঙ্কে ৫০ হাজার মানুষ
ভাঙন শুরুর আগেই পদক্ষেপ নেয়ার দাবি এলাকাবাসীর
বর্ষাকালের আগেই এবার গ্রীষ্মের শেষ থেকেই শুরু হয়েছে বৃষ্টি। গ্রীষ্মের এই বৃষ্টি জোরেশোরে বর্ষাকাল আগমনেরই প্রতিধ্বনি। আর তাই আষাঢ়ের শুরু থেকেই প্রতিদিনই ঝরছে বৃষ্টি। পানিতে ভরে উঠছে ধু ধু পদ্মা নদী। বৃষ্টির সজীবতায় সবুজ প্রকৃতি উজ্জ্বল হলেও চাঁপাইনবাবগঞ্জে পদ্মায় পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বসতভিটা ভাঙার আতঙ্ক বাড়ছে নদী-তীরবর্তী হাজারো পরিবারের। এখনো ভাঙন শুরু না হলেও হুমকির মুখে রয়েছে কয়েকটি গ্রাম, প্রায় ৫০টি সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ১টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র, বিজিবি ক্যাম্প, স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র, হাটবাজার, কবরস্থান ও কয়েক হাজার হেক্টর আবাদি জমি।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, এবার বর্ষা মৌসুমে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হতে পারে। সম্ভাবনা রয়েছে ভারী বৃষ্টিরও। ফলে এবার বন্যা ও নদীর ভাঙনও বেশি হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন নদী তীরবর্তী মানুষ।
এরই মধ্যে ভারত থেকে বয়ে আসা গঙ্গা নদীর পানি চাঁপাইনবাবগঞ্জের পদ্মা নদীতে পড়তে শুরু করেছে। পানি যত বাড়বে স্রোতের তীব্রতা ততই বৃদ্ধি পাবে। উল্লেখ্য, সাধারণত শ্রাবণের শেষ থেকে শুরু করে ভাদ্র মাস পর্যন্ত এ অঞ্চলে পদ্মার ভাঙন দেখা যায়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের পদ্মা নদীর চরাঞ্চলে ৫০ হাজারের বেশি মানুষের বসবাস। নদী ভাঙনের সাথে যুদ্ধ করেই এদের বেঁচে থাকতে হয়। এ নির্মম দুর্যোগের সঙ্গে চরাঞ্চলের মানুষের মোকাবিলা চলে আসছে শতাধিক বছর ধরে। আর এই মোকাবিলায় তারা হয়েছে দিশেহারা ও সর্বস্বান্ত।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার নারায়ণপুর এবং শিবগঞ্জ উপজেলার পাঁকা, দুর্লভপুর ও উজিরপুর ইউনিয়ন নদী ভাঙন কবলিত। এসব এলাকার হাজার হাজার হেক্টর আবাদি জমি ও বসতবাড়ি এর আগে পদ্মা নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এ অঞ্চলের প্রতিটি পরিবারই কমপক্ষে ১০ বার করে নদী ভাঙনের কবলে পড়েছেন। হাজার হাজার পরিবার অন্যত্র ঠাঁই নিতে বাধ্য হয়েছেন, বলছেন এলাকাবাসী।
সরকারি হিসাবে গত এক দশকে ভিটেমাটি হারিয়েছেন প্রায় এক হাজার শ্রমজীবী মানুষ। আর এলাকাবাসীর মতে, এই সংখ্যা অন্তত ৫ হাজার। বিলীন হওয়া আবাদি জমির পরিমাণ প্রায় ২ হাজার হেক্টর। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ টাকার অঙ্কে প্রায় ৪০০ কোটির মতন।
তথ্যানুযায়ী, ১৯৯৫ সাল থেকে শুরু করে নদী ভাঙন প্রতিরোধে সরকার বেশ কয়েকবার পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই বিপুল পরিমাণ অর্থ ও কর্ম পরিকল্পনা অনেকটায় বিফলে গেছে। চলতি বছরের ৩ এপ্রিল চাঁপাইনবাবগঞ্জে পদ্মা নদী ভাঙন কবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. আ. ন. ম. বজলুর রশীদ। ওই সময় তিনি জানিয়েছিলেন, ভারত থেকে বয়ে আসা পদ্মা নদীর ভাটিতে চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রায় ২৫ কিলোমিটার নদী ভাঙন কবলিত এলাকা রক্ষায় স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের প্রকল্প নেয়া হচ্ছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে বসতবাড়ি ও ফসলী জমি স্থায়ীভাবে নদী ভাঙনের কবল থেকে রক্ষা পাবে।
শিবগঞ্জের দুর্লভপুর ইউনিয়নের যে স্থানে ভারতের গঙ্গা নদী পদ্মা নাম ধারণ করেছে, সেই স্থান থেকে ফারাক্কা বাঁধের দূরত্ব মাত্র ১৮ কিলোমিটার। ভারী বর্ষায় পাহাড়ি ঢল নেমে এলেই ফারাক্কা বাঁধের সব গেট খুলে দেয়া হয়। চরাঞ্চলবাসী বলছেন, এর ফলে পদ্মা আরো বেশি রাক্ষসী ও খরস্রোতা হয়ে উঠে। তখনই শুরু হয় তীব্র নদী ভাঙন। সেসময় বালিভর্তি জিও ব্যাগ ফেলে লাভ হয় না। ফেলার সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো স্রোতের তোড়ে তলিয়ে যায়।
ভুক্তভোগী এলাকাবাসী বলছেন, কয়েকবার ভরা বর্ষায় নদী ভাঙনকালীন অস্থায়ী জিও ব্যাগ, জিও টিউব ফেলা হয়েছে। এতে এলাকাবাসীর কোনো উপকারই হয়নি।
গমেরচর গ্রামের ল্যাচন আরা বেগম (৪০) বলেন, কয়েক বছর আগে ভাঙনে সবকিছু হারিয়ে উজিরপুর ছেড়ে পাঁকা চরে আশ্রয় নিয়েছি। এখানে এসেও দুইবার ঘরবাড়ি ভেঙেছে। নদী থেকে আমাদের গ্রাম এখন মাত্র ১০০ গজের মতো দূরত্ব। যে কোনো সময় নদীতে ভেসে যাওয়ার আশঙ্কায় রয়েছেন তিনি। নদীর ভাঙন ঠেকানোর জন্য বাঁধ দেখার সৌভাগ্য হবে কি— এই প্রশ্ন ল্যাচন আরার।
নদী ভাঙনের হুমকির মুখে থাকা দিনমজুর শহিদুল ইসলাম (৩০) মা, স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে কোনোরকম জীবিকা নির্বাহ করেন। অন্যের ভিটেমাটির এক কোণে আশ্রয় নিয়ে ঘর বেঁধে বাস করেন। গতবছর থেকেই নদী ভাঙনের আশঙ্কায় দিন পার করছেন।
শহিদুল ইসলাম বলেন, দুই বছর থেকেই আতঙ্কে আছি। ঝড়-বৃষ্টি হলেই ছুটে যাই নদী ধারে। আর আমাদের বাঁচার জন্য আল্লাহকে ডাকি।
তিনি আরো বলেন, বাড়ির সামনে বিশাল ঈদগাহ ছিল, সেটি গত দুই বছরে নদীতে ভেঙে গেছে। অনেক দিন ধরেই শুনে আসছি, সরকার বাঁধ করে ভাঙন বন্ধ করবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। তার কথা, সরকার এত কিছু করে, কিন্তু তাদের দুর্দশার কথা কি জানতে পারে না।
পাঁকা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আতাউর রহমান বলেন, জীবদ্দশায় বহুবার নদী ভাঙনের কবলে পড়েছি। বর্তমানেও বসতবাড়ি নিয়ে আমরা গ্রামবাসী হুমকির মুখে আছি।
চেয়ারম্যান থাকাকালে এবং এর পরেও ১৯৯৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত বহুবার ভাঙন প্রতিরোধে বাঁধ নির্মাণের জন্য সরকারের কাছে লিখিত আবেদন জানানো হয়েছিল বলে জানান তিনি।
আতাউর রহমান বলেন, গতবছরও একাধিকবার চাঁপাইনবাবগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডে সশরীরে গিয়ে অনুরোধ করেছি। উনারা সরেজমিন অনেকবার এলাকা পরিদর্শন করেছেন, সরকারও কয়েকবার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কিন্তু সঠিক পরিকল্পনার অভাবে কোনো কর্মসূচি কাজে লাগেনি। তিনি বলেন, ধাপে ধাপে সরকারের যে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ হয়েছে, তাতে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা সম্ভব ছিল। তিনি আরো বলেন, গতবছর থেকেই শুনছি স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প হাতে নিচ্ছে সরকার। তবে এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেই।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, পদ্মা নদীর ভাঙন প্রতিরোধে বাঁধ নির্মাণের প্রকল্পটি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সেটি এখনো একনেকে পাস হয়নি। সকল প্রক্রিয়া শেষ হয়ে সরেজমিনে কাজ শুরু হতে পারে আগামী বছর। প্রসঙ্গত, পদ্মা নদীর বামতীর স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে। তবে কিছু অংশ এখনো বাঁধ নির্মাণ করা হয়নি। অন্যদিকে ডান তীরের মানুষ এখন পর্যন্ত রয়েছে ভাঙন আতঙ্কে।