দুঃসাহসী শিকারীর গড়া এক চিড়িয়াখানা

330

ঘড়ির কাঁটায় তখন ভোর পাঁচটা। গভীর ঘুমে ছিলাম। ঘড়ির কর্কশ ডাকে ঘুম ভেঙে গেল। ঘড়ির আর দোষ কি? আমিই অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছিলাম। ঘুম থেকে উঠতে মন চাইছিল না। ভাবলাম আরেকটু শুয়ে থাকি, এরপর উঠে তৈরি হবো। নিদ্রা দেবীও হয়তো তাই চাইছিলেন। ফলে ঘুম ভাঙ্গতে সেই দেরিই হয়ে গেলো। অবশেষে সানন্দার ডাকাডাকিতে ঘুম থেকে উঠতেই হলো। উঠেই তৈরি হয়ে নিলাম নতুন গন্তব্যপানে যাবো বলে।  আজ শ্রীমঙ্গল ভ্রমণের দ্বিতীয় দিন। আমাদের আজকের গন্তব্য সীতেশ বাবুর চিড়িয়াখানা। এই চিড়িয়াখানার কথা শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। বই-এ পড়েছি, ভালুক শিকার করতে গিয়ে কীভাবে সীতেশ বাবু মুখের একাংশ হারিয়েছেন। কীভাবে পশুপাখির অকৃত্রিম বন্ধু হয়েছেন।

আগে থেকেই বলা ছিল তিন চাকার বাহন, যে কারণে আমাদের বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়নি। আমরা চলছি মহাসড়ক দিয়ে। স্নিগ্ধ সকালে বেশ ভালো লাগছিলো। দেখতে দেখতে আমরা এসে উপস্থিত হলাম, বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনের সদর দ্বারে। প্রবেশদ্বারে অনেক মানুষের ভিড়।আমাদের মত অনেকেই এসেছেন। বেশ কিছু সময় লাইনে দাঁড়িয়ে টিকেট কেটে প্রবেশ করলাম। বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনের প্রবেশদ্বার পেড়িয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই শুনতে পেলাম পশুপাখির কিচিরমিচির। ঢুকেই দেখতে পেলাম ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম সংবলিত দেয়ালচিত্র।

আমি ভাবলাম একটু দেখে নেই। কিন্তু বাদ সাধলেন সহধর্মিণী। সানন্দার কথামত সামনে এগিয়ে গেলাম।  তার দেখানো পথ ধরে এগিয়ে যেতেই দেখলাম বিরল প্রজাতির সোনালী হনুমান। খুব নিরিবিলি বসে আছে। দেখে মনে হলো, সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছে। পাশের খাঁচার বানরকে বেশ উত্তপ্ত মনে হলো। সে খাঁচা ধরে টানাটানি করছে। পাশেই দেখলাম বেশ খোশ মেজাজে বসে আছে বনমানুষ। আমি ছবি তুলছি দেখে সামনের দিকে এগিয়ে এলো। এরপর একে একে দেখতে পেলাম সোনালী হনুমান, শকুন, সাদা বক, বিরল প্রজাতির সোনালী রঙের কচ্ছপ। সোনালী কচ্ছপ আপনি আগে হয়ত কখনো দেখেননি। এই কচ্ছপের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- এরা গাছে বাস করে। কখনো পানিতে নামে না, ডাঙ্গায় বিচরণ করতে দেখা যায় কদাচিৎ। শুকনো খাবার খেতে পছন্দ করে বেশি। কিছু দূরেই দেখতে পেলাম বিষাক্ত শঙ্খিনী। তার জন্য খাবার দিয়ে রাখা হয়েছে কিন্তু সে আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে না।

সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলাম। দেখা পেলাম বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনের এক পরিচর্যাকারীর সঙ্গে।  জানতে চাইলাম, সীতেশ রঞ্জন দেবের সাথে দেখা হবে কি না? উত্তরে বললেন, সীতেশ বাবু শহরে গিয়েছেন। আজ দেখা হবে না। শুনে একটু মন খারাপ হলো। বললাম এই প্রতিষ্ঠান শুরুর কথা জানতে চাই। তিনি বললেন, আমি যতটুকু জানি এক সময় সীতেশ রঞ্জন দেব দুর্দান্ত শিকারী ছিলেন। ৪৫ বছর আগে পশুপাখির সেবা আশ্রম হিসেবে গোড়াপত্তন করেছিলেন তাঁর বাবা শ্রীশচন্দ্র দেব। দুরন্ত বালক সীতেশ বাবার নেশা তথা পশুপাখির প্রতি ভালোবাসার অভ্যাস পেয়েছেন। বাবার সঙ্গে থাকতে থাকতে নিজেও যে কখন পশুপাখিপ্রেমী হয়ে উঠেছেন বুঝতে পারেননি। শিকার করতে গিয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন বহুবার। এর ছাপ আছে তাঁর শরীরেও। আছে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ঘুরে আসার দুঃসাহসিক রোমাঞ্চকর গল্প। ১৯৯১ সালে কমলগঞ্জের পত্রখোলা চা-বাগানে বন্যশূকরের উপদ্রব বেড়ে যায়। চা-বাগান কর্তৃপক্ষ সীতেশ বাবুর শরণাপন্ন হয়। বাগানে সারারাত দোনলা বন্দুক নিয়ে শিকার করেন সীতেশ বাবু। শিকার চলাকালে প্রায় আট ফুট লম্বা একটি ভালুকের সামনে পড়েন। ভালুকের থাবায় তাঁর ডান চোখসহ গালের অনেকটা ক্ষত হয়। টানা দুই মাস চলে চিকিৎসা। সুস্থ হলেও চেহারায় সেই ভয়াল থাবার ছাপ রয়েই যায়।

আমরা কথা বলছি আর হাঁটছি। এক জায়গায় দেখলাম, অজগর সাপ। একে একে দেখা পেলাম সজারু, হিংস্র মেছো বিড়াল, চারপাশে আতপ চালের গন্ধ ছড়ানো গন্ধগোকুল, পাহাড়ি বক, নিশি বক ও অসংখ্য বিরল প্রজাতির পাখি। দেখা পেলাম বাংলার লজ্জাবতী বানরের। এরা দিনের বেলা মাথা নিচু করে থাকে। চোখও বন্ধ করে রাখে। এমনকি দিনে খাবারও খায় না। এর যত কাজ রাতের অন্ধকারে। এজন্যই নাম হয়েছে লজ্জাবতী। তাছাড়া একে একে দেখতে পেলাম উড়ন্ত কাঠবিড়ালী, হনুমান, মায়া হরিণসহ প্রায় দেড়শ প্রজাতির জীবজন্তু। সীতেশ বাবু স্থানীয় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে প্রায় তিন দশক ধরে পরিশ্রম করছেন। প্রায়ই তিনি বিভিন্ন স্থানে ধরা পড়া বন্যপ্রাণী উদ্ধার করে সেবা-সুশ্রুষা দিয়ে আবার জঙ্গলে ছেড়ে দেন। পুরো এলাকা ঘুরে এবার আমরা এলাম বের হবার পথে রাখা নোটিশ বোর্ডের সামনে। এখানে সীতেশ বাবুর নানা ধরনের কর্মকাণ্ডের সচিত্র বর্ণনা আছে।