ড্রাকুলা: কল্পনাতে ভয় জাগানিয়া!!

196

হোটেল ট্রানসিলভানিয়া নামে একটি সিনেমা আছে। এতে একটি ছেলে ঘুরতে ঘুরতে ড্রাকুলার বাড়িতে চলে যায়। সেখানে ড্রাকুলার মেয়ের সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। পরে যখন জানতে পারে, এরা ড্রাকুলা, তখন তার ভয়ের অন্ত থাকে না। ড্রাকুলা তো উপন্যাস। বাস্তবে রক্তচোষা ড্রাকুলা যে নেই, তা সবাই জানি। তবু একবার আপনি ভাবুন, ভ্রমণের উদ্দেশ্যে ট্রানসিলভানিয়াতে গেলেন। সেখানে আপনি যাওয়ার পর এমন একটা রহস্যময় বাড়িতে প্রবেশ করলেন যে, আপনার গায়ে কাটা দিয়ে ‍উঠল। কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করে যখনই বের হতে যাবেন, তখন পেছন থেকে কেউ ঘাড়ে হাত দিয়ে বললেন, ‘আসুন আপনি আজ আমার মেহমান’। ড্রাকুলা নিয়ে অনেক গল্প চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। তার কিছু আমরা জানি, কিছু জানি না। তবে ড্রাকুলা থাকুক আর না থাকুক ড্রাকুলাকে ভয় পেতে এবং বিশ্বাস করতে আমাদের ভালোই লাগে।

মধ্য যুগে রোমানিয়া চার ভাগে বিভক্ত ছিল—‘প্রিন্সিপ্যালিটি’ বা যুবরাজ-শাসিত রাজ্য, ওয়ালাশিয়া, মলডাভিয়া ও ট্রানসিলভানিয়া। ১৪৩১ সালে কার্পেথিয়ান পর্বতমালার কোলে অবস্থিত ট্রানসিলভানিয়ার দক্ষিণে ওয়ালাশিয়া রাজ্যের যুবরাজ ভ্লাদ ড্রাকুলের স্ত্রী একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। তাঁর নাম তৃতীয় ভ্লাদ। রোমানিয়ান প্রথানুসারে তাঁকে ডাকা হতো ‘ড্রাকুলা’ নামে। ভ্লাদ ড্রাকুলার নামের অর্থ ছিল ‘ভ্লাদ দ্য ডেভিল’ বা ‘শয়তান ভ্লাদ’। সেই অর্থে তাঁর পুত্রের নামের অর্থ হয় ‘শয়তানের পুত্র’। চতুর্থ ভ্লাদ ভ্যাম্পায়ার ছিলেন না বটে, কিন্তু তাঁর নামের সঙ্গে পরবর্তীকালে যে বিশেষণটি জুড়ে যায়, সেটি তাঁর ‘রক্তপিপাসু’ প্রবৃত্তির কিছুটা আভাস বহন করে। তাঁকে বলা হতো ‘ভ্লাদ দ্য ইমপেলার’ বা ‘শূলে-চড়ানিয়া ভ্লাদ’। মধ্য যুগের ইতিহাসেও তাঁর নিষ্ঠুরতার কাহিনি একটু বেশি রকমের আশ্চর্যজনক। সময়টা ইউরোপের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অস্থিরতার যুগ।

তুর্কি মুসলমানরা এই সময় সমগ্র ইউরোপ জুড়ে এক বড়সড়ো যুদ্ধাভিযানের ছক কষছিল। আর তাই নিয়ে ইউরোপের খ্রিষ্টান রাজশক্তির সঙ্গে চলছিল তাদের সংঘাত। ছেলেবেলায় একবার তুর্কিদের হাতে বন্দি হয়েছিলেন ভ্লাদ। তাঁর মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার প্রিয় পদ্ধতি শূলে চড়ানোর কৌশলটিও তিনি শিখেছিলেন এই তুর্কিদের দেখাদেখি। পদ্ধতিটা সহজ, তবে বর্বরোচিত। একটা সূচালো আগাবিশিষ্ট কাঠ বা লোহার বিরাট একটি শলাকা বিঁধিয়ে দেওয়া হতো দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির শরীরে। তারপর ওই অবস্থাতেই শলাকাটি খাড়াভাবে দাঁড় করিয়ে মাটির সঙ্গে গেঁথে দেওয়া হতো। শলাকার মাথায় দণ্ডপ্রাপ্ত লোকটি যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে প্রাণত্যাগ করত।

১৪৪৮ খ্রিষ্টাব্দে তুর্কিরা ভ্লাদকে ওয়ালাশিয়ার সিংহাসনে স্থাপন করে। কিন্তু ভ্লাদ বিদ্রোহ করে পালিয়ে যান একটি খ্রিষ্টান মাঠে। তুর্কিরা পূর্ব ইউরোপের বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল দখল করে নিলে ১৪৫৬ সালে ওয়ালাশিয়ায় ফিরে আসেন ভ্লাদ। তুর্কিদের সঙ্গে শুরু হয় তাঁর তুমুল সংগ্রাম। তাঁর সেনাবাহিনী প্রায় কৃষ্ণসাগর পর্যন্ত গিয়ে দানিউব নদীর অববাহিকায় সবকটি দুর্গ পুনরুদ্ধার করে এবং শত্রুদের নৃশংসভাবে হত্যা করতে থাকে। এই সময়েই সমগ্র অঞ্চল জুড়ে একই সঙ্গে খ্যাতি ও কুখ্যাতি কুড়িয়েছিলেন ভ্লাদ। শোনা যায়, দু’জন তুর্কি দূত তাঁর সভায় পাগড়ি খুলতে অস্বীকার করলে, পাগড়ি তাদের মাথার খুলির সঙ্গে পেরেক দিয়ে গেঁথে দেওয়ার আদেশ দিয়েছিলেন তিনি। নিজের প্রজাদের সঙ্গেও যে ভ্লাদ খুব সুব্যবহার করতেন এমন নয়। কারণে অকারণে হানা দিতেন বন্ধু শহরে। অত্যাচার চালাতেন। মানুষ খুন করতেন। পুড়িয়ে মারতেন, জীবন্ত সিদ্ধ করতেন বা গায়ের চামড়া ছাড়িয়ে নিতেন।

১৪৬০ সালের সেন্ট বার্থালোমিও ডে-এর দিনে ট্রানসিলভানিয়ার একটি শহরে হানা দিয়ে ৩০ হাজার লোককে শূলে চড়িয়েছিলেন ভ্লাদ। এটিই ছিল তাঁর নিষ্ঠুরতম গণহত্যা। শেষ দিকে ভ্লাদের সেনাবাহিনী তুর্কিদের হাতে পরাজিত হয়। তাঁর নিজের লোকজনও তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। জাল কাগজ বের করে তারা প্রমাণ করে যে ঘৃণিত তুর্কিদের সঙ্গে ভ্লাদের যোগসাজেশ ছিল। হাঙ্গেরির কিং মাথিয়াসে তাঁকে বারো বছর বন্দি রাখা হয়। কিন্তু মানুষকে শূলে চড়ানো তাঁর নেশায় পরিণত হয়েছিল। জানা যায়, কারারক্ষীদের বশ করে তাদের দিয়ে নেংটি ইঁদুর বা অন্য ছোট জানোয়ার নিজের কক্ষে আনিয়ে নেশাগ্রস্তের মতো সেগুলো শলাকায় বিঁধিয়ে মারতেন। ১৪৭৬ সালে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। শোনা যায়, ১৪৭৮ সালে সিংহাসন ফিরে পাওয়ার দু’মাসের মধ্যে তুর্কিদের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ান। সেখানেই তার মৃত্যু হয়। অবশ্য তাঁর মৃত্যু আজও রহস্যের অন্তরালে।

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে এই ‘শূলে চড়ানিয়া’ ভ্লাদের সঙ্গে ভ্যাম্পায়ারের কী সম্পর্ক? ‘ড্রাকুলা’ উপন্যাসের সেই কুখ্যাত রক্তচোষা কাউন্টের নাম হিসেবে ব্রাম স্টোকার ব্যবহার করেছেন শূলে-চড়ানিয়া ভ্লাদের ডাকনামটি। শুধু তাই নয়, কার্পেথিয়ান পর্বতমালার ভূতুড়ে নিসর্গ, মধ্যযুগীয় রোমানিয়ান ইতিহাসের নানা আবছায়া অনুষঙ্গ নিয়ে ট্রানসিলভানিয়ার ইতিহাসের ছায়া অনেকটাই পড়েছে ওই বেস্টসেলার বইটির গল্পে। কাউন্ট ড্রাকুলা নামটি স্টোকার সম্ভবত পেয়েছিলেন উইলিয়াম উইলকিনসনের বই ‘অ্যান অ্যাকাউন্ট অব দ্য প্রিন্সিপ্যালিটিস অব ওয়ালাশিয়া অ্যান্ড মলডাভিয়া: ইউথ ভেরিয়াস পলিটিক্যাল অবজার্ভেশনস রিলেটিং টু দেম’ থেকে। বইটির কথা স্টোকার উল্লেখও করেছেন। বুদাপেস্টের এক হাঙ্গেরীয় অধ্যাপক ছিলেন স্টোকারের বন্ধু।

কেউ কেউ তাই মনে করেন কাউন্ট ড্রাকুলা নামটি তাঁর বন্ধুর মুখ থেকেই শোনা। কেউ কেউ আবার বলে থাকেন কাউন্ট ড্রাকুলার নামটি ছাড়া শূলে-চড়ানিয়া ভ্লাদ সম্পর্কে আর কিছুই তেমন জানতেন না স্টোকার। তবে উপন্যাস বিভিন্ন অংশে কাউন্টের সংলাপে তাঁর অতীতের যে টুকরো ছবি পাওয়া যায়, তা পড়ে বলতেই হয়, রোমানিয়ার ইতিহাস সম্পর্কে স্টোকার একেবারেই ‘ক’ বর্ণের গোমাংস ছিলেন না। তবে তিনি শূলে-চড়ানিয়া ভ্লাদের কোনো উল্লেখ করেননি, এমনকি তাঁর শূলে-চড়ানো অভ্যাসটিরও কোনো আভাস দেননি উপন্যাসে।

এই ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হবে, রোমানিয়ার ওই অঞ্চলে ভ্যাম্পায়ার মিথের জনপ্রিয়তা। ভ্যাম্পায়ার-জাতীয় প্রাণীর উল্লেখ গ্রিস, মিশর এমনকি ভারতীয় লোককথাতেও পাওয়া যায়। কিন্তু ইউরোপীয় ভ্যাম্পায়ার মিথের উৎস দক্ষিণ স্লাভিক উপকথা। রোমানিয়ার সংস্কৃতিতে অবশ্য এই উপকথাগুলো পাওয়া যায় না। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে পূর্ব ইউরোপে ভ্যাম্পায়ার উপকথাগুলো ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে বলকান থেকে প্রত্যাগত পর্যটকদের হাত ধরে এই উপকথাগুলো ছড়িয়ে পড়ে পশ্চিম ইউরোপে। কি আশ্চর্য সমাপতন! উনিশ শতকের শেষ ভাগে স্বয়ং কাউন্ট ড্রাকুলাও লন্ডনে এসেছিলেন এই রকম এক পর্যটকের সাহায্যে! শূলে-চড়ানিয়া ভ্লাদের কিংবদন্তি আর ভ্যাম্পায়ার উপকথা- পূর্ব ইউরোপের এই দুই উপাদানের সংমিশ্রণেই স্টোকার লেখেন তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘ড্রাকুলা’’। সম্ভবত ট্রানসিলভানিয়া অঞ্চলে প্রচলিত ভ্যাম্পায়ার উপকথার কথা স্মরণ করেই স্টোকার তাঁর সৃষ্ট বিখ্যাত ভ্যাম্পায়ার চরিত্রটির পটভূমি সেখানেই স্থাপন করেন। আর পটভূমি নির্বাচনের পর এখানকার সবচেয়ে কুখ্যাত শাসক ভ্লাদ ড্রাকুলার কথাও স্বভাবতই তাঁর মনে এসে থাকবে।

তিনি জানতেন খুব কম লোকই ভ্লাদ ড্রাকুলার সঙ্গে কাউন্ট ড্রাকুলার সংযোগটি আবিষ্কার করতে সক্ষম হবেন। আর যাঁরা সক্ষম হবেন, তাঁরাও ভ্লাদ ড্রাকুলার ‘রক্তপিপাসু’ প্রবৃত্তির সঙ্গে ভালো মতোই পরিচিত থাকবেন। আর তাই ভ্যাম্পায়ার হিসেবে ড্রাকুলাই ছিলেন স্টোকারের কাছে সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য। সাধে কি আর উপন্যাসের নায়ক জনাথান হার্কার তার জার্নালে লিখেছিলেন— ‘একটা কাল্পনিক ঘূর্ণির কেন্দ্রের মতো বিশ্বের যত পরিচিত কুসংস্কার এসে জমা হয় কার্পেথিয়ানের ঘোড়ার খুরের নালে।’

সূত্র: রাইজিংবিডি