দেশ জুড়ে বিখ্যাত শিবগঞ্জের নবাবি আমলের আদি চমচম

420

বিয়ে, সুখবর, পরীক্ষায় পাস, নব-দম্পত্তির সন্তানের জন্ম, ঈদ, পূজাপার্বণসহ বিভিন্ন উৎসবের শুরুতেই যে জিনিসটার নাম সামনে চলে আসে তা হচ্ছে মিষ্টি বা মিষ্টান্ন। ভালোকাজের জন্য মিষ্টির প্রচলন রয়েছে আগে থেকেই। আর সে মিষ্টি যদি আদি বা বিখ্যাত হয় তাহলে তো কথায়ই নেই। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জের আদি চমচমের ইতিহাস বাংলার নবাবি আমলের। শিবগঞ্জের আদি চমচম এ জেলার দেড়শ বছরের ঐতিহ্যের ধারক। প্রাচীন বাংলার রাজধানী গৌড় তথা অবিভক্ত ভারতের মালদহ জেলার থানা ছিল শিবগঞ্জ। সে সময় এ অঞ্চলে ছিল অনেক ময়রার বসবাস। দেশভাগেরপর অনেকে মালদহে চলে গেলেও বেশকিছু পরিবার থেকে যায় শিবগঞ্জে। সেই সময়থেকে শুরু করে তারা এখনো এ পেশা ধরে রেখেছেন। এই চমচমের নাম শুনলেই জিভে পানি চলে আসে। ঐতিহ্যবাহী এ চমচম পাওয়া যায় কেবল চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ পৌর শহরের ৩ টি দোকানে। বর্তমানে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের বেশ কিছু দোকান অর্ডার দিয়ে কিনে এনে বিক্রি করছে জনপ্রিয়তার কারণে। ১৮৫৮ সালের দিকে শিবগঞ্জ বাজারে আদি চমচম তৈরি করেন শিবগঞ্জের নরেন্দ্র কুমার সরকার। তার মিষ্টির খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে সোনামসজিদ কানসাটসহ তৎকালীন মহকুমা শহর চাঁপাইনবাবগঞ্জে। তার মৃত্যুর পর এ ব্যবসার হাল ধরেন তার ২ ছেলে তাবল সরকার এবং ইন্দ্রভূষণ সরকার। বর্তমানে ৩ পুরুষের আদি চমচমের ব্যবসায় চালাচ্ছেন ইন্দ্রভূষণ সরকার ছাড়াও তাবল সরকারের ছেলে অরুণ কুমার সরকার এবং অপর ভাই বিজয় কুমার সরকারের ছেলে রিপন কুমার সরকার। শিবগঞ্জ বাজারে পাশাপাশি তিনটি আদি চমচমের দোকান। আদি চমচম, আসল আদি চমচম ও নিউ আদি চমচম। ৩ টি দোকানকে কেন্দ্র করেই বিখ্যাত মিষ্টি শিল্প হিসেবে গড়ে উঠেছে। গরুর খাঁটি দুধের ছানা ছাড়া আদি চমচম তৈরি অকল্পনীয়। এছাড়া যেকেউ ইচ্ছা করলেই আদি চমচম তৈরি করতে পারে না। এ চমচম তৈরির সঙ্গে এ অঞ্চলের আবহাওয়া ও পানির বিশেষ বৈশিষ্ট্য জড়িত রয়েছে। শিবগঞ্জে আদি চমচম প্রতি কেজির দাম ৩০০ টাকা। প্রতিটির ওজন ৭৫ গ্রাম থেকে ১৫০ গ্রাম। তবে ৫ থেকে ১০ কেজি ওজনের আদি চমচমও তারা সরবরাহ করেন ৬০০ টাকা কেজি দামে। বড় আকৃতির এ আদি চমচম অর্ডার দিলে তারা সরবরাহ করে থাকেন।গত বুধবার শিবগঞ্জের আসল আদি চমচমের দোকানে যেতেই চোখে পড়ল মিষ্টি রাখার শো-কেস। থরে থরে আদি চমচমসহ বেশকিছু মিষ্টি সাজিয়ে রাখা হয়েছে। ভেতরে প্রায় প্রতিটি চেয়ারে গ্রাহক বসে মিষ্টি খাচ্ছেন। চারদিকে তাকিয়ে চলে গেলাম দোকানের পেছনে মিষ্টি তৈরির কারখানায়। সে খানে যেতেই একজন কারিগর আমাকে ঘুরিয়ে কি ভাবে মিষ্টি তৈরি হয় সেটা দেখালেন। একটা মিষ্টি খেতে দিয়ে তিনি বললেন, এখানে কেউ আসলে আমারা মিষ্টি খাওয়ায়। সবকিছু দেখে বেরিয়ে যাবার মুহুর্তেই তিনি বললেন, থামেন আরেকটা মিষ্টি আছে দেখে যান। তারপর বড় একটি পাতিল বের করলেন। যা সেরা (চিনির ফোটানো রস) দিয়ে ডোবা ১ কেজি ওজনের মস্তবড় আদি চমচম। দেখে তো চোখ কপালে। তিনি আরো বলেন, এটাত এক কেজি। আমরা আরো বড় মাপের মিষ্টিও বানিয়ে থাকি। দোকানে প্রায় ২০ জন স্টাফ বা কারিগর কাজ করেন। সবাই যে যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত। দিনের দিন তাদের মজুরি দিয়ে দেয়া হয়। দোকানের স্টাফ রুবেল, সুকুমারসহ আরো অনেকে কাজ করে খুব খুশি বলে জানান। তারা আরো জানান, এখানে দেশের বিভিন্নপ্রান্ত থেকে মানুষ আদি চমচম খেতে বা কিনে নিতে আসে। আমের রাজধানীর জন্য যেমন চাঁপাইনবাবগঞ্জকে গোটা বিশ্ব জানে বা চিনে ঠিক তেমনি মিষ্টির জন্য আদি চমচমের নাম কোনো অংশে কম নয়। আদি চমচম আজ জেলার বৃত্ত ছাড়িয়ে কমবেশি সারাদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে।