দুই দিনের রাজা

263

ধরুন আপনাকে কোনো দেশ বা সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী করে দেয়া হলো- কেমন লাগবে? নিশ্চয়ই খুশি হবেন এবং বাকি জীবন এই ক্ষমতা নিয়ে বেঁচে থাকতে চাইবেন। তবে আজ আমরা এমন কিছু শাসকদের নিয়ে আলোচনা করবো যারা খুব স্বল্প সময়ের জন্য শাসকের আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। এ নিয়ে দুই পর্বের প্রতিবেদনের আজ থাকছে প্রথম পর্ব।

ফ্রান্সের ঊনবিংশ কিং লুইস

বেশিরভাগ ইউরোপীয় দেশগুলোর মতো ফ্রান্সেও রাজতন্ত্র বিদ্যমান ছিল। রাজতন্ত্রের ফলে কেবলমাত্র রাজপরিবারের সদস্যরাই উত্তরাধিকার সূত্রে রাজ্যের শাসনভার পেতেন। ঊনবিংশ শতকে কিং লুইসও উত্তরাধিকারসূত্রে মাত্র ২০ মিনিটের জন্য রাজা হয়েছিলেন। তিনি দশম চার্লস-এর পুত্র। দশম চার্লস ছিলেন ষোড়শ কিং লুইসের ছোট ভাই। ১৮০০ সালের গোড়ার দিকে ফরাসি বিপ্লবের সময় ফ্রান্সের রাজতন্ত্রভিত্তিক শাসনব্যবস্থা হুমকির মুখে পড়ে। রাজপরিবারের অনেককেই হত্যা করা হয়। অনেকে ফ্রান্স থেকে নির্বাসিতও হয়েছিলেন। এমতাবস্থায় রাজতন্ত্র টিকিয়ে রাখার জন্য রাজপরিবারের জীবিত লোকেরা আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন। ১৮২৪ সালে ফ্রান্সের রাজা মারা যাওয়ার পর, যেহেতু তার কোনো পুত্র সন্তান ছিল না তাই উত্তরাধিকার নিয়ম মেনে সিংহাসনের দায়িত্ব বর্তায় দশম চার্লস-এর কাঁধে। রাজতন্ত্র টিকিয়ে রাখার জন্য তিনি রাজতন্ত্রভিত্তিক শাসনব্যবস্থায় বহু সংস্কার করেন। কিন্তু রাজতন্ত্রের উপর জনগণের বিশ্বাস বা আস্থা ছিল না। সাধারণ জনগণ পরিবর্তন চাইছিল। ফলে ফ্রান্সজুড়ে বিদ্রোহ দানা বাঁধতে শুরু করে। চাপ সামলাতে না পেরে দশম চার্লস সিংহাসন ত্যাগ করেন। পরবর্তীতে তার ছেলে ঊনবিংশ কিং লুইসকে সিংহাসনে বসানো হয়। কিন্তু রাজপরিবারে রাজা হওয়ার মতো জনপ্রিয়তা তার ছিল না। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য- রাজা হওয়ার মাত্র ২০ মিনিটের মাথায় তিনি সিংহাসন ত্যাগ করেন এবং স্কটল্যান্ডে পালিয়ে যান।

চীনের জিন রাজবংশের সম্রাট মো

১১১৫ সালের দিকে উত্তর চীনের সবচেয়ে প্রভাবশালী এক রাজবংশের নাম ছিল জিন রাজবংশ। তাদের মধ্যে রাজা নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিদায়ী রাজার ভূমিকা ছিল বেশি। তিনি উত্তরাধিকার নির্বাচন করার অধিকার রাখতেন। তবে অন্যান্য রাজতন্ত্রে যেমন রাজ্যের সমস্ত ক্ষমতা একজন মাত্র মানুষের উপর অর্পিত ছিল, জিন রাজবংশে এমন হতো না। রাজা থাকলেও রাজ্যের বিভিন্ন দায়ভার রাজবংশের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের ভাগ করে দেয়া হতো। জিন রাজবংশের রাজারা অত্যন্ত বিচক্ষণ এবং দূরদর্শী ছিলেন। যেকোনো সাম্রাজ্যের মতো এদেরও বহিঃশত্রুর অভাব ছিল না। শত্রুদের মধ্যে চেঙ্গিস খান এবং সং রাজবংশ ছিল অন্যতম। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে জিন রাজবংশ এদের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধ চলাকালীন ১২২৪ সালে সম্রাট জুয়ানজং মারা যাওয়ার পর তার পুত্র আইজং সম্রাট হন। আইজং সফল শাসক ছিলেন। তিনি যুদ্ধে লিপ্ত প্রায় সব রাজ্যগুলোর সাথে শান্তিচুক্তি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু চেঙ্গিস খানের মৃত্যুর পর তার উত্তরসূরী এগদেই খান সং রাজবংশের সাথে সম্মিলিতভাবে জিন রাজবংশের রাজ্য আক্রমণ করে। নিশ্চিত পরাজয় বুঝতে পেরে সম্রাট আইজং কাইজৌতে পালিয়ে যান। পরবর্তীতে শত্রু দ্বারা অবরুদ্ধ অবস্থায় আত্মহত্যা করেন। ইতিহাসবিদদের মতে, নিজ চোখে জিন রাজবংশের পতন দেখতে চাননি বলেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। তবে পালিয়ে যাওয়ার আগে তিনি তার জেনারেল মো-কে সম্রাটের দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই শত্রুরা কাইজৌ দখল করে নেয়। সম্রাট হওয়ার মাত্র একদিনের মাথায় যুদ্ধে সম্রাট মো নিহত হন।

জার্মানির চ্যান্সেলর জোসেফ গোয়েবেলস

অ্যাডলফ হিটলারের ঘনিষ্ঠ মিত্র জোসেফ গোয়েবেলস ১৯২০ সালে নাৎসি পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে এবং যুদ্ধ চলাকালীন হিটলারের সবচেয়ে কাছের লোক ছিলেন তিনি। জোসেফ  মিষ্টভাষী, লেখক এবং সাংবাদিক ছিলেন। ১৯৩৩ সালে হিটলার চ্যান্সেলর হওয়ার পর জোসেফ গুরুত্বপূর্ণ পদে মন্ত্রী হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন। নাৎসি পার্টির প্রচার-প্রচারণা এবং জনসংযোগ শাখার দায়িত্ব হিটলার তার হাতে ন্যস্ত করেছিলেন। মিডিয়া এবং সাহিত্যের মধ্য দিয়ে জার্মানদের মধ্যে সেমিটিকবিরোধী মনোভাবের বীজ বপণে তার ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর জোসেফ একটি প্রচারণামূলক চলচ্চিত্র তৈরি করেন। জার্মান দর্শক মহলে সেই সিনেমাটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এই সিনেমার মধ্য দিয়ে এই বার্তা দেয়া হয়েছিল যে, নাৎসি পার্টি যা করছে তা দেশ এবং বিশ্বের মঙ্গল বয়ে আনবে। কিন্তু যুদ্ধে পরাজয় আসন্ন বুঝতে পেরে হিটলার আত্মহত্যা করার আগে তার সবচেয়ে কাছের এই সহচরকে তিনি জার্মানির চ্যান্সেলরের পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত চ্যান্সেলর হওয়ার ঠিক একদিন পর জোসেফ গোয়েবেলস ছয় সন্তান এবং স্ত্রী মগদা’কে নিয়ে জার্মানিতে হিটলারের বাঙ্কারে আত্মহত্যা করেন।

জাঞ্জিবারের সুলতান খালিদ বিন বারঘাশ 

পূর্ব আফ্রিকার দ্বীপ জাঞ্জিবার শাসন করতেন মুসলিম সুলতানরা। সুলতান খালিদ বিন বারঘাশ ছিলেন তাদের একজন। সুলতান হওয়ার আগ থেকেই তিনি জনগণের মাঝে তুমুল জনপ্রিয় ছিলেন। জাঞ্জিবারের লোকেরা তাকে ভালোবাসত এবং সম্মান করতো। তবে দুর্ভাগ্যবশত তিনি জাঞ্জিবারের সুলতান হয়েছিলেন মাত্র দুই দিনের জন্য। তিনি ছিলেন জাঞ্জিবারের বিখ্যাত ও জনপ্রিয় শাসক সাইদ বারঘাশ বিন সাইদ আল বুসাইদ-এর ছেলে। ১৮৯০ সালের দিকে পূর্ব আফ্রিকার এই দ্বীপটিতে ব্রিটিশরা কব্জা করে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর থেকেই তারা মসনদে তাদের অনুগত কাউকে বসাতে চাইছিল। কারণ সুলতানের তুমুল জনপ্রিয়তা ব্রিটিশদের মনে আশঙ্কার সৃষ্টি করেছিল। সুলতান বারঘাশ ব্রিটিশদের নবনির্বাচিত সুলতানের কাছে সালতানাত ছেড়ে দিতে অস্বীকৃতি জানালে ব্রিটিশরা জাঞ্জিবার উপকূলে যুদ্ধজাহাজ পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এর কিছুদিন পর তারা সুলতানের প্রাসাদ আক্রমণ করে এবং তাকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করে। সুলতান হওয়ার মাত্র দুই দিনের মাথায় আত্মসমর্পণ করে বারঘাশ জাঞ্জিবারকে ব্রিটিশদের হাতে তুলে দিয়ে পালিয়ে যান।

নেপালের রাজা দীপেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ দেব 

রাজা হওয়ার আগে দীপেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ ছিলেন নেপালের ক্রাউন প্রিন্স। রাজা হিসেবে অভিষেকের ঘটনা তার জন্য মোটেও সুখের ছিল না, বরং শোকের ছিল। জনশ্রুতি আছে তিনি ভারতীয় রাজপরিবারের কোনো এক রাজকুমারীর প্রেমে মত্ত হয়েছিলেন এবং তাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নেপালের রাজপরিবারের সেই বিয়েতে সায় ছিল না। ২০০১ সালের ১ জুন তিনি তার বাবা রাজা বীরেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ দেব, মা রাণী ঐশ্বরিয়াসহ রাজপরিবারের আরো আট সদস্যকে গুলি করে হত্যা করেন। তারপর নিজেও মাথায় গুলি করে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। কিন্তু সৌভাগ্যবশত তার মৃত্যু হয়নি। বাজেভাবে আহত হয়ে কোমায় চলে যান তিনি। যেহেতু তিনি নেপালের ক্রাউন প্রিন্স ছিলেন, তাই রাজা মারা যাওয়ার পর উত্তরাধিকারসূত্রে তিনিই নেপালের রাজার পদ পান। তবে রাজা হিসেবে তার ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল না। রাজ্যাভিষেক হওয়ার তিন দিন পর কোমায় থাকা অবস্থাতেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তারপর উত্তরাধিকারসূত্রে তার চাচা রাজা জ্ঞানেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ দেব নেপালের সিংহাসনে বসেন।